রবিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

জলবায়ুর পরিবর্তন ও ডায়াবেটিসের বিস্তার

মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

জলবায়ুর পরিবর্তন ও ডায়াবেটিসের বিস্তার

দেহে বহু ব্যাধির আহ্বায়ক, নীরব ঘাতক রোগ ডায়াবেটিসের অব্যাহত অভিযাত্রায় শঙ্কিত সবাইকে এটি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে যথাসচেতন করে তুলতে অন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৯১ সালে ১৪ নভেম্বরকে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস হিসেবে পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। বিগত শতাব্দীর শেষার্ধে সংক্রামক ব্যাধিগুলোর নিয়ন্ত্রণে গোটা বিশ্বে সবাই উঠেপড়ে লাগলেও এবং গুটিবসন্ত, কলেরা, যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়ার মতো মহামারী নির্মূলে সফল হলেও মানুষের সুন্দর সাবলীল জীবনযাপনের পথে নীরবে তার সর্বকর্মক্ষমতা হরণকারী অসংক্রামক ব্যাধি ডায়াবেটিসের বিস্তার  ঘটেই চলেছে। তাই এর বিস্তার রোধ ও নিয়ন্ত্রণে ব্যক্তিসচেতনতার অনিবার্যতা এবং এর জন্য সুপরিকল্পিত সর্বজনীন উদ্যোগ গ্রহণে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার আবশ্যকতায় ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনায় বিদ্যমান সমস্যা ও সীমাবদ্ধতাগুলোর প্রতি বিশ্বদৃষ্টি আকর্ষণ এবং সব সরকার ও জনগণের তরফে সংহত ও সমন্বিত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণে ঐকমত্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই বাংলাদেশ ২০০৬ সালে জাতিসংঘকে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণকল্পে প্রস্তাব গ্রহণের আহ্বান জানায়। মূলত বাংলাদেশের প্রস্তাবে এবং যৌক্তিকতার প্রচার-প্রয়াসে ১৪ নভেম্বরকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস হিসেবে ঘোষণা দিয়ে জাতিসংঘ ২০০৭ সালে ৬১/২২৫ নম্বর প্রস্তাব গ্রহণ করে। এবার ২০২১ সালে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসের প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে ‘সবার জন্য সঠিক পরিবেশ : ডায়াবেটিস থেকে আগামী প্রজন্মকে বাঁচান’। বিশ্বব্যাপী উষ্ণতা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে জলবায়ুর যে পরিবর্তন সূচিত হচ্ছে তার সঙ্গে ডায়াবেটিসের বিস্তারের আন্তসম্পর্কটি ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বাতাসে নিঃসৃত কার্বনের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে পরিবেশগত সমস্যায় জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটার প্রমাণ এখনই মিলছে। ২০৫০ সালের মধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ ৫২%-এ বৃদ্ধি পেয়ে বৈশ্বিক তাপমাত্রা আরও ভয়াবহ রূপে বাড়িয়ে পৃথিবীকে বাসের অযোগ্য করে তুলতে পারে। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলেও জলবায়ুর পরিবর্তন ত্বরান্বিত হচ্ছে। দ্রুত ও দুর্বল নগরায়ণের ফলে বিশ্বের অর্ধেক জনসংখ্যা এখন শহরে বাস করে। এখানে আছে যন্ত্রচালিত পরিবহন -ব্যবস্থা, চলছে বস্তির বিস্তার, শরীরচর্চা -বিহীন যাপিত জীবনে বাড়ছে বয়োবৃদ্ধ জনসম্পদ, হচ্ছে বনজ প্রাকৃতিক সম্পদ উজাড়, প্রাণিজ ও সুষম খাদ্যের জায়গা দখল করছে কলকারখানায় প্রক্রিয়াজাত কৃত্রিম অস্বাস্থ্যকর খাবার, পরিবর্তিত হচ্ছে আহার প্রক্রিয়া, বাড়ছে বিশ্ব খাদ্য-কৃষির ব্যবসা ও বিপণনে প্রতিযোগিতা। ২০৩০ সালের মধ্যে ৮ বিলিয়ন বিশ্ব জনসংখ্যার ৫ বিলিয়ন বাস করবে শহরে যার মধ্যে ২ বিলিয়ন বাস করবে বস্তিতে। ফলে জীবনযাত্রায় জটিলতা বাড়তেই থাকবে, উন্নয়নশীল দেশগুলোয় সামাজিক নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য -ব্যবস্থা নানান অনিয়মের ও ব্যবস্থাপনার কাছে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হতে থাকবে। ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্ব জনসংখ্যা ৭ থেকে ৯ বিলিয়নে বৃদ্ধি পাবে এবং এশিয়া ও আফ্রিকাতেই ঘটবে এর ব্যাপক বিস্তার। সার্বিকভাবে বিশ্ব জনসংখ্যায় প্রবীণের প্রাধান্য পেলেও উন্নয়নশীল দেশে নবীনের পাল্লা হবে ভারী। জনমিতিতে এহেন অসম পরিবর্তন-প্রবণতায় ইতিমধ্যে সম্পদের অপ্রতুলতায় পরিবেশ দূষণে নানান রোগের প্রাদুর্ভাব ও বিস্তারকে প্রভাবিত করছে। এ পটভূমিতে বর্তমানে বিশ্বে ৩৬৬ মিলিয়ন মানুষ ডায়াবেটিসে ভুগছে। ২০৩০ সাল নাগাদ এর পরিমাণ অর্ধ বিলিয়নে দাঁড়াবে। বছরে ৪.৬ মিলিয়ন মানুষ এ রোগে মারা যায়। ডায়াবেটিসে সবচেয়ে বড় ক্ষতি কর্মক্ষমতা হারানো। এ রোগের পেছনে বার্ষিক ব্যয় হয় ৪৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। পাঁচজনের মধ্যে চারজন ডায়াবেটিস রোগী বাস করে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোয়। এ রোগ পরিবারকে অসচ্ছল করে, শ্রমশক্তি বিনষ্ট করে ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা পর্যুদস্ত করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমীক্ষামতে নগরায়ণ, ‘ওয়েস্টার্ন ফুড’ আর সার্বিক পরিবেশের ভারসাম্যহীনতায় এ রোগের বিস্তারকে করছে বেগবান। বিশ্ব রোগ নিরাময় কেন্দ্রের মতে এ শতকের মাঝামাঝি তক পৌঁছার আগেই এটি মানবভাগ্যে মারাত্মক মহামারীরূপে দেখা দেবে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ডায়াবেটিক তথ্য নিকাশ কেন্দ্রের হিসাবমতে খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই এ ঘাতকব্যাধি বছরে ১৩২ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিসাধন করে সে দেশের জাতীয় অর্থনীতির। বাংলাদেশে ডায়াবেটিস চিকিৎসা আন্দোলনের পথিকৃৎ জাতীয় অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম (১৯১৭-১৯৮৯) ১৯৫৬ সালে সেগুনবাগিচায় নিজের বাসভবনের আঙিনায় ছোট টিনের ঘরে দেশের ডায়াবেটিস চিকিৎসার যে উদ্বোধন ঘটিয়েছিলেন আজ তাঁর সেই প্রতিষ্ঠান জাতির গর্বের প্রতীক ‘বারডেম’। বারডেম এশিয়া-প্রশান্ত অঞ্চলে ডায়াবেটিস চিকিৎসার মডেল বা সেরা কেন্দ্র এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৮২ সাল থেকে এ প্রতিষ্ঠানকে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণার ক্ষেত্রে তাদের একান্ত সেরা সহযোগী সংস্থা হিসেবে স্বীকৃতি, সম্মান ও সমীহ করে আসছে। অনেক মেজর রোগ থাকতে এ রকম একটা মাইনর রোগ নিয়ে তিনি আলাদা চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন করতে চান কেন- সে সময় প্রায়ই এ ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হলে ডা. ইব্রাহিম বলতেন, ‘রোগটা মোটেই মাইনর নয়। কারও যেদিন ডায়াবেটিস হবে সেদিনই বুঝতে হবে যে ওই লোকটা অন্ধ হয়ে যাবে, কিংবা প্যারালাইসিস হয়ে যেতে পারে বা তার হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। কিন্তু যদি যথারীতি চিকিৎসা ও পরিচর্যার ভিতরে একে রাখা যায় তাহলে আজীবন সে সুস্থ থাকবে। রোগীর হয়তো ৩০-৪০ বছর বয়স- ১০ বছরের মধ্যেই তার সবকিছু অকেজো হয়ে যাবে, কিন্তু যথারীতি চিকিৎসা ও পরিচর্যা করলে এবং নিয়ম মেনে চললে সে ৬০ বছর পর্যন্ত সুস্থ থাকবে এবং প্রায় স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবে।’ এ প্রসঙ্গে উপমা দিয়ে তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘আমরা গাড়ি বিকল হলে তবে গ্যারেজে সারাই করতে আনি, এটা বোকামি, সময় থাকতে যদি নিয়মিত মেইনটেন বা চেকআপ করানো হতো তাহলে হয়তো গাড়ি গ্যারেজে আনার প্রয়োজনই পড়ত না।’

তিনি ব্রত গ্রহণ করেন ‘দেশের কোনো ডায়াবেটিস রোগীকে বিনা চিকিৎসায় কর্মহীন হয়ে অসহায়ভাবে করুণ পরিণতির দিকে যেতে দেওয়া যাবে না। চিকিৎসাব্যয় বহনের ভার নিয়ে হলেও সবাইকে এ রোগ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করতে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা থাকবে।’ তাঁর এ মিশন ও ভিশনের পতাকা তাঁরই গড়া বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি (বাডাস) দৃঢ় প্রত্যয়ে অত্যন্ত সযতেœ বহন করে চলেছে।

লেখক : সরকারের সাবেক সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান।

সর্বশেষ খবর