শিরোনাম
শুক্রবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

বাবার স্মৃতি-কর্ম ও পথচলা

বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম

বাবার স্মৃতি-কর্ম ও পথচলা

৪ সেপ্টেম্বর, ২০২০, আমাদের বাবা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, সংবিধান প্রণেতাদের অন্যতম, স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত (মরণোত্তর) এম আবদুর রহিমের চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী। বাবার জন্ম ২১ নভেম্বর, ১৯২৭ দিনাজপুর সদর উপজেলার জালালপুর গ্রামে। পড়ালেখা শেষ করে ১৯৬০ সালে দিনাজপুরে আইন পেশায় নিয়োজিত হন। ’৫২ সালে রাজশাহী কলেজের ছাত্র থাকাবস্থায় ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। আইন পেশায় সক্রিয় হওয়ার পাশাপাশি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হন। ’৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণা করলে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে বাঙালির স্বাধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনে এবং আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ’৭০ সালে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে ’৭১-এর মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে বৃহত্তর দিনাজপুর অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। ১৩ এপ্রিল, ’৭১ পর্যন্ত দিনাজপুর হানাদারমুক্ত ছিল। ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বাবাকে আহ্বায়ক করে দিনাজপুরে ‘মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। মানবিক মূল্যবোধ আর দেশাত্মবোধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পতিরাম, রায়গঞ্জ, কালিয়াগঞ্জ, বালুরঘাট, গঙ্গারামপুরসহ বিভিন্ন এলাকার শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।

’৭১-এর ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হলে বেসামরিক প্রশাসন পরিচালনার জন্য ১১টি জোনে ভাগ করা হয়। বাবা পশ্চিম জোন-১-এর জোনাল চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন সংশ্লিষ্ট জোনের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের দ্বারা। শরণার্থী শিবিরের সার্বিক ব্যবস্থাপনা, ইয়ুথ ক্যাম্প পরিচালনা, মুক্তিযোদ্ধাদের রিক্রুটমেন্ট এবং প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ছিল তাঁর ওপর। দেশ হানাদারমুক্ত হওয়ার পর বাবা ১৭ ডিসেম্বর সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশে পশ্চিম জোন-১-এর চেয়ারম্যান হিসেবে বগুড়া জেলার প্রশাসনিক দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ১৮ ডিসেম্বর সকাল ১১টায় দিনাজপুর গোর-এ শহীদ বড় ময়দানে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন দেশে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এ সময় মিত্রবাহিনীর এ অঞ্চলের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার ফরিদ ভাট্টি ও কর্নেল শমসের সিংয়ের নেতৃত্বে একটি চৌকস দল তাঁকে গার্ড অব অনার প্রদান করে। স্বাধীনতার পর তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত বৃহত্তর দিনাজপুর অঞ্চল পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগ করেন এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটির চেয়ারম্যানের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাবার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে তৎকালীন পাকিস্তানি সেনাশাসক তথাকথিত সামরিক ট্রাইব্যুনালে একতরফা বিচার করে সাজা প্রদান করে। সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির ৩৪ জন সদস্যের অন্যতম হিসেবে সংবিধান প্রণয়নে অবদান রাখেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন, তখন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ’৭৫-পরবর্তী সামরিক শাসকদের কোনো প্রলোভনই তাঁকে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। ’৭৫-পরবর্তীতে বেগম জোহরা তাজউদ্দীনকে আহ্বায়ক করে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কমিটি গঠন করা হলে তিনি কমিটির সদস্য এবং পরবর্তীতে দীর্ঘদিন কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ’৮৪ ও ’৮৬ সালে সামরিক শাসনবিরোধী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সামরিক শাসক গোষ্ঠী তাঁকে গ্রেফতার করে দীর্ঘদিন কারাগারে আটক রাখে।

