রবিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

একটু চাকরির জন্য

হোসেন আবদুল মান্নান

একটু চাকরির জন্য

প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে প্রায় ৩২ বছর চাকরি করে আজ এর সমাপ্তি ঘটল। শুরুর শেষ অনিবার্য। এটি জীবনের সঙ্গে মৃত্যুর সম্পর্কের মতো অবশ্যম্ভাবী। মনে হয়, এই তো সেদিন এর শুরু হয়েছিল, তবু কালের হিসাবে দীর্ঘ তিন দশকের বেশি। অন্যভাবে, অতীতের দিকে তাকালে পৃথিবীতে আগত অগণিত মহামানবের গোটা পার্থিব জীবনকালেরও ঢের বেশি। তবে মহাকালের অদৃশ্য গহ্বরের কাছে তা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণু হিসেবেও বিবেচ্য নয়। তবু জীবনের গাণিতিক হিসাব-নিকাশ করলেই বোঝা যাবে কতটা কার্যকর বা বেহুদা ছিল আমার পেছনের কর্মময় আর বর্ণময় সেই সময়। তাই সফলতা বা ব্যর্থতার নৈর্ব্যক্তিক মূল্যায়নের ভার ছেড়ে দেওয়া যাক অনাগত সময়ের হাতে।

২. ভাবলে প্রায়ই আনন্দে উদ্বেলিত হই, গোটা আশির দশকটি কেটে যায় আমার জীবনের নিশ্চিত-অনিশ্চিতের দোলাচলে। মফস্বলের কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় পা রাখা যেন এক-হাঁটু আবর্জনা-আকীর্ণ অগভীর জলাশয় থেকে সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গে সাঁতার কাটার মতো অসাধ্য সাধন। প্রাচ্য-প্রতীচ্যের আলোচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশালাকৃতির বর্ণিল ক্যাম্পাসের মায়াবী ছায়ায় নিজেই অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার উপক্রম। প্রায় আট বছরের দীর্ঘ বাধা-বিপত্তি, চড়াই-উতরাই, বাঁচা-মরার অমসৃণ পথ পেরিয়ে উচ্চশিক্ষার সামান্য একটু আলোকবিন্দু হাতে নিয়ে কর্মপ্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার মতো এমন দুঃসাহসিক কাজকে মধ্যবিত্তের ভাষায় এক ধরনের বিলাসিতা বলা যায়। তার পরও প্রত্যাশার চেয়ে প্রাপ্তি অধিক এমন বিবেচনায় আপন আরাধ্য কর্মালয়ে আমার সাদা-কালো জীবনকে সঁপে দিয়ে যাত্রা করি।

৩. প্রায় পৌনে ৩০০ বছরের পুরনো এবং বনেদি এক রাজসিক চাকরির গৌরবগাথা শুনতে শুনতে ক্রমেই উচ্চপদে আসীন হয়েছি। মাঠ প্রশাসনের নানাবিধ দায়িত্বে নিজেকে উজাড় করে দিয়ে এর বর্ণাঢ্য অতীতকে সযতেœ লালন ও আগলে রাখার প্রয়াস সর্বদা আমার ছিল। আমি অনেকটা দাবি করেই বলতে পারি, সহকারী কমিশনার ও ম্যাজিস্ট্রেট থেকে বিভাগীয় কমিশনার এবং সরকারের সচিব পর্যন্ত প্রায় সব পদে আত্মমর্যাদা সমুন্নত রেখে দায়িত্ব পালন করেছি। পরিবর্তিত আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও যথেষ্ট মর্যাদাবোধ এবং আত্মতৃপ্তির সমন্বয়েই তা শেষ করেছি।

৪. ঐতিহ্যের ধারক-বাহক প্রশাসন ক্যাডারের সদস্য হয়ে সিভিল সার্ভেন্ট হিসেবে জেলা প্রশাসক ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চট্টগ্রামের চারটি বছর ছিল নিঃসন্দেহে বহুমাত্রিক কর্তব্যবোধে বর্ণাঢ্য। স্মরণের দীপশিখায় আমৃত্যু প্রজ্বলিত হয়ে থাকবে আমার যাপিত জীবনের এ অধ্যায়। বিশেষ করে বন্দরনগর চট্টগ্রামে জেলা প্রশাসক ও পরে বিভাগীয় কমিশনার হিসেবে কাজ করার বর্ণিল অভিজ্ঞতা। বলা বাহুল্য, ১৭৭২ সালে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকালে এ দেশে জেলা প্রশাসনের যাত্রা হলে চট্টগ্রামকে নিয়েই এর গোড়াপত্তন হয়। আগ্রহভরে গণনা করে দেখেছিলাম, প্রথম কালেক্টর ছিলেন ব্রিটিশ নাগরিক (আইসিএস) Mr. John Bentley (১৭৭২-৭৩)। সেই থেকে আমার নিজের ক্রমমান ছিল ১৮৩তম। একইভাবে ১৮২৯ সালে বিভাগীয় কমিশনারের পদ সৃষ্টির সূচনালগ্নে ছিলেন ব্রিটিশ বংশোদ্ভুত  Mr. Nathaniel John Halhed, ESQR এখানে আমার অবস্থান দাঁড়ায় ৯০তম। আরও লক্ষ্য করেছিলাম, আড়াই শতাব্দীর অধিককালে সাবেক পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের দুজন এবং বাংলাদেশ প্রজন্মের সিভিল সার্ভিসের দুজন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনার উভয় পদে আসীন হয়েছিলেন। এমন চারজন বিরল সিভিলিয়ানের একজন আমি। তাই বাঙালির জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এবং স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য আমার গর্বের কোনো সীমা নেই।

৫. টানা তিন দশকের অধিক নানা স্থান ও পদবিতে চাকরি করার অম্লমধুর অভিজ্ঞতার কথা বিভিন্ন সময়ে বলা হয়েছে। সেপ্টেম্ব^র ২০১৭ সালে চট্টগ্রামের কমিশনার হিসেবে যোগদান করে সেদিনই সন্ধ্যায় কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা করি। পরদিন সকালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী বা জোরপূর্বক মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত লাখ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অবস্থান সরেজমিন দেখার জন্য আসবেন। জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় উখিয়ায় সদ্য গড়ে ওঠা মানবেতর ক্যাম্পগুলো পরিদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়। বৈরী আবহাওয়া, হালকা বৃষ্টিপাত ও ঝুঁকিপূর্ণ যাতায়াতের ভিতর দিয়েই কর্মসূচি সফল করা হলো। সেদিন অপরাহ্ণে সার্কিট হাউসে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলারও সুযোগ হয়ে যায়। ডিআইজি মুনিরুজ্জামান মনিও সঙ্গে ছিলেন। পরের দুই বছর পাঁচ মাস আমার কক্সবাজার-উখিয়া-টেকনাফ করে করে ৩৪টি ক্যাম্পের তত্ত্বাবধান, দেশি-বিদেশি গুরুত্বপূর্ণ অতিথির প্রটোকল, সরকারের প্রতিনিধিত্ব করা, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত প্রত্যাবাসনবিষয়ক জাতীয় টাস্কফোর্স কমিটির (Joint working group) ডেপুটি টিম-লিডার হিসেবে একাধিকবার মিয়ানমার ও জেনেভা সফর করি। রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘের বর্তমান মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস (Antonio Guterres) এবং বিশ্বব্যাংক চেয়ারম্যান Jim Yong Kim-এর সান্নিধ্যে যাওয়া হয়েছিল। এমন বিশ্ববরেণ্যদের ব্রিফ করারও এক অনন্য সুযোগ পেয়ে যাই। ক্যাম্প এলাকায় নির্মাণ করি রোহিঙ্গা কো-অর্ডিনেশন সেন্টার (RCC)। জেলা প্রশাসন কক্সবাজারের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক হই। একই কাজে দাতা সংস্থা UNHR থেকে দাফতরিক প্রয়োজনে একটি উন্নতমানের জিপ গাড়ি এবং আর্থিক সম্মানিও প্রাপ্ত হয়েছি। যা আমার পারিবারিক জীবনে খানিকটা আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য এনে দেয়।

৬. সিভিল সার্ভিসের বেলায় এর একটি সফল পরিসমাপ্তি সবারই প্রত্যাশা। আর এটি হলো আমাদের প্রজাতন্ত্রের কর্মের পদ-সোপানের শেষ প্রান্তে পৌঁছার আকুতি অর্থাৎ সচিব পদাধিকারী হওয়া। প্রায় দুই বছরকালের সরকারের সচিবের চাকরিতে প্রীতি ও অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতা আমাকেও বেশ পরিপক্ব ও ঋদ্ধ করেছে। জাতীয় জীবনের ক্রান্তিকালে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব হিসেবে আমার সাড়ে নয় মাসের দায়িত্ব পালন আমৃত্যু স্মরণীয় হয়ে থাকবে। দেশের মানুষের জন্য নিবেদিতপ্রাণ হয়ে কিছু করার আমার আপ্রাণ সচেষ্টতা গণমাধ্যমেও দৃশ্যমান ছিল। সরকারপ্রধান হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীই আমাকে এ সুযোগ করে দিয়েছেন। এ সময়ে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের ভিতরে দেশের এক উদ্যোগী কোম্পানির করোনা ভ্যাকসিন আবিষ্কারের মহতী কার্যক্রম পরিদর্শন করতে গিয়ে আকস্মিকভাবে এর নামকরণ করে দিই বঙ্গভ্যাক্স (Banga-vax)। এতে পরে কোম্পানির পক্ষ থেকে একটি প্রশংসাপত্রও পেয়েছিলাম।

বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে অনেক উদ্যোগের মধ্যে বাঙালির চিরকালীন ঐতিহ্যের স্মারক তথা শতাব্দীর কিংবদন্তি মসলিন শিল্পের পুনরুদ্ধার ও পুনর্জাগরণ নিয়ে কঠোর পরিশ্রম করি। এবং ঢাকার অদূরে তারাবো পৌর এলাকায় গড়ে তোলা হয় ‘ঢাকাই মসলিন হাউস’। মসলিন কাপড় তৈরির ইতিহাস-ঐতিহ্য ধারণ ও সুরক্ষার যাবতীয় আয়োজন করে শীতলক্ষ্যার তীরে নান্দনিকতার ছোঁয়ায় এক অনন্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলি। এমন স্বপ্নেরও মূল চিন্তক, রূপকার ও পরামর্শদাতা বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্মরণ করি স্বামী বিবেকানন্দের কথা- ‘পৃথিবীতে যখন এসেছিস একটা ছোট্ট দাগ রেখে যা।’

৭. যেভাবে লেখাজোখার কারখানার একজন খন্ডকালীন শ্রমিক হিসেবে নাম লেখালাম : ২০১৫ সালের জানুয়ারি। অফিসার্স ক্লাব ঢাকার বার্ষিক সম্মেলন এবং নির্বাচন। সে বছর আমি কোষাধ্যক্ষ পদের প্রার্থী। ইতিপূর্বে ক্লাবের নির্বাহী সদস্য এবং যুগ্মসাধারণ সম্পাদক হিসেবে ইলেকট্রনিক ভোটেও নির্বাচিত হয়েছিলাম। সেবার ক্লাবের নির্বাচনে দাঁড়িয়ে আমাকে প্রচন্ড বিব্রতকর, অসম্মানজনক এবং অপ্রতিরোধ্য অসহযোগিতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। কতিপয় অসংবেদনশীল, অবিবেচক ও অমানবিক স্বগোত্রীয় জ্যেষ্ঠ সহকর্মী নিজ পরিবারকে বিসর্জন দিয়ে অন্য পক্ষকে আনুষ্ঠানিকভাবে আলিঙ্গন করে নিল। এতে যেন আপন গৃহদাহে ঘৃত সংযোগ করে দেয়। দেশের দুটো বড় জেলার জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব পালন শেষে তখন যুগ্মসচিব হিসেবে সদ্য সচিবালয়ে আমার পদায়ন। অসংখ্য কনিষ্ঠ সহকর্মী যারা মাঠ প্রশাসনে কাজ করেছেন তখন তারাও কিংকর্তব্যবিমূঢ়। অনুজপ্রতিম এসব সহকর্মীকে শঙ্কিত ও সংকুচিত হতে দেখেছি। আমার অপরাধ ওনাদের সবার পূর্বসম্মতি বা অনুমতি ছাড়া প্রার্থিতায় অংশ নেওয়া। এ ক্ষেত্রে কেবল অসমর্থন দিয়েই তারা বসে থাকেননি, নির্বাচনের উৎসবমুখরতায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে এবং চোখের পর্দা সরিয়ে ভোটারদের প্রতিটি সারিতে গিয়ে আমার পক্ষে ভোট না দিতে প্রচ্ছন্ন ভীতি প্রদর্শনও করা হয়েছিল। তদুপরি ছুঁইছুঁই সহস্র ভোট আমার পক্ষে আসে। ফলাফলে আমি আনন্দিত এবং একই সঙ্গে বিস্মিত হই। যেখানে প্রার্থী হিসেবে নিজের অস্তিত্ব সংকটই দিনভর দৃশ্যমান ছিল সেখানে এত অগ্রজ-অনুজ সহকর্মী আমাকে বিবেচনায় তুলেছেন! সেদিন মনে মনে কবি নির্মলেন্দু গুণকে স্মরণ করি, ‘কবি নজরুল পরাজিত হলে ক্ষতি কার?’

অতএব, প্রিয় ক্লাবকে দুই হাত ঊর্ধ্বে তুলে প্রণতি জানিয়ে নিভৃতে শাহবাগের পুস্তক বিপণিগুলোয় আশ্রয় নিলাম। যোগ হয় পাঠক সমাবেশ, প্রথমা, তক্ষশিলা, জনান্তিক ইত্যাদিতে নিত্য আনাগোনা। নিবিড় অভিনিবেশ নিয়ে স্পর্শ করতেই বেশ সহযোগিতা করল বিচিত্র ধরনের বইগুলো। এমনকি আমার পক্ষে ডানা প্রসারিত করে প্রকাশ্যে জোরালো সমর্থনও জোগাল তারা। যেখানে কোনো সিনিয়র-জুনিয়র প্রতিপক্ষের উপস্থিতি নেই। এ যেন হঠাৎ আলোর ঝলকানি। বছর দুই বাদে বিভিন্ন দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকীতে আমার নিয়মিত লেখা শুরু। তবে এই নয় যে আগেও ছিটেফোঁটা কিছু লিখিনি। আজকাল সময়ে অসময়েও আমার ঠিকানার বাইরে ঠিকানা পাঠক সমাবেশের দোতলার সিঁড়িতে পা রাখি। বই নেওয়া, পড়া এবং লেখা সমানতালেই চলেছে।

৮. লেখালেখির নিজস্ব একটি ভুবন সৃষ্টি করার একাগ্র প্রয়াস নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার কথা সব সময় ভাবী। এ যাবৎ আমার ভাবনা নিজের দেশ, জনপদ, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, বাংলার প্রকৃতি, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, উপমহাদেশের বরেণ্য রাজনীতিক, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির মৌলিক পৃষ্ঠপোষকতায় নিবেদিতপ্রাণ, মননশীল ব্যক্তিত্বগণের বাইরে যেতে পারেনি। আমরা জানি আমাদের পৃথিবীতে নির্ধারিত গন্ডি বা কোনো অদৃশ্য সীমাবদ্ধতায় আটকে পড়া লেখকের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। আমি মনে করি লেখার বিষয় বা উপজীব্য সব সময় খুঁজে বের করার কাজ নয় বরং একজন লেখকের-চোখে দেখে যেতে পারলেই হলো। বিখ্যাত সৈয়দ মুজতবা আলী বা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বা আমাদের হুমায়ূন আহমেদের তেমন উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলির প্রয়োজন হয়নি। অথচ এদের শৈল্পিক বর্ণনার মায়াবী জালে আটকা পড়ে প্রতিদিন অপার মুগ্ধতায় যাপিত হচ্ছে অগণিত পাঠকের দিনরাত। কখনই একগুঁয়ে নিষ্প্রভ হয়ে ওঠেন না তারা।

৯. সুদীর্ঘ সময়ের চাকরিতে সবারই সুসময়-দুঃসময় থাকে। যেমন ‘চিরদিন সবার সমান নাহি যায়’। এটি বোধকরি দুনিয়ার সর্বত্র কম-বেশি আছে। আকস্মিকভাবে অনাকাক্সিক্ষত স্থানে বদলি, স্বাভাবিক পদোন্নতিবঞ্চিত হওয়া, নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের সাময়িক বিরাগভাজন হওয়া, সন্দেহের চোখে দেখা ইত্যাদি অভিজ্ঞতা থেকেও আমি বঞ্চিত হইনি। এখন ভাবী, এসবেরও দরকার আছে। যেমন- মহামতি সক্রেটিস মৃত্যুর আগে তাঁর অনুরাগী শিষ্যদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘তোমরা আমাকে নিয়ে এত উদ্বিগ্ন কেন! শোনো, ডান্ডাবেড়িরও দরকার আছে।’ (everything relates everything else)। সবকিছুর অভিজ্ঞতাই জীবনকে মহিমান্বিত করে তোলে। বেঁচে থাকার আনুষ্ঠানিকতাকে খানিকটা সমৃদ্ধও করে বইকি।

১০. তবে চাকরিতে একটা অদ্ভুত অমানবিক বিচারিক বিষয়ের নিত্যনৈমিত্তিক পুনরাবৃত্তি দেখেছি এবং মাঝেমধ্যে বেদনাহত হয়েও অব্যক্ত থেকেছি। অবশ্য এর জন্য সরকার একেবারেই দায়ী নয়। পুরো দায় বর্তায় নিজেদের সহকর্মী, বন্ধু বা ব্যাচমেটদের (batch-mate zealously) ওপর। বলা বাহুল্য, আমাদের এ সময়ে সরকারপ্রধান হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের প্রতি অভূতপূর্ব ঔদার্য্য প্রদর্শনপূর্বক এদের যত প্রকার আর্থিক সুযোগ ও পদোন্নতি দিয়েছেন গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহে তা বিরল। শুনেছি, আমরাই আমাদের কাউকে পদোন্নতি না দিতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করি। তখন আমরা স্বাভাবিক বালি না থেকে সূর্যের ভূমিকায় অবতীর্ণ হই। এমন পরিস্থিতিতে বরং বাংলাদেশের মানবিক প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতার মতো করেই বলেছেন, ‘কারও পদোন্নতি আটকানো উচিত নয়, দিয়ে দাও।’ কাজেই কোনো কর্মচারীর সম্পর্কে শুধু জনশ্রুতি বা শোনা কথার (hearsays) ওপর স্থির থেকে তার ভাগ্য বা নিয়তিকে নির্ধারণ করে দেওয়া যায় না। এটি অবশ্যই পীড়াদায়ক এবং দুর্ভাগ্যজনক। তা ছাড়া এমন প্রক্রিয়ার আশীর্বাদে কারও কারও ক্যারিয়ারে অভাবনীয়ভাবে উন্নতি হয় আবার কেউ কেউ অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হন। তবে দিনের শেষে আমরা সবাই ভাগ্যবিধাতা বলেই সান্ত¡না খুঁজি।

আমার চাকরি এবং দাম্পত্য জীবনের সূচনা হয়েছিল একদম একসঙ্গে। সমান্তরালে এগিয়ে যাচ্ছিল উভয় জীবনের সাজানো তরী। বিয়ের সামাজিক অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন করে মাত্র ৭২ ঘণ্টার ব্যবধানে উত্তরবঙ্গের এক সীমান্ত জেলায় চাকরি শুরু করেছিলাম। আমার ৩১ বছরের সাধের সংসার ও পারিবারিক জীবনের হঠাৎ ছন্দপতন ঘটায় বিশ্বব্যাপী চলমান অভিশপ্ত করোনা। আমার প্রিয়তমা স্ত্রীকে হারিয়ে হৃদয়ে অহর্নিশি রিক্ততা অনুভব করি। অন্তহীন আফসোস আমার, অনবরত রক্তক্ষরণ হয় যাঁকে নিয়ে যাত্রা শুরু, শেষ হলো না তাঁর হাত দিয়ে। এখন মনে হয় এমন বর্ণাঢ্য চাকরির অবিচ্ছেদ্য অংশীদারও ছিলেন আমার সহধর্মিণী। ইদানীং প্রায়ই সশব্দে বলে উঠি, পৃথিবীতে ৫০ লাখ বা বাংলাদেশে ২৮ হাজার মানুষ করোনায় মৃত্যুবরণ করেনি। হ্যাঁ, কেবল একজনই গেছেন তিনি আমার অর্ধাঙ্গিনী। তবু আমাদের জীবনের জন্য অনেক মায়া, অনেক ভালোবাসা।

 

                লেখক : গল্পকার।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর