বৃহস্পতিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

করোনার টিকা সংগ্রহে বাংলাদেশকে কেন তৎপর হতে হবে

ড. মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন ♦ ড. রেজাউল করিম

করোনার টিকা সংগ্রহে বাংলাদেশকে কেন তৎপর হতে হবে

করোনার স্থবিরতা থেকে মুক্তি পেতে উন্মুখ হয়ে আছে পুরো বিশ্ব। কার্যকর ভ্যাকসিন পৃথিবীকে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরাবে বলে আমরা সবাই আশাবাদী। নতুন একটি ভ্যাকসিন তৈরিতে সাধারণত পাঁচ থেকে ১০ বছর লাগলেও অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে এখন পর্যন্ত দুটি কভিড-১৯ ভ্যাকসিন ইমারজেন্সি অনুমোদন পেয়েছে এবং আরও কয়েকটি সফলতার দ্বারপ্রান্তে। আশু মুক্তির আশায় শুরু হয়েছে কভিড ভ্যাকসিন সংগ্রহের প্রতিযোগিতা।

ভ্যাকসিন আন্তর্জাতিকভাবে অনুমোদন পাওয়ার আগেই উন্নত দেশগুলো তাদের জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষার নিমিত্ত ইতিমধ্যে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডোজ প্রি-অর্ডার অর্থাৎ কেনার চুক্তি করে ফেলেছে। পৃথিবীর ৩৩টি দেশ (পাঁচটি ধনী ও ২৭টি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশ) বিভিন্ন কোম্পানির প্রায় ৫ বিলিয়ন ডোজ ভ্যাকসিন ২০২১ সালের মধ্যে সংগ্রহ করা নিশ্চিত করেছে। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার (৭.৫ বিলিয়ন) মাত্র ১৩ ভাগ এ ৩৩টি দেশে বাস করে। কোনো কোনো দেশ পুরো দেশের জনসংখ্যার জন্য ভ্যাকসিনেশন করতে যত ডোজ প্রয়োজন তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি ডোজ কিনতে ইতিমধ্যে ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানিগুলোর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে।

কভিড ভ্যাকসিন সংগ্রহে অসম প্রতিযোগিতা : ২০২১ সালে প্রথম সারির ১০টি ক্যান্ডিডেট ভ্যাকসিনের সম্ভাব্য উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ১০ বিলিয়ন ডোজ। পুরো বিশ্বের ৭.৫ বিলিয়ন মানুষকে ভ্যাকসিনেশন করতে প্রয়োজন হবে ১৫ বিলিয়ন ডোজ (প্রতি জনে ২ ডোজ)। অসম প্রতিযোগিতার কারণে নিম্নমধ্য ও নিম্ন আয়ের ৯২টি দেশের কয়েক বিলিয়ন মানুষ কভিডের ভ্যাকসিন থেকে বঞ্চিত হতে পার। ডিউক গ্লোবাল হেলথ ইনোভেশন সেন্টার কর্তৃক পরিচালিত গবেষণা অনুসারে অনেক নিম্নœমধ্য ও নিম্নœ আয়ের দেশকে ভ্যাকসিনের জন্য ২০২২ অবধি অপেক্ষা করতে হতে পারে।

বাংলাদেশ কখন পর্যাপ্ত টিকা পেতে পারে? : সরকার সম্প্রতি সেরাম ইনস্টিটিউট, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন সংগ্রহের জন্য একটি চুক্তি করেছে। চুক্তি অনুযায়ী ৩ কোটি ডোজ বাংলাদেশে সরবরাহ করা হবে। সেরাম ইনস্টিটিউট আরও বেশ কয়েকটি দেশ এবং ওয়ার্ল্ড টাস্কফোর্সের (নাম কভ্যাক্স) সঙ্গে চুক্তি করেছে। সেরাম ইনস্টিটিউটকে নিজের দেশের (ভারত) চাহিদা মেটাতে হবে। তাই প্রি-অর্ডার করা ৩ কোটি ডোজ সময়মতো ডেলিভারি দিতে পারবে কিনা তা প্রশ্নাতীত। সেরামের ভ্যাকসিন দিয়ে মাত্র দেড় কোটি মানুষকে ভ্যাকসিনেশনের আওতায় আনা যাবে।

অন্যদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং গ্যাভির মধ্যস্থতায় গঠিত কভ্যাক্স উদ্যোগটি উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে ন্যায়সংগত ভ্যাকসিন বিতরণের প্রাথমিক লক্ষ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত। কভ্যাক্সের উদ্দেশ্য প্রতিটি দেশে ২০২১ সালের মধ্যে জনসংখ্যার (উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠী) শতকরা ২০ ভাগকে ভ্যাকসিনেশন করা। এখন পর্যন্ত কভ্যাক্স মাত্র ৫০০ মিলিয়ন ডোজ প্রি-অর্ডার করেছে। দুর্ভাগ্য হলো, অগ্রিম বুকিং প্রতিযোগিতার কারণে কভ্যাক্স মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে যাচ্ছে। তাই প্রয়োজনীয় পরিমাণে ডোজ সংগ্রহের জন্য কভ্যাক্সের ওপর নির্ভর করা বোকামি হবে। সেহেতু বাংলাদেশকে কালক্ষেপণ না করে ভ্যাকসিন সংগ্রহে অগ্রিম বুকিং গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে।

আগাম অর্ডার দেওয়া প্রয়োজন কেন? : জনগণের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। তা ছাড়া ‘কভিড ভ্যাকসিন পাসপোর্ট’ নামক ইস্যু নিয়ে বিশ্ব মিডিয়ায় আলোচনা শুরু হয়েছে। কভিড প্যানডেমিকের বিভীষিকা যাতে ফিরে না আসে তার জন্য উন্নত দেশগুলো সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাবে। ভ্যাকসিনেশন ছাড়া বাংলাদেশ থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি, পড়াশোনা উপলক্ষে কয়েক মিলিয়ন মানুষ বিদেশে যাওয়ায় হুমকিতে পড়ে যেতে পারে যার প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে। তাই ভ্যাকসিন সংগ্রহ/প্রি-অর্ডারে গড়িমসি করলে পরে সম্ভবত আফসোস করতে হবে।

কোন ভ্যাকসিনগুলো সংগ্রহে বাংলাদেশকে টার্গেট করা উচিত? :

যে ভ্যাকসিনগুলো উন্নত কোয়ালিটি, দামে কম এবং দেশের আবহাওয়া সংরক্ষণ করা তুলনামূলক সহজ হতে পারে সেগুলো সংগ্রহে জোর দিতে হবে। বিভিন্ন প্রযুক্তির ভ্যাকসিন রয়েছে-

এমআরএনএ ভ্যাকসিন : এ প্রযুক্তিটি ব্যবহার করে বায়োএনটেক-ফাইজার ও মডার্না-এনআইএআইডির ভ্যাকসিনগুলো গ্রহণযোগ্য কার্যকারিতা এবং সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে বিধায় ইমারজেন্সি অনুমোদন পেয়েছে। তবে এগুলো সংরক্ষণ করতে অত্যন্ত নিম্ন (মাইনাস ৭০-২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) তাপমাত্রায় রাখতে হয়। এ ধরনের (আলট্রা) কোল্ড স্টোরেজ পদ্ধতি মেনটেইন করার জন্য বাংলাদেশের টিকা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে অনেক বেগ পেতে হবে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডাটা অনুযায়ী মাঠ পর্যায়ে নিয়মিত তাপমাত্রা (২-৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস) বজায় না রাখার কারণে বিশ্বব্যাপী ৫০%-এর বেশি ভ্যাকসিন নষ্ট হয়। তার ওপর এ ভ্যাকসিনগুলো তুলনামূলক ব্যয়বহুল। উদাহরণস্বরূপ, মডার্না-এনআইএআইডির ভ্যাকসিনের জনপ্রতি ৭৪ মার্কিন ডলার ব্যয় হবে। সুতরাং বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি উদ্যোগে এ ভ্যাকসিনগুলো সংগ্রহে জোর দেওয়া উচিত হবে না। তবে সাধারণ তাপমাত্রায় (২-৮ ডিগ্রি) সংরক্ষণ করা যায় এমন এমআরএনএ টেকনোলজির ভ্যাকসিন কিউরভ্যাক নামক একটি কোম্পানি ডেভেলপ করেছে যা ২০২১ সালে জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন পেতে পারে। এর দামও (২০ ইউরো) বিবেচনায় নিতে হবে।

অ্যাডেনোভাইরাল ভ্যাকসিন : এ ভ্যাকসিন প্রযুক্তির ভ্যাকসিন এফডিএ ও ইএমএ অনুমোদন দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, জনসন ফার্মাসিউটিক্স (জনসন অ্যান্ড জনসন) যে প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে তা ২০২০ সালে ইবোলা ভ্যাকসিনের জন্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অনুমোদন পেয়েছে। তার ওপর স্ট্যান্ডার্ড স্টোরেজ তাপমাত্রা, অপেক্ষাকৃত কম দাম ও বিপুল পরিমাণে উৎপাদনের দক্ষতার কারণে বাংলাদেশকে প্রি-অর্ডার দিতে বিবেচনা করতে পারে। পাশাপাশি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনের সংগ্রহ আরও প্রি-অর্ডার দেওয়ার পাশাপাশি স্পুটনিক-ভি ভ্যাকসিনেরও বিবেচনা করা যেতে পারে।

প্রোটিন সাব-ইউনিট : এ ভ্যাকসিন প্রযুক্তি এফডিএ ও ইএমএ অনুমোদন পেতেও সফল প্রমাণিত হয়েছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, নোভাভ্যাক্সের ভ্যাকসিনপ্রার্থী এখন পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য কার্যকারিতা ও সেইফটি প্রোফাইল দেখিয়েছে। এ ছাড়া নোভাভ্যাক্স ভ্যাকসিন তুলনামূলক সস্তা ও স্ট্যান্ডার্ড স্টোরেজ তাপমাত্রার কারণে বাংলাদেশের এ ভ্যাকসিনের প্রি-অর্ডারিংয়ের বিষয়টিও বিবেচনা করা উচিত।

নিষ্ক্রিয় প্রযুক্তির টিকা (Inactivated vaccines): এটি লক্ষণীয় যে ইইউতে বৈজ্ঞানিকভাবে উন্নত দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের মতো দেশগুলোর কোনোটিই নিষ্ক্রিয় ভ্যাকসিনে বিনিয়োগ করেনি। একইভাবে ভারত বায়োটেক, সিনোভাক, সিনোফর্ম এবং অন্যান্য নিষ্ক্রিয় প্রযুক্তির টিকাগুলোয় বিনিয়োগ করা উচিত হবে না। এ নিষ্ক্রিয় প্রযুক্তির ভ্যাকসিনগুলোর কার্যকারিতাও বৈজ্ঞানিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। দামও বেশি। প্রসংগত, সিনোভ্যাকের ভ্যাকসিনের জন্য জনপ্রতি ৬০ ডলারের মতো ব্যয় করতে হবে।

পর্যাপ্ত ভ্যাকসিন সংগ্রহে বাংলাদেশে তৎক্ষণাৎ কী কী করা উচিত?

১। ভালো কোয়ালিটির কিন্তু দাম কম এবং সাধারণ তাপমাত্রায় (২-৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস) সংরক্ষণ করা যায় এমন অগ্রগামী ভ্যাকসিন ক্যান্ডিডেটগুলো প্রাক-অর্ডার করতে কালবিলম্ব না করা। সংগত কারণে জেনসেন, কিউওরভ্যাক, নোভাভ্যাক্স, স্পুটনিক-৫ ভ্যাকসিনগুলো আগাম বুকিং দেওয়া প্রয়োজন।

২। বেসরকারি উদ্যোগে ভ্যাকসিন সংগ্রহে গুরুত্ব দেওয়া : সরকারি অনুদানযুক্ত টিকা কর্মসূচির মাধ্যমে পুরো দেশে ভ্যাকসিন করতে প্রায় ২০২৩-২৪ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। যাদের সামর্থ্য আছে তারা যেন বেসরকারি উদ্যোগের টিকা নিতে পারে সে জন্য সরকারকে উদ্যোগ নেওয়া উচিত। দেশের প্রায় ৭০ ভাগ মানুষ বেসরকারি হাসপাতাল/ক্লিনিকে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করে। তাই জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বেসরকারি উদ্যোগ থেকে টিকা নেওয়ার সামর্থ্য রাখে। তাই সরকার এ ক্ষেত্রে ফার্মাসিউটিক্যাল বা যে কোনো বেসরকারি উদ্যোগে ভ্যাকসিন সংগ্রহের নীতি-নৈতিকতা, পলিসি বাতলিয়ে দিতে পারে।

৩। স্বল্প সময়ের মধ্যে পর্যাপ্ত ভ্যাকসিন পেতে ফিল-ফিনিস/ বোতলজাতকরণ পদ্ধতিতে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও মানসম্মত কোয়ালিটি নিশ্চিত করতে পারে এমন ফিল-ফিনিস প্ল্যাটফরমকে কাজে লাগানো। এ ক্ষেত্রে সরকারি মধ্যস্থতায় বিভিন্ন ভ্যাকসিন কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হতে পারলে পর্যাপ্ত ভ্যাকসিন সংগ্রহের বড় বাধা দূর হতে পারে।

৪। আন্তর্জাতিকভাবে ভ্যাকসিনের ন্যায়সংগত বণ্টন আন্দোলনে বাংলাদেশকে বলিষ্ঠ ভূমিকা নিতে হবে। এ জন্য বিভিন্ন ফোরামে সোচ্চার হতে হবে।

 

► লেখক : ড. মোহাম্মাদ সরোয়ার হোসেন, জনস্বাস্থ্য গবেষক এবং নির্বাহী পরিচালক, বায়োমেডিকেল রিসার্চ ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ, প্রাক্তন সিনিয়র ম্যানেজার (আরএনডি), ইনসেপ্টা বায়োটেক, বাংলাদেশ।

ও ড. রেজাউল করিম, ইমিউনোলজিস্ট এবং বিশেষজ্ঞ-ড্রাগ ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স, WHO-Utrecht Centre of Excellence for Affordable Biotherapeutics, The Netherlands-এর প্রাক্তন প্রজেক্ট লিডার; সায়েন্টিস্ট, বায়োমেডিকেল রিসার্চ ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ।

 

সর্বশেষ খবর