বাবা, ১৯৯১ সালে দিনাজপুর সদর আসন থেকে পুনরায় জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি দীর্ঘদিন দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ’৯৫ সালে চাঞ্চল্যকর কিশোরী ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদে গড়ে ওঠা আন্দোলনের বলিষ্ঠতা তাঁকে দিনাজপুরের গণমানুষের কাছে আলোকিত করে। রাজনীতিকে মানুষের সেবা-কল্যাণ আর মঙ্গলের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে তিনি সমাজসেবায় ছিলেন একনিষ্ঠ। দিনাজপুর ডায়াবেটিক হাসপাতাল, চক্ষু হাসপাতাল, রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালসহ নানা সেবামূলক প্রতিষ্ঠান এবং স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মসজিদ, হিন্দু উপাসনালয়সহ দিনাজপুরের সার্বিক উন্নয়ন কর্মকান্ডে তিনি কান্ডারির ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি রেড ক্রস/রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি ও হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ও বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমির বোর্ড অব গভর্নরসের সদস্য এবং জাতীয় অন্ধ কল্যাণ সমিতি, বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতি ও জাতীয় যক্ষ্মা নিরোধ সমিতির জেলা ও কেন্দ্রীয় কমিটির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি সর্বশেষ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর লেখা ‘ধর্মের মুখোশ’ ও ‘৫ম সংশোধনীর মোজেজা’ দুটি গ্রন্থ ব্যাপক সাড়া জাগায়।

তিনি ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি হিসেবে দিল্লিতে সর্বভারতীয় কংগ্রেসের জাতীয় সম্মেলনে যোগদান করেন। ’৭৪ সালে মস্কোয় অনুষ্ঠিত বিশ্বশান্তি সম্মেলনে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ’৭৮ সালে কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত বিশ্ব রেড ক্রস সোসাইটি কর্তৃক আয়োজিত মানবাধিকারবিষয়ক এক সম্মেলনে যোগদান করেন।

বাবাকে একজন আদর্শ অনুকরণীয় পিতা হিসেবে পেয়েছি-জেনেছি। ‘রাজনীতি ত্যাগের জন্য, ভোগে বা বিত্ত-বৈভব তৈরির জন্য নয়’- তা বাবাকে অনুসরণ করতে দেখেছি। আমার দাদার ৭০০-৮০০ বিঘা সম্পত্তি ছিল। দাদার মৃত্যুর পর বাবা ভাগে পেয়েছিলেন ১০০ বিঘার ওপরে। কিন্তু মৃত্যুর পর আমার ভাই-বোনেরা (ছয় ভাই-বোন) উত্তরাধিকার হিসেবে পেয়েছি ৭৩ বিঘার মতো। বাবা সিভিল ল ইয়ার হিসেবে জেলার প্রথম সারির কয়েকজনের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। আইন পেশায় তাঁর রোজগারও কম ছিল না। কিন্তু রাজনীতি-সমাজসেবা করতে গিয়ে বাবার সম্পত্তি কমেছে, বাড়েনি; সম্পত্তি বিক্রি করেছেন। বর্তমান সময়ে জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হওয়ার পরপরই রাজউকের একটি প্লট পাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বাবার নামে রাজউকের কোনো প্লট ছিল না কিংবা রাজধানীতে অন্য কোনো জায়গা সম্পত্তিও ছিল না। বাবাকে যখন বলতাম, পেশাগত কারণে আমাদের তো ঢাকায় থাকতে হবে, জায়গা কেনা প্রয়োজন; তখন তিনি বলতেন, ‘আমি কৃষকের ছেলে, লেখাপড়া শিখে দিনাজপুর শহরে বাড়ি করেছি, তোমাদের লেখাপড়া শিখিয়েছি, যদি পারো তোমরা তোমাদের টাকায় ঢাকায় বাড়ি কোরো।’ বাবার কখনই বিশাল অঙ্কের কোনো ব্যাংক ব্যালান্সও ছিল না।

বাবা আমাদের ভাই-বোনদের নিজের সততা, ন্যায়নিষ্ঠা ও মানবিকতার আদর্শে বড় করতে চেষ্টা করেছেন। আমরা যেন পরিবার-আত্মীয়স্বজন-সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়ে সমাজের সবার কল্যাণে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করতে পারি, এগিয়ে আসি সেভাবে আমাদের উদ্বুদ্ধ করতেন। আমাদের দিনাজপুর শহরের বাসার ঠিক উল্টো দিকে ‘সদর হাসপাতাল’ যা এখন জেনারেল হাসপাতাল। নব্বই দশকের আগে দিনাজপুর জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিশেষত ঘোড়াঘাট, নবাবগঞ্জ, বিরামপুর, হাকিমপুর থানার সঙ্গে জেলা শহরের যোগাযোগব্যবস্থা খুবই খারাপ ছিল। আত্মীয়স্বজন ছাড়াও জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের অসুস্থ লোকজন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে বাবা আমাদের ওইসব রোগীর খোঁজখবর নেওয়ার জন্য নিয়মিত হাসপাতালে পাঠাতেন। রোগী মহিলা হলে বোনদের পাঠাতেন, তাদের সুবিধা-অসুবিধা জানার জন্য। রোগীদের সঙ্গে থাকা অন্যান্য লোকজনের থাকা-খাওয়ার কোনো অসুবিধা আছে কিনা সেসব তথ্য আমাদের এনে দিতে হতো। বর্তমানের মতো ২০-২৫ বছর আগে হাসপাতালে বিভিন্ন ধরনের সেবামূলক সুযোগ-সুবিধা ছিল না। সে সময় রোগীর পথ্য/খাদ্য ছিল সাগু, বার্লি, জাউ ভাত, হরলিক্স। হাসপাতালে সাগু, বার্লি, জাউ ভাত তৈরি বা পানি গরম করার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। রোগীদের চাহিদা অনুযায়ী বাবার নির্দেশে বাসায় আমার মা ওইসব তৈরি করে দিলে আমরা হাসপাতালে রোগীদের কাছে পৌঁছে দিতাম। ফ্লাস্কে গরম পানিও সরবরাহ করতাম। দূরদূরান্তের রোগীদের সঙ্গে থাকা লোকজনের রাতে বাসার বাইর দিকের খোলা বারান্দায় ঘুমানোর ব্যবস্থাও ছিল অন্যান্য মক্কেলের সঙ্গে।

’৭৩-৭৪ সাল হবে; বাবা আমাকে একদিন দিনাজপুর প্রধান ডাকঘরে গিয়ে কয়েকটি ‘মানি অর্ডার ফরম’ নিয়ে আনতে বললেন। সে সময় কোথাও টাকা পাঠাতে হলে ডাকঘরের মাধ্যমে ‘মানি অর্ডার’ করে পাঠাতে হতো। বর্তমানের মতো কুরিয়ার, নগদ, বিকাশ, রকেট ছিল না। পোস্ট অফিসই ছিল টাকা পাঠানোর একমাত্র মাধ্যম। আমি ফরম নিয়ে এলে আমাকে শেখালেন কীভাবে মানি অর্ডার ফরম পূরণ করে টাকা পাঠাতে হয়। নব্বই দশকের আগ পর্যন্ত কাউকে কোনো জরুরি সংবাদ দিতে হলে  টেলিগ্রামই ছিল একমাত্র ভরসা। টেলিগ্রামের ফরম কীভাবে পূরণ করতে হয় তাও বাবা আমাকে শিখিয়েছিলেন। ছোটবেলায় খুব বই, পত্রিকা পড়তাম। আমাকে বলতেন বই বা পত্রিকার যে কথাগুলো ভালো লাগবে তা একটি খাতায় লিখে রাখতে। স্বাধীনতার পর বাবা বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সে সময় তাঁর ব্যবহারের জন্য একটি সরকারি জিপ দেওয়া হয়। সত্য এটাই যে, তিনি ওই জিপ ব্যক্তিগত কাজে কোনো দিন ব্যবহার করেননি। দিনাজপুর শহরে সে সময় পাঁচ-ছয় জনের প্রাইভেট কার ছিল। ছোটবেলায় গাড়িতে ওঠার শখ সবারই থাকে। ভাই-বোনসহ মায়ের আক্ষেপ ছিল সরকারি গাড়িতে উঠতে না পারার। আত্মীয়স্বজন, বাবার বন্ধুবান্ধবরা মাকে এসে নানা ধরনের কথা বলতেন। মা বলতেন, ‘রহিম সাহেবকে আপনারা চেনেন না!’ তবে একবার ওই গাড়িতে চড়ে সপরিবার আমরা ঢাকায় এসেছিলাম। এর পেছনেও একটি কাহিনি আছে। বাবার এক আইনজীবী বন্ধু যিনি আওয়ামী লীগেরও নেতা ছিলেন, তাঁর এক ছেলে, বয়স সে সময় ১০-১২ হবে; জন্মগতভাবে হার্টের সমস্যা ছিল। স্বাধীনতার পর ঢাকার সঙ্গে দিনাজপুরের যোগাযোগের মাধ্যম ছিল বিআরটিসির একটি মাত্র বাস ও ট্রেন, যা সময় রক্ষা করে চলত না, আবার অসম্ভব ভিড় হতো। বাবাকে অনুরোধ করলে তিনি তাঁর ওই বন্ধুর স্ত্রী ও অসুস্থ ছেলেকে গাড়িতে করে ঢাকায় নিয়ে আসেন। এ বিষয়টিতে আমার মায়ের কান ভারি করলেন কেউ কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে। আর এ কারণেই পরবর্তীতে বাবা সরকারি গাড়িতে আমাদের সবাইকে ঢাকায় নিয়ে এসেছিলেন। ঢাকায় এসে উঠেছিলাম এখন যেটা ‘গণভবন’ সেখানে, তখন সেটা ভিআইপি রেস্ট হাউস ছিল।

বাবা সব সময় ঘড়ি ধরে চলতেন। কোর্ট, মিটিং-মিছিলে সময়মতো হাজির হতেন। সংবাদ পেলে যে কোনো মৃত ব্যক্তির জানাজায় উপস্থিত থাকার চেষ্টা করতেন। অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণপত্রে উল্লিখিত সময়ে হাজির হয়ে অনেক সময় দেখতেন আয়োজকরাই উপস্থিত নেই। সভা-সমাবেশে নির্ধারিত সময়ে হাজির হয়ে দেখতেন, নেতা-কর্মী কেউ আসেনি। আমার একটি ঘটনা মনে পড়ে। সম্ভবত এপ্রিল/মে, ১৯৮০ হবে। জেলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে দিনাজপুর গোর-এ শহীদ ময়দানে জনসভা আহ্বান করা হয়েছে বিকাল ৩টা ৩০ মিনিটে। তখন ছিল গ্রীষ্মকাল। প্রখর রোদ। জনসভায় যোগদানের জন্য দিনাজপুর শহরের মিশন রোড এলাকায় অবস্থিত পানি উন্নয়ন বোর্ডের রেস্ট হাউসে দুপুরে খাওয়ার পর বিশ্রাম নেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছিলেন আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি আবদুল মালেক উকিল, সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক ও সাংগঠনিক সম্পাদক তোফায়েল আহমেদ। বাবা তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিলেন যে, সোয়া ৩টায় বের হতে হবে- মিটিং ঠিক সাড়ে ৩টায় শুরু হবে। নেতৃবৃন্দ একটু অপ্রস্তুত হলেন, চেহারা দেখে বুঝতে পারলাম। আমিও সেখানে উপস্থিত ছিলাম। রাজ্জাক সাহেব শুধু বললেন, এই প্রচ- রোদে জনসভায় কি লোক হবে? সে সময় জনসভার আয়োজন করতে হতো ২০-৩০ দিন আগে থেকে। জনসভার লোক আনার জন্য বাস-ট্রাক বা অন্যান্য যানবাহনের ব্যবস্থা থাকত না এখনকার মতো। মানুষ আপন ইচ্ছায় ১০-১৫ মাইল দূর থেকে পায়ে হেঁটে আসত নেতাদের বক্তব্য শোনার জন্য। বাবার কারণে নেতৃবৃন্দ সাড়ে ৩টার আগেই সভামঞ্চে উঠলেন। গোর-এ শহীদ, বিশাল ময়দান, প্রচ- রোদ, মাঠ শূন্য খাঁখাঁ করছিল। মঞ্চের  আশপাশে ও দূরবর্তী গাছের নিচে সব মিলিয়ে ১৫০-২০০ জন লোক হবে। নেতৃবৃন্দ হতাশ; কিন্তু সভা শুরু হলো ঠিক সাড়ে ৩টায়। তৎকালীন শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি বোরহানউদ্দিন সাহেবের পবিত্র কোরআন ও দুর্গাবাবুর (সাবেক এমএলএ) গীতা পাঠের মাধ্যমে। সময় গড়াতে লাগল; ধীরে ধীরে মাঠ পরিপূর্ণ হয়ে গেল হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে। নেতৃবৃন্দ বক্তব্য দিলেন। জনসমাগম ও মানুষের স্বতঃস্ফূর্ততায় নেতৃবৃন্দ অভিভূত ও বিস্মিত হয়ে ভুলে গিয়েছিলেন বাবার অনুরোধে প্রচ- রোদে অস্বস্তিকর অবস্থায় যথাসময়ে মিটিংয়ে আসার অপ্রকাশিত বিরক্তি।

বাবা খুব বেশি সামাজিকতা রক্ষা করতেন। সাপ্তাহিক ছুটির দিনসহ অন্যান্য ছুটির দিন সাধারণত সকালবেলা বের হয়ে ২-৩ ঘণ্টার মধ্যে ১০-২০ জন আত্মীয়স্বজন, স্থানীয় নিজ দলসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের বাড়িতে গিয়ে বেড়িয়ে আসতেন তাঁদের কুশলাদি জেনে। স্থানীয় অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তাঁর খুব ভালো সম্পর্ক ছিল এবং তিনি নিয়মিত তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন এবং তাঁরাও বাবাকে আস্থা ও বিশ্বাসের মানুষ মনে করে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করতেন। ’৪৭-এর পর দিনাজপুর শহরে তেভাগা ও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতা সংসারত্যাগী গুরুদাস তালুকদার, রূপনারায়ণ, তেজেন নাগসহ কয়েকজন বাস করতেন। তাঁদের শেষ জীবনের একাকিত্বের সময় বাবা প্রায়ই তাঁদের খোঁজখবর নিতেন। বাবা ধর্ম পালন করতেন, বিভিন্ন ইসলামী সভায় নিয়মিত যেতেন, বক্তব্য দিতেন, কিন্তু ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে মাঝেমধ্যেই রাজনীতিসহ বিভিন্ন কারণে বিব্রতকর এবং নিরাপত্তাহীন অবস্থার সম্মুখীন হতে হতো। এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে বাবা কখনো একা, কখনো নিজ দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে করে তাদের পাশে দাঁড়াতেন; সাহস জোগাতেন, প্রশাসনকে সক্রিয় ও তৎপর করতে চেষ্টা করতেন। ২০০১ সালের পর বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ভোট ও ভাতের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম শুরু হলে ৭৫-৭৮ বয়সেও বাবা নিয়মিত মিছিল, মিটিং, ধর্মঘট, হরতাল কর্মসূচিতে কর্মীদের সঙ্গে থাকতেন, উৎসাহ দিতেন। হরতালের দিন ফজরের নামাজের পর কর্মীদের নিয়ে পিকেটিংয়ে বের হতেন। রাস্তার পাশে বসে কর্মীদের সঙ্গে পাউরুটি, বিস্কুট, মুড়ি, চা খেতেন। বয়সের কোনো ক্লান্তি ছিল না।

বাবা খুব দৃঢ়চেতা ও স্পষ্টভাষী মানুষ ছিলেন। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বা কৌশলী কথা না বলে যে কোনো বিষয়ে তাঁর মতামত স্পষ্ট করে সরাসরি প্রকাশ করতেন। যেহেতু রাজনীতি করতেন অসংখ্য মানুষ নানা প্রয়োজনে বিভিন্ন বিষয়ে ‘তদবির’ নিয়ে এলে যা সম্ভব বা করতে পারবেন সেখানে ‘হ্যাঁ’ বলতেন; আর যা সম্ভব নয় তা স্পষ্ট করে ‘না’ বলে দিতেন। ‘না’ শোনা মানুষগুলো অপ্রস্তুত এবং রুষ্ট হলেও বাবা নিজের অবস্থান বা সিদ্ধান্তে অনড় থাকতেন। তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা ও স্পষ্টতার কারণেই হয়তো বঙ্গবন্ধু তাঁর সমবয়সী এবং বয়সে ছোট সহকর্মী স্বল্প যে কজন ব্যক্তিকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করতেন, বাবা তাঁদের মধ্যে ছিলেন একজন। বঙ্গবন্ধু সাধারণত তাঁর সমবয়সী ও বয়সে ছোট সহকর্মীদের ‘তুই’ বা ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করতেন।

বাবা খুব অতিথিপরায়ণ মানুষ ছিলেন। ঢাকা থেকে নিজ দলের তো বটেই, অন্যান্য প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ বা বিশিষ্ট কোনো ব্যক্তি দিনাজপুর সফরে এলে তাঁদের সঙ্গে দেখা করে বাসায় আসার জন্য আমন্ত্রণ জানাতেন, চেষ্টা করতেন তাঁদের আপ্যায়ন করতে। বাবার আমন্ত্রণে আমাদের দিনাজপুরের বাসায় অতিথি হিসেবে পেয়েছি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ (১৯৬৯) জাতীয় চার নেতার অন্যতম ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামান, বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক পরমাণু বিজ্ঞানী এম এ ওয়াজেদ মিয়া, বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ (রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যান থাকাকালে), বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী (রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যান থাকাকালে), বিচারপতি কে এম হাসান, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদদের মধ্যে আবদুল মালেক উকিল, আবদুস সামাদ আজাদ, মিজানুর রহমান চৌধুরী, মোল্লা জালালউদ্দিন, বেগম জোহরা তাজউদ্দীন, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, কমরেড মণি সিংহ, অধ্যাপক মোজাফ্্ফর আহমদ, কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ, মোহাম্মদ নাসিম, বেগম মতিয়া চৌধুরী, কর্নেল (অব.) শওকত আলী, আবদুল মোমিন তালুকদার, সরদার আমজাদ হোসেন, ফজলে রাব্বী মিয়া, আবদুল মতিন খসরু, রাশেদ খান মেনন, মিসেস আইভি রহমান, সাহারা খাতুন, আবু সাইয়িদ, শীর্ষ আইনজীবীদের মধ্যে মির্জা গোলাম হাফিজ, শফিক আহমেদ, জমিরউদ্দিন সরকার, এম আমীর-উল ইসলাম, খন্দকার মাহবুব উদ্দিন আহমাদ, আবদুল বাসেত মজুমদার, খন্দকার মাহবুব হোসেন, মাহবুবে আলম, রোকনউদ্দিন মাহমুদ, ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, সৈয়দ রেজাউর রহমানসহ অনেক বিশিষ্ট ও গুণী ব্যক্তিবর্গকে। বাবার মৃত্যুর পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিনাজপুরের সর্বস্তরের মানুষের অভিপ্রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজটির নাম ‘এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ’ এবং মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক প্রদান করায় তাঁর প্রতি দিনাজপুরবাসী এবং আমাদের পরিবার কৃতজ্ঞ।

বাবা খসড়া সংবিধান প্রণয়নে ভূমিকা রেখেছিলেন; মূল সংবিধানে স্বাক্ষর করেছেন। বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের সময় শপথ নিয়েছি ‘সংবিধান ও আইনের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান’ এবং ‘ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হয়ে সকলের প্রতি আইন-অনুযায়ী যথাবিহিত আচরণ’ করার। সংবিধান হাতে নিলে প্রতিটি শব্দে, বাক্যে, অনুচ্ছেদে বাবার স্পর্শ-অস্তিত্ব অনুভব করি। এ অনুভূতি যেমন প্রচ- আবেগ সৃষ্টি করে, তেমনি সংবিধান রক্ষা এবং শপথ অনুযায়ী বিচার করার কঠিন দায়িত্ব ও কর্তব্যটিও স্মরণ করিয়ে দেয়। বর্তমানে বাবার স্মৃতি ও কর্ম আমার পথচলার প্রেরণা। মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিন বাবাকে মাগফিরাত ও বেহেশত নসিব করুন।

            লেখক : হাই কোর্টের বিচারপতি।

সর্বশেষ খবর