শুক্রবার, ২৮ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

‘তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম’

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান

‘তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম’

শোকের মাস আগস্ট প্রায় শেষ হতে চলেছে। শোকাবহ এ মাসটি অন্য রকম এক বিষণœতায় মূর্ত থাকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আমরা হারাই আমাদের জাতির পিতাকে। সেদিন নিষ্ঠুর ঘাতকেরা বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব ও শিশু পুত্র রাসেলসহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের প্রায় সবাইকে হত্যা করেছে। বঙ্গবন্ধুর দুই আদরের কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা প্রবাসে থাকায় অলৌকিকভাবে আল্লাহর অশেষ রহমতে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যান।

এ শোকাবহ মাসেই যুক্ত রয়েছে আমাদের পারিবারিক আরও একটি কান্না ও কষ্ট। ২০১২ সালের শোকাবহ এ আগস্টের ২৮ তারিখে আমার পিতা সাবেক গণপরিষদ সদস্য ডা. আখ্লাকুল হোসাইন আহমেদ ইন্তেকাল করেন। আমার আব্বা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একজন একান্ত অনুসারী ও সহকর্মী। আজ  কিছুু কথার গুচ্ছে প্রয়াত প্রিয় বাবাকে স্মরণ করছি।

আজ আমার বাবার অষ্টম মৃত্যুবার্ষিকী। বাবাকে নিয়ে আমার কত স্মৃৃতি! তাঁর নীতি-বৈশিষ্ট্য কখনো বিস্মৃত হইনি। এসবই আমাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। তিনি ছিলেন অত্যন্ত দৃঢ়চেতা, নৈতিক ও বিনয়ী স্বভাবের একজন মানুষ। কর্তব্যকাজে কখনো অবহেলা করতেন না। দেখেছি রাজনৈতিক বিশ্বাসে বাবা ছিলেন সদা অটল ও আপসহীন; যা বিশ্বাস করতেন তা-ই তাঁকে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও এগিয়ে নিয়েছে নির্মোহভাবে।

১৫ আগস্ট, ’৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের নির্মম খবরটি সকালে রেডিওতে প্রচারিত হলে নেত্রকোনার গ্রামীণ শহর মোহনগঞ্জ উপজেলা সদরে তাঁর (ডা. আখ্লাকুল হোসাইন আহমেদের) নেতৃত্বে স্থানীয় নেতা-কর্মীদের নিয়ে প্রতিবাদ মিছিল ও পরে গায়েবানা জানাজার ব্যবস্থা করা হয়। এটি বঙ্গবন্ধুর প্রতি আমার বাবার অকপট আনুগত্য, শ্রদ্ধা, দৃঢ় চেতনা ও রাজনৈতিক বিশ্বাসে অটল থাকার মানসিকতার দৃশ্যমান প্রতিফলন। আমি নিশ্চিত, প্রতিকূল অবস্থায় এ ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করার কী পরিণতি হতে পারে তা সেদিন আমার বাবা ও তাঁর সহকর্মীরা আদৌ ভাবেননি। এরূপ কর্মসূচি পালনের কারণেই ১৯৭৬ সালের গোড়ায় আমার বাবাকে স্থানীয় সেনা ক্যাম্পে নিয়ে আটক করা হয়। বাসায় থাকা এবং মোহনগঞ্জ না ছাড়ার শর্তে ডাক্তার আখ্লাকুল হোসাইন আহমেদকে সেদিন সন্ধ্যায় সেনা ক্যাম্প থেকে ছেড়ে বাসায় গৃহবন্দী অবস্থায় রাখা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ, বারহাট্টা, কলমাকান্দা ও সুনামগঞ্জের প্রতিরোধযোদ্ধারা এ বিষয়টি জানেন। বাবার সেদিনের ওই সাহসী কর্মসূচি তাঁকে কেবল মানবিক করেনি, সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডে তিনি কতটা আঘাত পেয়েছিলেন তাও উঠে আসে।

বাবা ছিলেন নিজের কর্তব্যবোধে সচেতন। একই সঙ্গে তাঁর সন্তানদেরও নিজ নিজ কর্তব্যকাজে সদা নিবিষ্ট হতে প্রেরণা দিতেন। দেশ ও জনকল্যাণে নিঃস্বার্থভাবে নিবেদিত হতে উৎসাহিত করতেন। তিনি ছিলেন এলাকার সব শিক্ষার্থীর একজন অভিভাবক। দীর্ঘদিন এলাকার অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের প্রায়ই উপদেশ দিতেন সবার প্রতি সুআচরণের। তিনি বলতেন কোনো শিক্ষার্থীর মনোজগৎ যেন শিক্ষকের কোনো অনাকাক্সিক্ষত আচরণ দ্বারা প্রভাবিত না হয়। একজন শিক্ষার্থীর প্রতি কেবল সুআচরণই সুফল বয়ে আনতে পারে।

আমি দেখেছি, বাবা নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন। তাঁর ডায়েরির সংখ্যা অনেক। তিনি ডায়েরিতে নিজের ভাবনার কথা লিখতেন। আবার দৈনিক পত্রিকাগুলোয় আকর্ষণীয় বা শিক্ষণীয় কোনো খবর বা তথ্য থাকলে তাও গেঁথে রাখতেন তাঁর রোজনামচায়। দেখেছি তাঁর দলের নেত্রী বা নেতাদের অনেক বক্তব্যও ডায়েরিতে স্থান পেয়েছে। কদিন আগে আব্বার এসব ডায়েরিতে চোখ বুলাচ্ছিলাম। ১৯৯১ সালের এমনই একটি ডায়েরির পাতা উল্টে দেখতে পাই তিনি লিখেছেন-

‘মানুষের সন্তান কিন্তু মানুষ হয়ে জন্মায় না, সে মানুষ হওয়ার সম্ভাবনা বা বীজ নিয়ে জন্মায় মাত্র, কিন্তু শিক্ষাই মানুষের সন্তানকে মানুষ করে গড়ে তোলে। সন্তানকে মানুষ করে গড়ে তুলতে না পারলে অন্য সবকিছুই প্রকৃতপক্ষে অর্থহীন।’ তিনি আরও লিখেছেন- ‘শিক্ষকদের বলা হয় শিক্ষার্থীদের দ্বিতীয় পিতা। জন্মদাতা পিতা সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখায়। আর শিক্ষক দেখায় জ্ঞানের আলো। যে পিতা তার সন্তানকে রেখে আহার করে, সে পিতা নামের অযোগ্য, সেই রকম যে শিক্ষক তার ছাত্রদের জ্ঞানের আলো থেকে বঞ্চিত রেখে নিজের স্বার্থ উদ্ধার করে সে শিক্ষকও শিক্ষকতা পেশার উপযুক্ত নয়।’

আব্বার ডায়েরিতে খুঁজে পাওয়া এ লেখাগুলো তাঁর নিজের ভাবনাপ্রসূত কিনা জানি না। লেখাটির নিচে সূত্র উল্লেখ নেই। তাই হতে পারে এটি তাঁর নিজের ভাবনাপ্রসূত শব্দগুচ্ছ। আবার অন্য কোনো উৎস থেকেও এ লেখাটি নিজ ডায়েরিতে উদ্ধৃত করে থাকতে পারেন। তবে নিজের ডায়েরিতে এ লেখাটিকে বন্দী করে বাবা তাঁর এক মুক্ত ও সঠিক চিন্তা ও মানসিকতায় নিজেকে উদ্ভাসিত করেছেন।

আমি দেখেছি, পরীক্ষায় আমাদের ভালো ফললাভে বাবা আনন্দিত হতেন। একইভাবে এলাকার অন্য ছাত্রের ভালো ফললাভেও তিনি আনন্দ পেতেন। তাঁর দৃষ্টিতে সব ছাত্রছাত্রীই তাঁর সন্তানতুল্য। স্থানীয়ভাবে কোনো শিক্ষার্থী পরীক্ষায় ভালো ফল করলে তিনি সব সময়ই তাকে উৎসাহ দিতেন। কখনো প্রাইজবন্ড, কখনো কলম বা কখনো বই উপহার দিয়ে। এভাবে এমন স্বীকৃতি পাওয়া ছাত্রের সংখ্যা বেড়ে গেলেও বাবা এ রীতিটা  বহাল রেখেছিলেন।

কর্তব্যকাজে তিনি ছিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাবা ছিলেন ১১ নম্বর সেক্টরের সাবসেক্টর মহেশখলা ইয়ুথ ক্যাম্পের ইনচার্জ। নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ জেলার বহু মুক্তিযোদ্ধা এ ক্যাম্পের মাধ্যমে ভারতে প্রবেশ করে ট্রেনিং নিয়েছিলেন। তাঁদের কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধকালীন আমার বাবার কর্তব্যনিষ্ঠা ও মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে তাঁর সাহস ও অক্লান্ত পরিশ্রমের গল্প আজও শোনা যায়।

আব্বা ২০১২ সালের ২৮ আগস্ট বেলা ১০টা ৩০ বা ৩৫ মিনিটের সময় ইন্তেকাল করেন। আমি তখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এর বিচারক। সকাল ১০টায় লক্ষ্য করি আব্বার শরীরটা বেশ খারাপ, শ¡াসকষ্ট হচ্ছে, বুকে বেশ কফ জমেছে। এ অবস্থায় তাঁকে আমি কিছু ওষুধ দিই। খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি মামলার বিচারকার্য চলছিল তখন আমাদের ট্রাইব্যুনালে। ছোট ভাই সোহেলকে বলি একটি অ্যাম্বুলেন্স ডেকে আব্বাকে যেন হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে নিয়ে যায় সাকশান দেওয়ার জন্য। আব্বার কাছে জানতে চাইলাম আমি কোর্টে যাব কিনা। অস্পষ্ট কণ্ঠে বাবা জানতে চেয়েছিলেন সেদিন ট্রাইব্যুনালে কোনো মামলার শুনানি ছিল কিনা। আমি হ্যাঁ সূচক জবাব দিলে তিনি আমাকে কোর্টে যেতে বলেছিলেন। আমি কোর্টে যাই। এজলাসে বসার ৫-৭ মিনিটের মধ্যেই খবর আসে আব্বার অবস্থা খুব খারাপ। আমি যেন সরাসরি হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে যাই। বিষণ্ন মনে কোর্ট থেকে নেমে পড়ি। হাসপাতালে যাই। কিন্তু আব্বাকে আর জীবিত অবস্থায় পাইনি। ততক্ষণে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেছেন। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। শোকাচ্ছন্ন হই সবাই। আমার স্ত্রী, ছোট ভাই সাজ্জাদসহ সবাই চলে আসে। লাশের গোসল শেষে আসরের পর কাকরাইলের সার্কিট হাউস মসজিদে প্রথম নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। তৎকালীন মাননীয় স্পিকার বর্তমানে বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি জনাব আবদুল হামিদের ঐকান্তিক ইচ্ছায় বাদ আসর (মাগরিবের আগে) সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় আব্বার দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। ২৯ আগস্ট লাশ তাঁর জন্মস্থান মোহনগঞ্জে নেওয়া হয়। পথিমধ্যে নেত্রকোনা জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে তৃতীয় জানাজা এবং মোহনগঞ্জ পাইলট হাইস্কুলে চতুর্থ জানাজা শেষে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে মোহনগঞ্জ গোরস্থানে সমাহিত করা হয়।

‘জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে?’ কবির এ চরণ দুটি প্রত্যেক মানুষের জীবনের এক কঠিন সত্য। মানুষ চলে যায়, থেকে যায় তার কর্ম। বাবার কর্তব্যপরায়ণতা আমাদের প্রত্যেক ভাই-বোনের জীবনের পাথেয়। মৃত্যুর আধঘণ্টা আগেও তিনি আমাকে আমার কর্তব্যকাজ করার জন্য উৎসাহিত করে গেছেন। আজ বাবার অষ্টম মৃত্যুবার্ষিকীতে বলছি- আব্বা, আপনি আমাদের সামনে যে আদর্শ জীবনের প্রতিচ্ছবি রেখে গেছেন আমরা সে আদর্শ থেকে বিচ্যুত হইনি। আপনার শিক্ষা ও আদর্শ আমাদের জীবনকে করেছে সুবাসিত, অর্থবহ।

আমি কেবল একজন বাবাকে হারাইনি। একজন বন্ধুকে হারিয়েছি। প্রিয় বাবা! আপনি এই দিনে চলে গেছেন। আমাদের বিশ¡াস আল্লাহ আপনাকে ভালো রেখেছেন। আপনি সেখানে রয়েছেন সদাহাস্য। আপনার স্মৃতি ও আদর্শ আমরা ভাই-বোনেরা ও আপনার পৌত্ররা হৃদয়ে ধারণ করে আছে। আপনার প্রিয় কবি বিশ¡কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বলি- ‘তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম’। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন আপনাকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসিব করেন।

                লেখক : সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগের বিচারপতি।

সর্বশেষ খবর