৫ ডিসেম্বর, ২০২১ ০৮:১৯

সম্ভাবনার নতুন শিল্প মোটরসাইকেল

রাইড শেয়ারিংয়ের জনপ্রিয়তায় বেড়েছে চাহিদা ► দেশে উৎপাদিত হচ্ছে মোটরসাইকেল ► রয়েছে সংযোজন কারখানা ► পণ্য আমদানিনির্ভর হলেও সংযোজনের পর রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে ► রপ্তানিতে ১০ শতাংশ নগদ সহায়তার নির্দেশনা সরকারের ► মোটরসাইকেল ব্যবহারে কর্মসংস্থানে নীরব বিপ্লব

আলী রিয়াজ

সম্ভাবনার নতুন শিল্প মোটরসাইকেল

সম্ভাবনার নতুন শিল্প মোটরসাইকেল

তেলের দাম বৃদ্ধি, ভাড়া জটিলতা, করোনা সংক্রমণের ঝুঁকিমুক্ত নিরাপদ বাহন হিসেবে এখন মানুষের আগ্রহ মোটরসাইকেলে। রাজধানীসহ সারা দেশেই সময় বাঁচিয়ে জ্যাম ঠেলে গন্তব্যে পৌঁছাতে মোটরসাইকেলের বিকল্প নেই। তাই গত কয়েক বছরে মোটরসাইকেলের রাইড শেয়ারিং জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। দ্রুত চলাচলের জন্য রাইড শেয়ারিং এখন নাগরিকদের অপরিহার্য তালিকায় ঢুকে পড়েছে। অন্যান্য যানবাহনের তুলনায় একদিকে যেমন খরচের পরিমাণ কম, ঠিক তেমনি অনেক বেশি সময় সাশ্রয়ী। পাশাপাশি রাইড শেয়ারিংয়ে গণপরিবহনে যাত্রীদের ঠাসাঠাসি, ভিড়বাট্টা এড়িয়ে   চলার সুযোগ থাকে। আর এ কারণেই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মোটরসাইকেলের মাধ্যমে চব্বিশ ঘণ্টা নিচ্ছে রাইড শেয়ারিং সেবা। মূলত এসব কারণেই দেশে মহামারীর ধাক্কায় অর্থনীতির সব খাত চাপে পড়লেও মোটরসাইকেল শিল্প তুলনামূলকভাবে কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উল্টো গত কয়েক বছরে এই শিল্পে এসেছে নীরব বিপ্লব। উন্মোচিত হয়েছে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত।

বর্তমানে বাংলাদেশেই উৎপাদিত হচ্ছে মোটরসাইকেল। এর বাইরে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান মোটরসাইকেল সংযোজন কারখানা গড়ে তুলেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এসিআই মোটরস লিমিটেডের ইয়ামাহা, টিভিএস মোটরসাইকেল, নিলয় মোটরসের হিরো, উত্তরা মটরসের বাজাজসহ আরও কিছু বিখ্যাত ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল এখন বাংলাদেশে সংযোজিত হচ্ছে। এমনকি হোন্ডার মতো বিখ্যাত ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেলও এখন দেশে সংযোজিত হচ্ছে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, আমদানিনির্ভর পণ্য হলেও দেশে সংযোজনের পর বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠানের মোটরসাইকেল। ফলে মোটরসাইকেলকে নতুন সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে চিহ্নিত করেছে সরকার। সে কারণে মোটরসাইকেল রপ্তানিতে ১০ শতাংশ নগদ সহায়তা দেওয়ার নির্দেশনা জারি হয়েছে।

এ শিল্পকে এগিয়ে নেওয়ার নিমিত্তে মোটরসাইকেল শিল্প উন্নয়ন নীতিমালা ২০১৮ প্রণয়ন করা হয়। দেশে মোটরসাইকেল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পাশাপাশি রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয় ওই নীতিমালায়। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক মোটরসাইকেলসহ ৯টি পণ্য রপ্তানিতে ১০ শতাংশ নগদ সহায়তা দেওয়া সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে। মূলত বৈশ্বিক বাজারে এসব পণ্যের প্রতিযোগিতা করার সক্ষমতা বাড়ানো ও রপ্তানি বাণিজ্য চাঙা করার জন্যই এ প্রণোদনা। নীতিমালায় মোটরসাইকেল খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান ৫ লাখ থেকে বাড়িয়ে ২০২৭ সালের মধ্যে ১৫ লাখে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

১০ লাখ মোটরসাইকেল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে নীতিমালায়। দেশে মোটরসাইকেল উৎপাদনের পর স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে সেগুলো সরবরাহ করা হবে। বাংলাদেশে বিদ্যমান মোটরসাইকেল সংযোজন শিল্পের পরিবর্তে এখানে বিশ্বমানের মোটরসাইকেল উৎপাদন কারখানা সৃষ্টিতে উৎসাহিত করা হবে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, এ খাতে বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা।

দেশে মোটরসাইকেলের বর্তমান বাজারের আকার ৪ থেকে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা। আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং সারা দেশে সড়ক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক বড় হওয়া, বিশেষ করে গ্রামীণ জনপদে পাকা সড়ক নির্মাণের কারণে মোটরসাইকেলের চাহিদা বাড়ছে। বছরে এ খাতে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি হচ্ছে।

দেশে বর্তমানে সাত থেকে আটটি সুপরিচিত ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেলের কারখানা রয়েছে। ভারতের বাজাজ, টিভিএস, হিরো, জাপানের হোন্ডা, সুজুকি ও ইয়ামাহা। এর বাইরে দুটি দেশি কারখানা রয়েছে। যারা দেশে উৎপাদন করে রপ্তানি শুরু করেছে। অনেক ক্ষেত্রেই বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো দেশে যৌথ উদ্যোগে  কারখানা করেছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করেছে বাংলাদেশি কোম্পানি, কারিগরি সহায়তা দিয়েছে মূল প্রতিষ্ঠান। বিদেশি মোটরসাইকেল কারখানাগুলো দেশে সংযোজনের পাশাপাশি খুচরা অনেক যন্ত্রাংশই তৈরির পরিকল্পনা করছে। উৎপাদকরা দেশে সহযোগী শিল্প গড়ে তুলতে আগ্রহী।

জানা গেছে, কয়েক দশক আগে ভারতের বাজারে এভাবেই মোটরসাইকেল শিল্পের যাত্রা শুরু হয়েছিল। ১৯৫৫ সালে ব্রিটিশ কোম্পানি রয়েল এনফিল্ড মাদ্রাজ মোটরসের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে চেন্নাইতে একটি সংযোজন কারখানা করে। ভারতীয় ব্র্যান্ড বাজাজ ১৯৪৪ সালে মোটরসাইকেল আমদানির ব্যবসা শুরু করে। পরবর্তীতে তারা দুই চাকার যানবাহন উৎপাদনকারী বড় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। টিভিএসের যৌথ উদ্যোগের কারখানা ছিল জাপানের সুজুকি মোটর করপোরেশনের সঙ্গে। তাদের যৌথ উদ্যোগ শুরু হয় ১৯৮২ সালে। ভারতের হিরো মোটোকর্প আগে সাইকেল উৎপাদন করত। ১৯৮৪ সালে জাপানের হোন্ডা মোটর করপোরেশনের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তারা মোটরসাইকেল উৎপাদন শুরু করে। এখন হিরো, বাজাজ ও টিভিএস ভারতীয় মোটরসাইকেলের সুপরিচিত নাম। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে তারা বহু  দেশের রাস্তায় চলছে। সেই মতো বাংলাদেশেও মোটরসাইকেল বিপ্লবের সূচনা হয়েছে। এখন কেবল সেটিকে এগিয়ে নেওয়ার পালা। এই শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন গার্মেন্ট শিল্পের মতো এ শিল্পেও বিশ্ববাজারে স্থান দখল করতে পারবে বাংলাদেশ। সরকারের নীতিগত সহায়তা পেলে প্রযুক্তিনির্ভর এই শিল্প সত্যিকার বিপ্লব হয়ে উঠতে পারে।

বাংলাদেশে জাপানের সুপরিচিত ব্র্যান্ড ইয়ামাহার  মোটরসাইকেল সংযোজন কারখানা করেছে এসিআই মোটরস। শুধু সংযোজন নয়, একই কারখানায় ইয়ামাহা ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল উৎপাদনও শুরু করেছে তারা। এসিআই কারখানাটি করেছে গাজীপুরের শ্রীপুরে। কারখানাটি করতে এসিআইকে কারিগরি সহায়তাও দিচ্ছে ইয়ামাহা। ২০১৬ সালে এসিআই ইয়ামাহার পরিবেশক হিসেবে দায়িত্ব পায়।

দেশের মোটরসাইকেলের আরেকটি বড় ব্র্যান্ড বাজাজের  মোটরসাইকেলের। বাংলাদেশে এই ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল বাজারজাত করে উত্তরা মটরস লিমিটেড। এখন দেশেই বাজাজের মোটরসাইকেল উৎপাদন হচ্ছে। ২০১৮ সালের মাঝামাঝিতে উত্তরা মটরস সাভারের জিরানিতে তাদের নতুন কারখানায় মোটরসাইকেল উৎপাদন শুরু করে।

এ ছাড়া দেশে টিভিএস ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল উৎপাদন করছে টিভিএস অটো বাংলাদেশ লিমিটেড। তাদের কারখানা গাজীপুরের টঙ্গীতে।

দেশীয় বাজারে দীর্ঘদিন ধরে বাজারজাত করছে যমুনা গ্রুপের উৎপাদিত পেগাসাস ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল। পুরোপুরি দেশে উৎপাদিত মোটরসাইকেল শিল্পে অন্যতম প্রতিষ্ঠান হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সাশ্রয়ী দামে ভালো মানের মোটরসাইকেল যমুনা ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড অটোমোবাইলস লিমিটেড গাজীপুরের নিজস্ব কারখানায় পেগাসাস মোটরসাইকেলের উৎপাদন শুরু করে।  বিশ্ব মানের অত্যাধুনিক প্রযুক্তির পেগাসাস মোটরসাইকেল বাজারজাত করে।

ভারতের মোটরসাইকেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হিরো ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেলও বাংলাদেশে জনপ্রিয়। এ দেশে হিরো ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল বাজারজাত করে নিলয় মোটরস।

জাপানের হোন্ডা মোটর করপোরেশন বাংলাদেশে মোটরসাইকেল উৎপাদন শুরুর পর এ দেশে তাদের ব্যবসা দ্রুত বাড়ছে।  হোন্ডা কারখানাটি করেছে বাংলাদেশ প্রকৌশল শিল্প সংস্থার (বিএসইসি) সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে।

সরকারি উদ্যোগ আর পৃষ্ঠপোষকতা এই শিল্পকে নিয়ে যেতে পারে সাফল্যের শীর্ষে।  এর সঙ্গে জড়িতদের প্রত্যাশা এমনই।

বিডি প্রতিদিন/জুনাইদ আহমেদ

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর