‘বোমাটা ফেলার কী দরকার ছিল’- উক্তিটি জাপানি বাহিনীর হাতে বন্দী এক মার্কিন ডাক্তারের। তিনি ফিলিপাইনে মিত্রবাহিনীর মেরিন মেজর হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে বন্দী হন। স্মৃতিচারণায় তার এ উক্তিটি উল্লেখ করেছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত অধ্যাপক বিশ্বপ্রেমিক এডওয়ার্ড সয়ার। তিনি ১৯৪২ থেকে ’৪৬ সাল পর্যন্ত নৌবাহিনীর সার্জেন্ট ছিলেন। প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপ তিমুরে তিনি জাপানি বাহিনীর হাতে বন্দী হন। তার সঙ্গে আমেরিকান, অস্ট্রেলিয়ান, মালয়, চীনাসহ আরও কয়েকটি দেশের বন্দী ছিলেন। বন্দী হওয়ার পর তাদের জাপানে পাঠানো হয়। বন্দীদের দিয়ে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করিয়ে নেওয়া হতো। বন্দীশিবির থেকে ট্রাকে চাপিয়ে তাদের নিয়ে যাওয়া হতো কারখানায়, কয়লা খনিতে, জাহাজঘাটে মাল খালাস করতে; আবার কাউকে খেত-খামারে। এডওয়ার্ড সয়ারসহ আটজনকে নামিয়ে দেওয়া হয় ওতা নদীর মোহনায়, হাজার টনের জাহাজ থেকে চিনির বস্তা খালাস করতে। দুই দিন ধরে তারা নষ্ট হয়ে যাওয়া চিনির বস্তা খালাস করছেন। চারজন জাহাজের খোল থেকে বস্তা বাইরে এনে দেন। বাকি চারজন সেগুলো কাঁধে বয়ে নিয়ে গিয়ে গুদামজাত করেন। ৬ আগস্ট এডওয়ার্ড সয়ারসহ চারজনের পালা পড়ে লম্বা মই বেয়ে জাহাজের খোলে ঢুকে চিনির বস্তা বের করার। খোলের ভিতর ঢুকতেই চোখ ধাঁধানো ঝলকানিতে খোলের ভিতরটা আলোকিত হয়। জাহাজটি প্রচ- ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে। প্রচন্ড শব্দ করে কনক্রিটের পাড়ের সঙ্গে ঘষা খায়। বৃষ্টির মতো ঝুরঝুর করে জাহাজের মরচে পড়া লোহার কণা পড়তে থাকে তাদের গায়ে। খোলের ভিতর চিনির বস্তাগুলোর মধ্যে তারা আতঙ্কিত অবস্থায় পড়ে থাকেন। বাইরে তীব্র আওয়াজ, একটু পর পর বজ্রপাতের মতো শোনা যাচ্ছে। ধীরে ধীরে শব্দ স্তিমিত হয়ে আসে। এডওয়ার্ড সয়ার ওপর দিকে তাকিয়ে দেখলেন আকাশের রং নীলের পরিবর্তে ধূসর। জাহাজের উজানের দিকে তাকিয়ে দেখলেন হিরোশিমা শহরটি শ্মশানভূমিতে পরিণত হয়েছে। কিছুক্ষণ পর সার্জিক্যাল মুখোশ পরা এক লোক খোলের মুখে জাপানি ভাষায় বলে গেলেন, ‘নড়াচড়া কোরো না, যেখানে আছ সেখানেই থাকো। ভয়ঙ্কর অবস্থা চারদিকে। বহু লোক মারা গেছে।’ বলেই চলে গেলেন লোকটি। ঘণ্টাখানেক পর এক লোক ওপর থেকে প্লাস্টিকের চারটা মুখো ফেলে দিয়ে তাদের বাইরে আসতে বলল। বাইরে এসে দেখেন জাহাজের চিমনিটি কাত হয়ে পড়ে আছে একদিকে। চিনি গুদামের চাল উড়ে গেছে। জাহাজের কালো ঘড়িটা যখন থেমে যায় তখন সময় ছিল ৮টা ১৫। বেসামরিক প্রতিরক্ষা বিভাগের কর্মীরা উদ্ধারকাজ চালাচ্ছিলেন। অগ্নিদগ্ধ লাশগুলো সরাবার সময় দেহের চামড়া আলগা হয়ে যাচ্ছিল। মার্কিন ডাক্তার ঘটনাক্রমে বেঁচে গেছেন। বাকি তিনজনের সন্ধান পাওয়া গেল। সবাই মৃত। তারা উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়লেন। এই প্রথম জাপানিদের জন্য এডওয়ার্ড সয়ারের দুঃখ হলো। মনে মনে বললেন, কি ভয়ঙ্কর বিপদের সম্মুখীন হয়েছে লোকগুলো। ডাক্তার বললেন, এরা তো এমনিই হেরে গিয়েছিল। বোমাটা ফেলার কী দরকার ছিল! বোমাটা যে কীসের তা কিন্তু তারা জানতেন না। ওই দিন মার্কিন বি-২৯ বোমারু বিমান ১ হাজার ৯০০ ফুট ওপর থেকে হিরোশিমা শহরে ছুড়ে মারে ‘লিটল বয়’ নামের পারমাণবিক বোমাটি। মুহূর্তে শহরের দুই-তৃতীয়াংশ ধূলোর সঙ্গে মিশে যায়। সঙ্গে সঙ্গে মারা যায় প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষ। ৫৫ হাজার ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। হিরোশিমা শহর ছারখার করে দেওয়ার মাত্র পাঁচ দিন পর ১১ আগস্ট জাপানের ককুরা দ্বীপকে গুঁড়িয়ে দিতে মার্কিন বি-২৯ বোমারু বিমান পারমাণবিক বোমা ফ্যাটম্যানকে নিয়ে রওনা দেয়। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে সে সিদ্ধান্ত বাতিল করে ফ্যাটম্যানকে ফেলা হয় দেশটির নাগাসাকি শহরে। এত শহরটির অর্ধেক সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। মারা যায় ৭০ হাজার মানুষ।
পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের অনেক আগেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রধান হোতা জার্মানির নাজিবাহিনী বিপর্যস্ত এবং তারা আত্মসমর্পণ করে। জাপানও যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য প্রায় হারিয়ে ফেলেছে। এর পরও কেন মারণাস্ত্র নিক্ষেপ করল মানবজাতির ওপর? এ নিয়ে নানা প্রশ্ন, নানা গবেষণা ও গ্রন্থ রচনা হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, ১৯৪১ সালে জাপান মার্কিন নৌঘাঁটি পার্ল হারবারে আক্রমণ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণের জানান দেয়। এর প্রতিশোধ হিসেবে মার্কিন বাহিনী এ মারণাস্ত্র নিক্ষেপ করে জাপানের ওপর। এটা মূল ঘটনা নয়। মূল ঘটনা হলো, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও জোসেফ স্টালিন। তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট এইচ এস ট্রুম্যান স্টালিনকে বোঝাতে চেয়েছিলেন, অ্যাটম বোমার মতো মারণাস্ত্র আমেরিকার হাতে আছে। যুদ্ধ শেষে দুনিয়ার প্রভুত্ব অর্জন করতে যাচ্ছি আমরা। এতে যেন স্টালিন ভয় পেয়ে আমেরিকাকে সমীহ করে চলেন। আমেরিকার হাতে যে অ্যাটম এসে গেছে সে খবর পাবেন স্টালিন হিরোশিমার দিকে তাকিয়ে। জার্মানির ভয়ে আমেরিকা পারমাণবিক অ্যাটম বোমা বানানো এবং বিস্ফোরণ ঘটানোর পর বিজ্ঞানী হাইজেনবার্গ একটি মন্তব্য করেন। বলেন, ‘গণতান্ত্রিক পরিবেশে আমেরিকা, ব্রিটেনের বিজ্ঞানীরা ইচ্ছা করলে অ্যাটম বোমা বানানোর প্রকল্পে কাজ নাও করতে পারতেন। কিন্তু তারা সে পথে হাঁটেননি। অথচ স্বৈরতন্ত্রী নাজি বাহিনীর অধীনে থেকেও জার্মান বিজ্ঞানীরা ঘৃণ্য মারণাস্ত্র প্রভুদের হাতে তুলে দেননি। মিত্রশক্তির বিজ্ঞানীরা বিবেকহীন। জার্মান বিজ্ঞানীরা বিবেকবান।’ আমেরিকার সামরিক সক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৪৯ সালে পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটায়। এরপর ব্রিটেন ১৯৫২ সালে, ফ্রান্স ১৯৬০ সালে ও চীন ১৯৬৪ সালে পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটায় এবং তারা সবাই সফল হয়। পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনকারী দেশগুলোর মধ্যে যে মজুদ রয়েছে তা দিয়ে এ পৃথিবীকে ৭০০বার সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিতে পারে। কি ভয়ঙ্কর কথা! উল্লিখিত পাঁচ দেশ ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান ও উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে।
শোনা যায় ইসরায়েল, ইরান এ পথে অনেক দূর এগিয়েছে। পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশগুলো নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি করেছিল, তারা আর পারমাণবিক উৎপাদন বা বিস্ফোরণ ঘটাবে না। সে চুক্তি ২০২১ সালে শেষ হবে। এ চুক্তি নবায়নের ব্যাপারে চীন আগেভাগে বলে দিয়েছে তারা এ চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসবে। তাহলে আমেরিকা ও রাশিয়ার মতো চীন বিশাল পারমাণবিক অস্ত্রের ভা-ার গড়ে তুলবে? এটা যদি হয় তাহলে এশিয়ার জন্য হবে ভীতিকর! মানুষ শান্তিময় বিশ্ব কামনা করে। তারা পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত পৃথিবী চায়। মানুষ চায় না আর হিরোশিমা ও নাগাসাকির মতো পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ।
লেখক : সাংবাদিক।