বুধবার, ৯ এপ্রিল, ২০১৪ ০০:০০ টা
শিক্ষাঙ্গন

আমার বাবা ফজলুল হালিম চৌধুরী

অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম

আমার বাবা ফজলুল হালিম চৌধুরী

তথ্য কমিশনার হওয়ার সুবাদে প্রায়ই জনপ্রিয় সাংবাদিকদের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হই। এসব অনুষ্ঠানে সাংবাদিক ও বিভিন্ন পেশাজীবীর সিংহভাগই গ্র্যাজুয়েট করেছেন বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকাকালীন। ফলে তাদের সঙ্গে আমার প্রায়ই '৭৫-পরবর্তী ছাত্র আন্দোলন, সন্ত্রাস এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিবেশ নিয়ে বর্তমানের অশান্ত ছাত্ররাজনীতি, সন্ত্রাস ইত্যাদি বিষয়ের তুলনামূলক আলোচনা হয়। বাংলাদেশ প্রতিদিন-এর সম্পাদক নঈম নিজাম আমার প্রয়াত পিতা অধ্যাপক ফজলুল হালিম চৌধুরীর একজন বিশেষ অনুরাগী। তার অনুরোধে আমার বাবার ১৮তম মৃত্যুবার্ষিকীতে এই লেখার প্রয়াস। ১৯৭৬-৮৩ সাল পর্যন্ত সাত বছরের বেশি সময় অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে বাবা উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৩ এর ফেব্রুয়ারিতে ছাত্ররা এরশাদ সরকারের মজিদ খানের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে উত্তাল হয়। ১৯৮৩ এর ১৪ ফেব্রুয়ারিতে স্বৈরাচারী সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন ও বিভিন্ন হলে আকস্মিক ছাত্রদের ওপর অত্যন্ত নগ্নভাবে হামলা চালায় এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কোনো রকম যোগাযোগ না করে অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়। এরশাদ সরকারের পুলিশ কর্তৃক ছাত্রদের ওপর নির্যাতন বাবার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি। বাবার যুক্তি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং যে কোনো ধরনের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতীত প্রবেশ করতে পারে না। ফলে প্রায় ঘটনার পরপরই তিনি পদত্যাগ করেন এবং সরকারের উচ্চ মহলের চাপ সত্ত্বেও রাষ্ট্রদূতের পদ গ্রহণ না করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত রসায়ন বিভাগে ফিরে যান। আজ আমাকে যখন একজন সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক ইস্যুতে বক্তব্য রাখতে আমন্ত্রণ করা হয় তখন সাধারণত বাবা এবং তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু যেমন- ড. সালাহ্উদদীন আহমদ, ড. জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, প্রয়াত মোশারফ হোসেন চাচার শিক্ষা-দীক্ষায় দীক্ষিত হয়েই তাদের বিষয়ভিত্তিক, ধর্মনিরপেক্ষ মতামতগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করি। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের রাজনীতি বিভিন্ন সংকটে অবতীর্ণ হয়েছে। বিশেষ করে গত দুই দশকে লক্ষ্যণীয় যে, বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংঘর্ষিক ছাত্ররাজনীতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বাবা এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেন, তৎকালীন ('৭৬-'৮৩) সময়ে সন্ত্রাসীদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করার জন্য সরকারকে কোনো গোলাগুলি করতে হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনকে সন্ত্রাসমুক্ত করা হবে বলে কর্তৃপক্ষ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ এ ধরনের আভাস পেলেই সন্ত্রাসীরা ক্যাম্পাস ছেড়ে যেত। কিন্তু বর্তমানে গত প্রায় দুই দশকে কেবল আমরা রূপক অর্থে সন্ত্রাসী ছাত্রদের বহিষ্কার হতে দেখি। পরবর্তীতে কোনো সরকারকেই সন্ত্রাসী ছাত্রদের বিরুদ্ধে তেমন উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখি না। ১৯৭৩-এর ড়ৎফবৎ এ স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বহিষ্কার ব্যতীত কিছু করতে সক্ষম নয়। তবে প্রশ্ন সক্ষমতা থাকলে দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে গিয়ে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন সন্ত্রাস দমনে কতটুকু নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখতে পারবে? এ প্রসঙ্গে বাবার মতামত ছিল আমাদের রাজনীতিবিদরা যদি আন্তরিক হন ও বিশ্ববিদ্যালয়কে সন্ত্রাসমুক্ত করতে চায়, যা অবশ্যই বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে করা উচিত- তাহলে তাদের ছাত্রদের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে অবিলম্বে