সোমবার, ৫ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

চাষাবাদে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির উপায়

ড. মো. জামাল উদ্দিন

চাষাবাদে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির উপায়

কৃষিকে লাভজনক করতে হলে কাজুবাদাম, কফি, গোলমরিচসহ অপ্রচলিত ফসলের চাষ বাড়াতে হবে। পার্বত্য অঞ্চলে কাজুবাদাম, কফি ও মসলা ফসলের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক ১৯ জুন ২০২১ শনিবার বিকালে বান্দরবানে রুমার মুনলাই পাড়ায় কৃষকদের সঙ্গে মতবিনিময় ও বাগান পরিদর্শন শেষে উপরোক্ত কথাগুলো বলেন। তিনি টেকসই কৃষি উন্নয়নে উৎপাদন দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির ওপর জোর দেন। এটা সত্য যে, কৃষিকে লাভজনক করতে উৎপাদন দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণ করার ওপর তাগিদ আছে। কৃষিকে বাণিজ্যিকীকরণ ও লাভজনক করতে বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার নিরলসভাবে কাজ করছেন। তারই ধারাবাহিকতায় কাজুবাদাম ও কফি গবেষণা, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের ওপর একটি নতুন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।

কৃষকের অধিক মুনাফা প্রাপ্তিতে, অধিক জায়গায় চাষ সম্প্রসারণে কৃষকদের আগ্রহী করে তুলতে, জমির বা ব্যবহৃত উপকরণের সর্বোচ্চ ব্যবহার সুনিশ্চিত করতে, বাজার চাহিদা পূরণ করতে, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সর্বোপরি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এ উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি অতীব জরুরি। আধুনিক উৎপাদন ব্যবস্থায় মোট উৎপাদন বৃদ্ধির চেয়ে প্রতি একক আয়তনের জমিতে ফলন বৃদ্ধিকে বেশি গুরুত্ব¡ দেওয়া হয়। কতটুকু সম্পদ বা উপকরণ ব্যবহার করে কী পরিমাণ পণ্য উৎপাদন করা যায় তার অনুপাতকে উৎপাদনশীলতা বলে থাকি। এটা উৎপাদনের দক্ষতাকেও ইঙ্গিত করে। অর্থাৎ কম খরচে অধিক উৎপাদন। অন্য কথায় সর্বনিম্ন ব্যয়ে সর্বাধিক উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত উপকরণের ভারসাম্য রক্ষাই হলো উৎপাদনশীলতা। পাহাড়ে বিদ্যমান কাজুবাদাম চাষের প্রধান চ্যালেঞ্জ কম উৎপাদনশীলতা যা বিশ্বব্যাপী একই সমস্যা।

কাজুবাদাম একটি উষ্ণ মন্ডলীয় ফল যা খরা ও তাপ সহ্য করতে পারে। এটি একটি উচ্চমূল্য ফসল। বর্তমানে বিশ্ববাজারে এর চাহিদা ব্যাপক। দেশের অভ্যন্তরেও এর চাহিদা কোনো অংশে কম নয়। বহুকাল আগে থেকেই পাহাড়ে এ কাজুবাদাম চাষ হতো অনেকটা অবহেলিতভাবে। বর্তমানে বিশ্ব বাজারে এর কদর বাড়ায় সরকার ও বেশ নজর দিচ্ছে। নতুন নতুন প্রকল্প গ্রহণ করছে। কৃষকেরও আগ্রহ সৃষ্টি হচ্ছে। সে আগ্রহকে ধরে রাখতে হলে উৎপাদন দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করা জরুরি। রুমার মুনলাই পাড়ার কাজুবাদাম চাষি লাল দৌঁ চেং বম ও লাল পেক বম এর সঙ্গে আলাপ প্রসঙ্গে জানা যায় তাদের কাজুবাদাম গাছের ফলন যেমন কম তেমনি চলতি বছর ন্যায্যমূল্যও পায়নি। প্রতি মণ খোসাসহ কাজুবাদাম বিক্রি করতে হয়েছে মাত্র ২ হাজার ১০০ টাকায়। তাও আবার মধ্যস্বত্বভোগীদের জিম্মিদশায়। অথচ একই কাজুবাদাম বান্দরবানে স্থানীয়ভাবে প্রক্রিয়াজাত করে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৯০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায়। কৃষক এবং প্রক্রিয়াজাতকারীদের দামের মধ্যে বিস্তর ফারাক। এ ব্যাপারে প্রক্রিয়াজাতকারী তাদের বিভিন্ন খরচের কথা বলে থাকেন। এ ব্যাপারে সরকারে দৃষ্টি দেওয়া উচিত যাতে উপযুক্ত পরিবেশে খরচ কমিয়ে কাজুবাদাম প্রক্রিয়াজাত করতে পারলে প্রক্রিয়াজাতকারীর সংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পাবে তেমনি রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি হবে। তবে প্রক্রিয়াজাতকারীর স্বার্থ দেখা যেমন জরুরি তেমনি কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তির বিষয়টি ভাবাও বেশ জরুরি। নচেৎ কাজুবাদাম চাষে তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। কৃষক উপযুক্ত দাম পেলেই তাদের উৎপাদন দক্ষতা বাড়বে বই কমবে না।

বিশ্বে কাজুবাদাম চাষে প্রতি হেক্টরে গড় উৎপাদনশীলতা ০.৭৫০ মেট্রিক টন। যা আমাদের দেশে ১.৫-১.৮ মেট্রিক টন। এ ব্যাপারে আরও জরিপ চালানো দরকার। এ উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে ২.৮ মেট্রিক টন এ পৌঁছানো সম্ভব। এর জন্য উচ্চ ফলনশীল জাত প্রবর্তন এবং বিদ্যমান জাতের আধুনিক উৎপাদন কলাকৌশল প্রয়োগ জরুরি। বর্তমানে কাজুবাদাম চাষিরা কাজুবাদাম গাছে কোনো সার প্রয়োগ করে না। অথচ উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য সার একটি অন্যতম নিয়ামক। কৃষকদের হাতে কলমে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সঠিক উপায়ে সার প্রয়োগে অভ্যস্ত করে তুলতে হবে। গবেষণার মাধ্যমে কাজুবাদাম গাছের জন্য বয়সভিত্তিক সুপারিশকৃত সারের মাত্রা নির্ধারণ জরুরি। রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণের কারণে উৎপাদনশীলতা কমে যায়। সেসব দমনের যুৎসই প্যাকেজ সহজ বাংলায় রচনা করে কৃষকের হাতে দেওয়া যেতে পারে। নতুনভাবে কাজুবাদামের বাগান সৃজন করলে প্রথম দুই-তিন বছর আন্তফসল হিসেবে অড়হর, ইপিল ইপিল গাছ লাগানো যেতে পারে। তাতে মাটির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি পাবে এবং কৃষকের কিছু বাড়তি আয় হবে। বিদেশ থেকে আমদানিকৃত উচ্চ ফলনশীল কাজু চারা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এর উপযোগিতা যাচাই করা গেলে পরবর্তীতে আর কোনো ঝুঁকি থাকে না। পাহাড়ি এলাকায় সেচের অভাব নিত্যদিনের। এক্ষেত্রে বিকল্প হিসেবে খরা মৌসুমে গাছের গোড়ায় ডিপ মালচিং (জাবড়া) প্রয়োগ করলে ফলন বাড়ার সুযোগ থাকে। উঠান বৈঠক করে কৃষকদের এ বিষয়ে উদ্বুদ্ধ ও দক্ষ করে তুলতে হবে। প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান কতটুকু প্রয়োগ ঘটাচ্ছে সেটা মনিটরিং একান্ত প্রয়োজন। গবেষণার মাধ্যমে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনা সম্ভব। কাজুবাদাম সরবরাহকেন্দ্রিকের পরিবর্তে চাহিদাভিত্তিক হলে ভালো। এর জন্য প্রয়োজন উৎপাদন মাত্রার চেয়ে উৎপাদন দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি। 

লেখক : ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর