আল কোরআনে ইশারা দেওয়া হয়েছে যারা রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শত্রুতা করবে আহলে বাইতের বিরোধিতা করবে আসলে তারাই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কারবালায় ১০ মহররম আহলে বাইতের বিপুলসংখ্যক সদস্যের শাহাদাতবরণ সত্ত্বেও তাদের আদর্শ নিশ্চিহ্ন হওয়ার বদলে আরও উজ্জীবিত হয়েছে। নবীবংশের বিরুদ্ধে যারা অস্ত্র ধরেছিল তারাই কার্যত নিশ্চিহ্ন হয়েছে। মানুষ তাদের ১৪০০ বছর পরও দেখে ঘৃণার চোখে।
রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মতদের কাছে মহররমের তাৎপর্য অপরিসীম। এ মাসের ১০ তারিখে ইরাকের কারবালা প্রান্তরে ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে শহীদ হন রসুল-দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)। অসত্য, অন্যায়, অসাম্য ও ভোগবাদের বিরোধিতা করতে গিয়ে শাহাদাতবরণ করেন এই পুণ্যপুরুষ। পাপিষ্ঠ ইয়াজিদ প্রস্তাব দিয়েছিল তাকে খলিফা হিসেবে মেনে নিলে হোসাইন (রা.) ও তাঁর অনুসারীদের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করা হবে। তাঁদের সসম্মানে যেখানে ইচ্ছা যেতে দেওয়া হবে। হজরত হোসাইন (রা.) অন্যায়কারীদের সঙ্গে আপসের চেয়ে জীবন উৎসর্গ করাকেই শ্রেয় বলে বেছে নেন।
চতুর্থ খলিফা হজরত আলীর (রা.) আমলে খিলাফত নিয়ে হজরত মুয়াবিয়া (রা.)-এর সঙ্গে বিরোধ দেখা দেয়। খিলাফতের ঐক্য রক্ষায় হজরত আলী (রা.) উমাইয়াদের সঙ্গে সমঝোতায় উপনীত হন। এ সমঝোতা অনুসারে হজরত আলীর (রা.) পর খিলাফতের অধিকারী হবেন মুয়াবিয়া- এ শর্ত নির্ধারিত হয়। তারপর আবার খিলাফত ফিরে যাবে হজরত আলী ও ফাতিমা (রা.)-এর সন্তানদের হাতে। এ সমঝোতা ভঙ্গ করে উমাইয়ারা। মুয়াবিয়া (রা.)-এর মৃত্যুর পর তাঁর মদ্যপ পুত্র ইয়াজিদকে খলিফা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। উমাইয়ারা ইয়াজিদের পক্ষে আনুগত্যলাভে উঠেপড়ে লাগে। তৎকালীন রীতি অনুযায়ী কোনো রাষ্ট্রে রাষ্ট্রপ্রধান পরিবর্তনে বিশিষ্ট নাগরিক তথা রাষ্ট্রের বিভিন্ন এলাকার অধিবাসীরা রাষ্ট্রপ্রধানের আনুগত্য গ্রহণ করতেন। সে ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রের বিশিষ্টজনেরা ইয়াজিদের কাছে বাইয়াত গ্রহণ করেন। ইমাম হোসাইন (রা.) ইয়াজিদের বাইয়াত গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। ইয়াজিদের বিরুদ্ধে মদ্যপান ও নারী লোলুপতার অভিযোগ ছিল। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠন ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ ছিল। তিনি খিলাফতের অবসান ঘটিয়ে রাজতন্ত্র কায়েম করতে চেয়েছিলেন। ইমাম হোসাইন (রা.) ইসলামী চেতনাবিরোধী কর্মকান্ড প্রতিরোধে উদ্যোগী হন। তিনি ইয়াজিদের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে কুফা সফরের সিদ্ধান্ত নেন। মক্কা থেকে কুফা যাওয়ার পথে অনুসারীদের উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে সুস্পষ্টভাবেই বলেন, ‘আমার সফরের উদ্দেশ্য হলো কপট উমাইয়া শাসকদের স্বরূপ উন্মোচন, অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এবং সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করা। এ ছাড়া আমার অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই।’