ছাত্র অঙ্গ দল বাতিল করতে হবে। এ প্রেক্ষিতে সুশীল সমাজের অনেকেই বর্তমানে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের ব্যাপারে মতামত দিচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে বাবার মতামত- 'কেউ কেউ বলেন যে, ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করে দিলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আইন অথবা হুকুম দিয়ে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা সম্ভব নয়। ছাত্ররা অবশ্যই রাজনীতিসচেতন হবে। যেহেতু তারা আদর্শবাদী আবেগপ্রবণ, সেহেতু তারা অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে এটাও স্বাভাবিক।' বরং ছাত্ররাজনীতি বন্ধ না করে তিনি ছাত্র নিয়ে রাজনীতি বন্ধের পক্ষে ছিলেন। তার বক্তব্য ছিল রাজনীতিবিদদের ক্রীড়নক হিসেবে ছাত্রদের ব্যবহার না করে ছাত্রদের ছাত্র হিসেবে থাকতে দিতে। ছাত্ররা কী ধরনের সংগঠন করবে, তাদের কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য কী ধরনের উদ্যোগ তারা নেবে, সংগঠনের কর্মকর্তা কারা হবে, ছাত্রসংসদ নির্বাচনে কাদেরকে মনোনয়ন দেওয়া হবে ইত্যাদি সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া কেবল ছাত্রদেরই দায়িত্ব হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি ভাষা আন্দোলনের উদাহরণ দিয়ে উল্লেখ করেন যে, ভাষা আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক দলের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ আন্দোলনের অংশ নিয়েছিল। তিনি স্মৃতিচারণায় বলেন, 'তখনকার দিনে সাধারণ ছাত্ররা তাদের কর্মকাণ্ডে বাইরের হস্তক্ষেপ বরদাস্ত করত না।' সে সময় (১৯৭৬-৮৩) ক্যাম্পাসে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের আনাগোনা ছিল। ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে দলাদলি অস্থিরতা বিদ্যমান ছিল কিন্তু যখন তখন স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের ব্যবহার ছিল না বললেই চলে। সে সময় যখনই কোনো সংঘর্ষের আলামত পাওয়া যেত তখনই তিনি বিবদমান পক্ষগুলোকে ডেকে সংঘর্ষের কারণ দূর করার চেষ্টা করতেন। এ লক্ষ্যে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ডাকসু, বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ও সাধারণ ছাত্রদের অকুণ্ঠ সমর্থন-সহযোগিতা নিতেন। তিনি শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসকে পর্যবেক্ষণ করেছেন ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ও আধিপত্য বিস্তারের অস্ত্র হিসেবে। তার মতামত ছিল শিক্ষাঙ্গনকে সন্ত্রাসমুক্ত করতে হলে অবশ্যই বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে রাজনীতিবিদদের ছাত্রদের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে এবং ছাত্র অঙ্গ দল নয়, নিরপেক্ষভাবে তাদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। বর্তমানে অনেক সমস্যার মধ্যে ভয়াবহ সমস্যা হলো সন্ত্রাস। উল্লেখ্য, বেশ কিছুসংখ্যক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের সন্ত্রাসী কর্মতৎপরতার জন্য সেশন জটে পড়েছে। নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শিক্ষা ও শিক্ষকদের গবেষণা কার্যক্রমে। সন্ত্রাস কোনো একাডেমিক ক্যালেন্ডার মেনে চলে না। সন্ত্রাসী ঘটনাবলীর ফাঁকে ফাঁকে যে সময় পাওয়া যায় এবং সে সময়ের মধ্যে একাডেমিক কাজকর্ম যতটা চালিয়ে নেওয়া যায় সেটাই শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ক্যালেন্ডার হয়ে যায়। সন্ত্রাস দমনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়মিত ছাত্রসংসদ সদস্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে সুস্থ নেতৃত্বের বিকাশ ঘটাতে হবে। তাই বাবার কথায় শেষ করতে চাই- যদি সত্যিকার অর্থে সরকার এ ব্যাপারে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে এবং দলমত নির্বিশেষে প্রকৃত সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে, তাহলে কেবলই শিক্ষাঙ্গন সন্ত্রাসমুক্ত হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। আর যেন ছাত্রদের লাশ হয়ে বাড়ি ফিরতে না হয়। এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের নজির আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ে খুঁজে পাওয়া যাবে না।

লেখক : অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও তথ্য কমিশনার (প্রেষণে)।

 

সর্বশেষ খবর