বনের রাজা সিংহ ঢাকঢোল পিটিয়ে জানিয়ে দিল, ‘কোনো শিশুকে নিরক্ষর রাখা চলবে না। সবার জন্য যথাযথ শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। সব ছেলেমেয়েকে স্কুলে পাঠাতে হবে। পড়াশোনা শেষ হলে সবাইকে সার্টিফিকেট দেওয়া হবে।’ শুরু হয়ে গেল শিক্ষা অভিযান! হাতির বাচ্চা স্কুলে এলো। বাঁদর, কচ্ছপ, উট, হরিণ, মাছ, জিরাফ সবার বাচ্চাই স্কুলে পৌঁছে গেল। ধুমধাম করে চলছে পড়ালেখা। সবার বাচ্চারাই খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ালেখা করছে। পরীক্ষায় সবাই ফার্স্ট হবে এমনটাই আশা। জাত-মান-কুল রক্ষা করতে হবে তো। ফাইনাল পরীক্ষার আগে হলো ক্লাস টেস্ট। ক্লাস টেস্টে হাতির বাচ্চা ফেল। হাতি এসে প্রশ্ন করে, ‘কোন সাবজেক্টে ফেল’? স্কুল কর্তৃপক্ষের জবাব, ‘গাছে ওঠা সাবজেক্টে’। হাতি পড়ল মহাচিন্তায়। তার ছেলে ফেল? এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। ভালো টিউটর নিয়োগ করতে হবে। সন্তানের শিক্ষার ব্যাপারে কোনো রকম কম্প্রমাইজ করা যাবে না। হাতির এখন একটাই টেনশন, যেভাবেই হোক, ছেলেকে গাছে চড়া শেখাতেই হবে! ‘গাছে ওঠা’ বিষয়ে দক্ষ করে তুলতে হবে। প্রথম বর্ষের চূড়ান্ত রেজাল্ট বের হলো। দেখা গেল-হাতি, উট, জিরাফ, মাছ, সবার বাচ্চাই ফেল। বাঁদরের বাচ্চা প্রথম হয়েছে। প্রকাশ্য মঞ্চে বিভিন্ন অতিথিদের আমন্ত্রিত করে, বিরাট অনুষ্ঠান আয়োজন করা হলো। সেখানে প্রথম হিসেবে বাঁদরের বাচ্চার গলায় মেডেল পরিয়ে দেওয়া হলো। চূড়ান্ত অপমানিত হয়ে হাতি, উট, জিরাফ তাদের নিজ নিজ সন্তানকে বেদম পিটুনি দিল আর বকাবকি করল। এত টিউশন, এত খরচ, এর পরেও এই রেজাল্ট!
ফাঁকিবাজ, এত চেষ্টা করেও তোর দ্বারা গাছে চড়া সম্ভব হলো না? অপদার্থ কোথাকার! বাঁদরের বাচ্চার কাছ থেকে শিক্ষা নে, কীভাবে গাছে চড়তে হয়!
ফেল কিন্তু মাছের ছেলেও করেছে। সে আবার প্রত্যেক বিষয়ে ফেল, কেবল সাঁতার কাটা ছাড়া। প্রিন্সিপাল বলল, ‘আপনার সন্তানের স্কুলের উপস্থিতিতেও সমস্যা। পাঁচ মিনিটের বেশি ক্লাসে থাকতে পারে না।’
মাছ নিজের সন্তানের দিকে ক্রোধান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মাছের ছেলে বলে, ‘মা, দম নিতে পারি না, ভীষণ কষ্ট হয়। আমার জন্য পানির মধ্যে কোনো স্কুল দেখলে হতো না?’ মা মাছ বলে, ‘চুপ কর বেয়াদব! এত ভালো স্কুল আর কোথাও পাবি? পড়াশোনায় মন দে, স্কুল নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না!’ হাতি, উট, জিরাফ, যার যার ফেল্টুস বাচ্চাকে ধোলাই দিতে দিতে বাড়ির দিকে যাচ্ছে। পথের মধ্যে শিয়ালের সঙ্গে দেখা।
শিয়াল বলে, ‘কী হয়েছে তোমাদের সেটা খুলে বলো তো!’
হাতি বলে, এত বড় শরীর নিয়ে গাছে চড়তে পারল না। বাঁদরের ছেলে প্রথম হলো, মানইজ্জত কিছুই অবশিষ্ট থাকল না! শিয়াল অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। কোনোমতে হাসি থামিয়ে বলে, ‘তোমাদের গাছে চড়ার কী প্রয়োজন সেটাই তো বুঝতে পারলাম না? শোনো হাতি ভায়া, তুমি নিজের বিশালাকার শুঁড় উঁচিয়ে ধর, গাছের সবচেয়ে বড় ফলটি পেড়ে ভক্ষণ কর। তোমার গাছে ওঠার কী দরকার? ‘উট ভাই, তোমার অনেক উঁচু ঘাড় রয়েছে। ঘাড় বাড়িয়ে দাও, গাছের সেরা ফলপাতাগুলো পেড়ে খাও।’ বোন মাছ, তোমার সন্তানকে নদীর স্কুলে ভর্তি করে দাও। ওকে মন ভরে সাঁতার কাটতে শেখাও। দেখবে এক দিন তোমার ছেলে নদী অতিক্রম করে সমুদ্রে পাড়ি দেবে। সাত সমুদ্র পার হয়ে তোমার নাম উজ্জ্বল করবে। ওকে রাজার স্কুলে মোটেও পাঠিও না। ও মারা যাবে।
মনে রাখতে হবে, শিক্ষা আপনার সন্তানের জন্য, শিক্ষার জন্য আপনার সন্তান নয়। প্রত্যেক শিশুর মধ্যেই কিছু না কিছু স্পেশালিটি আছে। অভিভাবক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হলো, সেটা খুঁজে বের করা, তাকে সঠিক পথ দেখিয়ে দেওয়া, সঠিক পথে পরিচালিত করা। তাহলেই দেখবেন, সে নিজেই নিজের গন্তব্য খুঁজে নেবে। আর তখন ওদের ভবিষ্যৎ হবে আলোকিত।