মঙ্গলবার, ১৮ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

একদিন চলে যেতে হবে অন্ধকার কবরঘরে

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

একদিন চলে যেতে হবে অন্ধকার কবরঘরে

আদরের স্বজন-প্রিয়জন— সব ছেড়ে একদিন আমাদের চলে যেতে হবে অন্ধকার কবরঘরে। সেখানে থাকতে হবে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। হজরত ইসরাফিল (আ.)-এর শিঙ্গায় ফুৎকারের মাধ্যমে কিয়ামতের শুরু হবে। তখন কবর থেকে প্রতিটি মানুষকে ওঠানো হবে হাশরের ময়দানে। পবিত্র কোরআনে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে : ‘কিয়ামতের দিন কবর থেকেই সবার পুনরুত্থান হবে।’ (সূরা আদিয়াত : ৯)। অন্য আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তাদের সামনে রয়েছে বরজখ তথা কবরের জীবন। যা স্থায়ী হবে পুনরুত্থিত করা পর্যন্ত।’ (সূরা মুমিনুন : ১০০)।

কবর আখিরাতের প্রথম মনজিল। বলতে পারি পয়লা স্টেশনও। যে ব্যক্তি কবরের পরীক্ষা থেকে বেঁচে যাবে সে বাকি স্টেশনগুলোয়ও নিরাপদ থাকবে। এজন্যই হজরত উসমান (রা.) কবর দেখলে খুব বেশি করে কাঁদতেন। তার সঙ্গীরা জিজ্ঞাসা করতেন, ‘আপনি জাহান্নামের আলোচনা শুনেও এত কাঁদেন না। কিন্তু কবর দেখে এভাবে কাঁদেন কেন?’ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে হজরত উসমান (রা.) বলেন, ‘আমার বন্ধুরা! আমি রসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, কবর জান্নাতের একটি টুকরো কিংবা জাহান্নামের একটি অংশ। এ কবর আখিরাতের প্রথম ঘাঁটি। যে এখানে নিরাপদ থাকবে সে প্রকৃত অর্থেই সৌভাগ্যবান। আর যে কবরের ফিতনায় পড়ে গেল, কবরের প্রশ্নোত্তর দিতে পারবে না সে তো চির হতভাগ্যদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।’ অনেকক্ষণ চুপ থেকে তিনি আবার বললেন, ‘সঙ্গীরা! আমি রসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, “পৃথিবী ও পৃথিবীর বাইরে যত ভয়াবহ দৃশ্য আমাকে দেখানো হয়েছে, কবর হলো তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ স্থান।” তাই কবর দেখলে নিজেকে আর উসমান স্থির রাখতে পারে না।’ (তিরমিজি)।

এ কবরে আমাদের সবাইকে যেতে হবে।

দুনিয়ার যত জৌলুস-খ্যাতি, আত্মীয়-পরিজন সবকিছু রয়ে যাবে দুনিয়ায়, কবরঘরে একাই আমাকে আপনাকে থাকতে হবে। কত চমৎকার বলেছেন কবি : ‘পৃথিবী আমার আসল ঠিকানা নয়/মরণ একদিন মুছে দেবে সব রঙিন পরিচয়।’ যখন মানুষকে সাদা কাফনে জড়িয়ে কবরমাঝে রেখে আসবে তার স্বজনরা, তখন তার আমল ছাড়া কেউ তাকে সঙ্গ দেবে না। হাদিসে এসেছে, এ সময় নেককার মানুষের ভালো আমল একটি ফুটফুটে শিশুর সুরতে তার কাছে আসবে। বলবে, আমি তোমার একাকীর সঙ্গী। তার কবরকে নূরে নূরান্বিত করা হবে তখন। তাকে জান্নাতের পোশাক পরিয়ে দেওয়া হবে। জান্নাতের সঙ্গে তার কবরের একটি যোগাযোগ তৈরি করে দেওয়া হবে। যার মাধ্যমে জান্নাতের  সুখ-শান্তি সে উপভোগ করবে অনায়াসেই। বাইরে থেকে মানুষ দেখবে এটি একটি সাধারণ কবর। অজপাড়াগাঁয়ের পুরনো বাঁশঝাড়ের নিচে কিংবা আজিমপুর গোরস্থানের একটি সাদামাটা কবর। জিয়ারত করার মতোও কেউ নেই। অথচ এ কবরটিই কিনা জান্নাতের টুকরো। এ কবরবাসীর সঙ্গী আর কেউ নয়, স্বয়ং আল্লাহ।

হাদিসের দ্বিতীয়াংশে বলা হয়েছে, মানুষটি যদি বদ আমলকারী হয়, তবে তার সব খারাপ কাজ একজন কুিসত বৃদ্ধের আকৃতি ধারণ করবে। বৃদ্ধ, তারপর আবার কুিসত স্বাভাবিকভাবেই অরুচি আসবে লোকটির ওপর। বদকার কবরবাসী বলবে, কে তুমি? বৃদ্ধ বলবে, আমি তোমার বদ আমল। সারা জীবন মানুষের ক্ষতি করেছ, জনগণের অর্থ আত্মসাৎ করেছ, পরনারী স্পর্শ করেছ, সুদ-ঘুষে নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছ, জ্ঞানীদের অসম্মানী করেছে; এমনি হাজারো অপরাধ আজ তোমার সামনে দাঁড়ানো বৃদ্ধের বেশে। আমি দীর্ঘ সময় তোমার সঙ্গী হব। সঙ্গে সঙ্গে ফেরেশতারা তার কবরকে দুই দিক থেকে চেপে ধরবে। এমন চাপ দেবে যে মানুষটি পিষে যাবে। তাকে তখন জাহান্নামের পোশাক পরানো হবে। আগুনের তোশক-বালিশের ওপর তাকে শুইয়ে দিয়ে কখনো সাপ আবার কখনো বেদম প্রহারের মাধ্যমে কিয়ামত পর্যন্ত তাকে শাস্তি দিতে থাকবে। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে কবরটি কত দামি। আজিমপুর গোরস্থানে জায়গা কিনে কবর দেওয়া হয়েছে। লোকটি অনেক বড় লোক ছিল।

সাধারণ মানুষের কাছে ছিল নেক লোক। অথচ কত গোপন অপরাধ যে সে করত তা শুধু আল্লাহতায়ালাই ভালো জানেন। যখন মৃত্যু এসে যাবে তার সব পাপের কথা তাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হবে। এভাবেই কবরে সে শাস্তি পেতে থাকবে লম্বা সময় ধরে।

কবরে মুনকার-নকির নামে দুই ফেরেশতা এসে মৃত ব্যক্তিকে প্রশ্ন করবে। তোমার রব (প্রতিপালক) কে? তোমার দীন (জীবনব্যবস্থা) কী? হজরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে তুমি কী জানো? যারা নিজেদের জীবনে আল্লাহকে রব, ইসলামকে দীন এবং মুহাম্মদ (সা.)-কে আদর্শ মেনে চলেছে তারাই কেবল কবরে সঠিক জবাব দিতে পারবে। তাদের জন্য জান্নাতের পথ উন্মুক্ত হয়ে যাবে তখন। আর যারা মুনকার-নকিরের প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে পারবে না, তাদের জন্য জাহান্নামের আজাব শুরু হয়ে যাবে তখনই।

হে আল্লাহ! কবরের আজাব থেকে আপনার কাছে পানাহ চাই। আমাদের বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন যারা কবরবাসী হয়েছেন তাদের আপনি দয়া করে ক্ষমা করে দিন। তাদের কবরকে জান্নাতের টুকরা বানিয়ে দিন।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর