বুধবার, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে হেরে যেতে দেখেছি

ফাতিমা পারভীন

মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে হেরে যেতে দেখেছি

নিজ পরিবারের কারও ক্যান্সার না হলে বুঝতে পারতাম না সার্জারি-পরবর্তী চিকিৎসা বা ওই রোগীর বেঁচে থাকার জন্য কেমোথেরাপি কতটা জরুরি। একবার ক্যান্সার হলে কত দ্রুত তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মূলত ক্যান্সারের কোষগুলো কোষের একটি গোটা বা পি- তৈরি না করা পর্যন্ত বিভাজিত হতেই থাকে। ক্যান্সার কোষের ওই পি-কে টিউমার বলে। যেহেতু ক্যান্সার কোষগুলো প্রতিনিয়ত বিভাজিত হয়, তার জন্য কেমোথেরাপির ওষুধ দ্বারা সেগুলো প্রভাবিত হওয়ার সর্বোচ্চ সম্ভাবনা রয়েছে বলেই সার্জারি-পরবর্তী চিকিৎসায় কেমো ব্যবহৃত হয়। ক্যান্সার শুধু দুরারোগ্য ব্যাধি নয়, অনেকের কাছে এটি আতঙ্কের ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক রোগীকে ডাক্তার পরীক্ষা করতে বললেই রোগী ও তাদের পরিবার মারাত্মক আতঙ্কের মধ্যে পড়ে যায়। ঘুম হারাম হয়ে যায় ক্যান্সার টেস্টের কথা শুনে। অন্যদিকে কিছু ডাক্তার এমনভাবে ক্যান্সারের কথা বলেন যে, তাতে আতঙ্কিত না হয়ে উপায় থাকে না। আবার কারও কারও রয়েছে নিজস্ব প্রাইভেট ক্লিনিক যারা রোগীদের মানসিক বিপর্যয়ের সুযোগ নিয়ে নানা অজুহাতে অনেকের কাছ থেকেই টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেয়। পরিবারের কেউ কেউ রোগীর কাছ থেকে দূরে থাকে, অথচ পরীক্ষা মানেই ক্যান্সার নয়; ক্যান্সার আছে কিনা তা নিশ্চিত হতে হলে পরীক্ষা করাতেই হবে। ক্যান্সার কোনো ছোঁয়াচে ব্যাধি নয়। ওই ব্যাধিটি যাকে আক্রান্ত করেছে শুধু তার একার। আর একবার আক্রান্ত হয়ে গেলে তা নিরাময় করা কঠিন, অনেকটাই বন্দুকের বের হয়ে যাওয়া গুলির মতো। তবে শুরুতেই ক্যান্সার ধরা পড়লে উপযুক্ত চিকিৎসায় আরোগ্য লাভ করা যায়। এ ক্ষেত্রে ভয় নয়, প্রয়োজন একটু সতর্কতা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী জনসংখ্যা অনুপাতে বাংলাদেশে সব ধরনের সুবিধাসহ ১৬০টি ক্যান্সার চিকিৎসা কেন্দ্র থাকা জরুরি, আছে মাত্র ১৬টি। দেশে ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডাক্তার প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। অপ্রতুল রয়েছে অনকোলজির নার্স। জনবল ও যন্ত্রপাতির নানা সংকট যেন স্থায়ী সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে চিকিৎসা নিতে গিয়ে রোগীদের চরম বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়, চিকিৎসা বিঘিœত হয়। ঠিক যেমন বিলম্ব বিচার ন্যায়পরায়ণতায় বিঘ্ন ঘটায়। বিএসএমএমইউ হসপিটালে পরবর্তী চিকিৎসা কেমোথেরাপির জন্য আমার স্বামীকে ভর্তি করা হলে বাস্তবতার নিরিখে দাঁড়িয়ে মানুষের জীবনযুদ্ধ আমি দেখেছি, মূলত ক্যান্সার চিকিৎসায় অনেক যন্ত্রপাতি দরকার, পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি না থাকলেও বিএসএমএমইউতে আন্তরিকতার ঘাটতি নেই বললেই চলে। সরকারিভাবে দেশে ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য শয্যা আছে মাত্র ৫০০-এর মতো। বাংলাদেশে প্রতি বছর দেড় লাখ মানুষ ক্যান্সার আক্রান্ত হয়, প্রতিদিন ৫০ রোগী আক্রান্ত হচ্ছে। অর্থাৎ গড়ে প্রতি জেলায় প্রতিদিন একজন মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় অত্যাধুনিক কিছু যন্ত্রপাতি ও চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে, যা দেশের রোগী অনুপাতে নগণ্য। এসব চিকিৎসায় অতিরিক্ত বিল পরিশোধ করতে অপারগতা জানাতে হয় আক্রান্তদের। ফলে পরবর্তীতে ভাগ্যে আর চিকিৎসা জোটে না। মানুষ মৃত্যুর সময়ও বেঁচে থাকার জন্য একজন ডাক্তারের উপস্থিতি কামনা করে। বাস্তবতা কতটা ভয়ঙ্কর হলে সে চিকিৎসা উপেক্ষা করতে বাধ্য হয়। তবু আশার আলো হলো, বিএসএমএমইউতে প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা গত ১২ ডিসেম্বর লিনিয়ার এক্সেলেটর প্রতিস্থাপন করলেন, যা খুবই অত্যাধুনিক মেশিন। এ মেশিন দ্বারা ক্যান্সার র‌্যাডিয়েশন থেরাপি দেওয়া হয়। সীমিত হলেও আধুনিক লাইন্যাক মেশিনও আছে; যা রোগীদের জন্য আশীর্বাদ বয়ে এনেছে। ক্যান্সার চিকিৎসা ব্যয়বহুল। চিকিৎসার টাকা জোগাড়ের বিষয়টিই তাদের আরও সংকটের দিকে ঠেলে দেয়। চিকিৎসা ব্যয় তাদের পরিবারকেও একদম পঙ্গু করে দেয়। ফলে এ ব্যয় মানুষের সাধ্যের মধ্যে আনার উদ্যোগ নিতে হবে। এ দায় শুধু সরকারের নয়, আমাদের সবার। দেশে ধনাঢ্যের সংখ্যা কম নয়। আর্তমানবতার সেবায় সবাইকে এগিয়ে আসা উচিত। সরকারের উচিত উন্নয়ন তহবিল থেকে চিকিৎসা খাতে বিনিয়োগ আরও বাড়ানো। আর যাদের আর্থিক সংগতি নেই তাদের চিকিৎসা ফ্রি করে দেওয়া। বিএসএমএমইউতে আমার স্বামীকে কেমোথেরাপি দেওয়ার জন্য ভর্তি করতে হলো। একদিকে দুরারোগ্য ব্যাধির সঙ্গে লড়াই অন্যদিকে চিকিৎসা-সংক্রান্ত জটিলতা। তারই মধ্যে নজর কেড়েছে পাশের এক অসহায় পরিবারের ৩৫ বছরের একজন অসুস্থ রোগী। বাড়ি চাঁদপুর। ৮ জানুয়ারি ওই রোগীকে ভর্তি করা হয়। জানতে পারলাম তিনি প্রথম সাইকেল কেমোথেরাপির টাকা সংগ্রহ করতে বউয়ের নাকফুল পর্যন্ত বিক্রি করে দিয়েছেন কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সম্পূর্ণ কেমোথেরাপি অ্যাপ্লাই করতে পারেননি। সময়মতো উপযুক্ত চিকিৎসা ও পরবর্তী চিকিৎসা কেমোথেরাপির অভাবে আমার চোখের সামনে মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করতে করতেই মৃত্যুর কোলে তিনি ঢলে পড়লেন। এই প্রথম খুব কাছ থেকে মৃত্যুকে এভাবে দেখতে পেলাম। আবার চিকিৎসা না নেওয়ার নির্মমতা আমি দেখেছি। ডাক্তারের চেম্বারে বসে দেখেছি, টাকার অভাবে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনের হাতকে রোগী থামিয়ে দিচ্ছে। দেখেছি দিনের পর দিন ক্যান্সার যন্ত্রণায় ক্ষুধার সঙ্গে লড়াই করে হেরে যেতে।

চাঁদপুরনিবাসী ওই যুবকের মৃত্যুযন্ত্রণার ছটফটানি নীরবে একাকী দেখতে পাই, চোখ বন্ধ করলে এখনো দেখতে পাই। তার বিধবা বউয়ের করুণ আর্তনাদ আর এতিম হয়ে যাওয়া ছোট ছোট শিশুদের পিতৃহারা কান্না আমি দেখতে পাই। ওই বিধবা নারী ও এতিম শিশুদের আর্তনাদগুলো ছেঁড়া টুকরো স্বপ্ন ভেবে উড়িয়ে দিয়ে কিংবা হাত বাড়িয়ে সেদিনের সেই অতীতকে দুমড়ে-মুচড়ে ফেলে দিয়ে, ইচ্ছামতো খেয়ালখুশির ডানায় আজও ওড়াতে পারছি না।

লেখক : শিশু ও নারী অধিকার কর্মী।

 

সর্বশেষ খবর