উল্লেখ্য, ইয়াজিদকে খলিফা হিসেবে ঘোষণার বিরোধিতা করে কুফার দেড় শতাধিক বিশিষ্ট ব্যক্তি ইমাম হোসাইন (রা.)-এর আনুগত্য স্বীকার করে চিঠি লেখেন ও তাঁকে কুফা গমনের আমন্ত্রণ জানান। হজরত হোসাইন (রা.)-এর কুফা সফরের প্রস্তুতিতে ইয়াজিদ শিবিরে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। তারা কুফার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন চালিয়ে তাদের নিজেদের পক্ষে আনার চেষ্টা করে। এ অপচেষ্টা সাময়িকভাবে সফলও হয়। ইতোমধ্যে ইমাম হোসাইন (রা.) ও তাঁর সহযাত্রীদের অবরুদ্ধ করা হয় ইয়াজিদের নিয়োজিত কুফার গভর্নরের নির্দেশে। এক মাস অবরুদ্ধ থাকার পর ইমাম হোসাইন কারবালার প্রান্তরে ইয়াজিদ বাহিনীর মুখোমুখি হন। অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করার শপথে তিনি ঘোষণা করেন ‘অপমানজনক জীবনের চেয়ে সম্মানজনক মৃত্যু শ্রেয়।’ ইয়াজিদ বাহিনী ইমাম হোসাইন (রা.) শিবিরের পানি সরবরাহ বন্ধে ফোরাত নদের তীরে অবরোধ সৃষ্টি করেছিল। ইমাম পরিবারের শিশুদের জীবন রক্ষায় তিনি সে অবরোধ ভাঙার সিদ্ধান্ত নেন। শুরু হয় নির্দয় ইয়াজিদ বাহিনীর সঙ্গে ইসলামী আদর্শের প্রতি অনুগত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর অনুসারীদের যুদ্ধ। সেই অসম যুদ্ধের একদিকে ইমাম হোসাইনের (রা.) পক্ষে ছিলেন মাত্র ৭২ জন সৈন্য, অন্যদিকে ইয়াজিদের পক্ষে ছিল ৪ হাজার সৈন্য। যুদ্ধে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর সহযোদ্ধাদের একে একে সবাই শাহাদাতবরণ করেন। পবিত্রতা ও শুদ্ধতার প্রতীক ইমাম হোসাইন (রা.) একাই শেষ লড়াই চালিয়ে যান। তাঁকে অত্যন্ত নির্মমভাবে হত্যা করে ইয়াজিদের সৈন্যরা।
কারবালা প্রান্তরে অসম যুদ্ধে ইমাম হোসাইন (রা.) শাহাদাতবরণ করেন। রক্ত দিয়ে তিনি প্রমাণ করেন জীবনের চেয়ে আদর্শ বড়। তাঁর জীবনদানের মাধ্যমে ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়া গংদের দৃশ্যত জয় হলেও প্রকৃত অর্থে আহলে বাইতের পরাজয় ঘটেনি। একজন আলেমে দীনের মতে অনেক আগেই পবিত্র কোরআনে আল্লাহ ইয়াজিদদের মতো পাপিষ্ঠদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলেছেন, ‘হে আমার প্রিয় বন্ধু মুহাম্মাদ! যারা আপনার সঙ্গে শত্রুতা করবে, আহলে বাইতের বিরোধিতা করবে, আসলে ওরাই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।’ কোরআনের এ বাণী আজ জীবন্ত হয়ে উঠেছে বিশ্ববাসীর সামনে। নবীবংশের শত্রুরাই আসলে নির্বংশ- এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো, যার নাম মুছে দিতে ইয়াজিদ নবী পরিবারের রক্তে ভাসিয়েছে কারবালা, আজ বিশ্ব তাঁরই জয়গান গাইছে। ইতিহাস কখনই পরাজিত শক্তির পক্ষে বলে না। এ হিসেবে হোসাইন (রা.)-এর জয়গান গাওয়ার মানুষ না থাকারই কথা ছিল। কিন্তু পবিত্র কোরআন তো অনেক ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, নবীবংশ কখনই বন্ধুশূন্য হবে না। তাই আজও হোসাইনের জন্য চোখের অশ্রু বুকের রক্ত ঢেলে দেওয়ার মানুষের অভাব নেই দুনিয়ায়। বড় আশ্চর্যের কথা হলো, ইয়াজিদের দোসর যারা, যারা হোসাইনের জন্য কাঁদে না, ইয়াজিদের জন্য হাসে; তারাও কিন্তু ইয়াজিদের জয়ে জয়োল্লাস করে না। একটি জয়ের পরাজয় তো তখনই হয়, যখন ভবিষ্যৎ প্রজম্ম সে জয়কে উদ্যাপন করতেও লজ্জা পায়। এখানেই ইয়াজিদের পরাজয়। এখানেই হোসাইনের (রা.) বিজয়। এটাই কোরআনে বলা ওই আয়াতের মোজেজা। আয়াতের বাস্তব সত্য যা বিশ্ববাসী আজ প্রত্যক্ষ করছে। ইসলামের আদর্শ সমুন্নত রাখতে হজরত হোসাইন (রা.) ও তাঁর অনুসারীদের শাহাদাতবরণ কিয়ামত পর্যন্ত মুসলমানদের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক।