রবিবার, ২৭ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

নিজামুদ্দিন আউলিয়ার মাজারে মির্জা গালিব ও জাহানারা

নঈম নিজাম

নিজামুদ্দিন আউলিয়ার মাজারে মির্জা গালিব ও জাহানারা

দিল্লি কি আসলে অনেক দূর? এখন বিমানে আমরা কত সহজে যাতায়াত করি। মাত্র দুই ঘণ্টা আকাশপথে। ভাবতে অবাক লাগে মুঘল আমলে কঠিন যোগাযোগব্যবস্থার সময় কী করে তাঁরা শাসনকাজের সমন্বয় করতেন। হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়ার (রহ.) মাজার জিয়ারত করতে গিয়ে অনেক ভাবনা তৈরি হয় এবার। নিজামুদ্দিনে আরও কিছু সমাধি আছে। খুঁজে খুঁজে তাঁদের কবর জিয়ারত করলাম। বুকে জমাটবাঁধা কষ্ট নিয়ে নিজামুদ্দিনে শুয়ে আছেন মির্জা গালিব। যাঁর উর্দু, ফারসি কবিতা সবাইকে মুগ্ধ করে। মির্জা গালিব লিখেছেন, ‘জান দি দি হুয়ি উসি কি থি/হত তো য়ে হ্যায় কি হক আদা না হুয়া’, অর্থাৎ ‘যে প্রাণ দিলাম তোমায় সে তো তোমারই দেওয়া/আসল কথা এই- তোমাকে কিছুই দেওয়া হলো না।’ দুই দিনের জগৎ-সংসারে চাওয়া-পাওয়ার হিসাবগুলো জটিল। নিজামুদ্দিন আউলিয়ার মাজারে মানুষের ভিড় থাকে ২৪ ঘণ্টা। সব ধর্মের মানুষ এখানে আসেন, ভিড় করেন। কেউ জিয়ারত করেন। কেউ দেখেন। নিজামুদ্দিনকে উসিলা রেখে অনেকে প্রার্থনা করেন সৃষ্টিকর্তার কাছে। পাশেই গালিবের কবর। এ মাজার এলাকায় আরও একজনের সমাধি আছে তিনি জাহানারা। সম্রাট শাহজাহানের কন্যা। মৃত্যুর আগে পৃথিবীর মানুষের ওপর তাঁর ছিল বুকভরা অভিমান আর কষ্ট। হিংসার দুনিয়ায় ক্ষমতার লড়াই তাঁর মধ্যে সুফিভাব তৈরি করে। জাহানারা ও গালিবের সমাধি খুঁজে পেতে সমস্যা হয়েছিল। মাজারের প্রবেশমুখে গালিব রিসার্চ সেন্টারের পেছনেই এ সমাধি দুটি। ধুলোবালি জমে আছে অনেক বছর। কেউ এদিকে আসে না। পরিষ্কার করারও লোক নেই। গালিবের সমাধির পাশে বিশাল চেহারার একজন রোদে বসে গায়ে তেল মালিশ করছেন। আলাপ-পরিচয় হলো। জানালেন তিনি কলকাতার বাঙালি মুসলমান। ট্যাক্সি চালান। রাতে থাকেন মাজারে। গালিবের কবর জিয়ারত করলাম। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলাম অতৃপ্তি নিয়ে জীবন কাটানো এ কবির জন্য। আক্ষেপ নিয়ে গালিব সারাটা জীবন কাটিয়েছেন আর্থিক সংকট, শরাব আর জুয়ার নেশায়। জীবিতকালে তাঁর মূল্যায়ন পৃথিবীর মানুষ ততটা করেনি। মৃত্যুর পর দিন দিন তিনি উজ্জ্বল আলো ছড়াচ্ছেন পৃথিবীর বুকে। তাঁর কবিতা বিশে^র অনেক দেশেই গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। জনপ্রিয়তাও বেড়েছে উপমহাদেশে।

১৭৯৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর জন্ম নেন আসাদুল্লাহ বেগ খান গালিব। মৃত্যুর আগে রামপুর রাজ্যের সভাকবি ছিলেন। ১৮৬৬ সালে রামপুর থেকে ফেরেন দিল্লি। শরীরটা ধীরে ধীরে খারাপ হতে থাকে। ১৮৬৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে জ্ঞান হারান। এক দিন পর ১৫ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে সমাহিত করা হয় নিজামুদ্দিন আউলিয়ার মাজার এলাকায়। গালিব লিখেছেন, ‘বাজিচায়ে আতফাল হ্যায় দুনিয়া মেরে আগে/হোতা হ্যায় সব রোজ তামাশা মেরে আগে’, অর্থাৎ ‘আমার সামনে পৃথিবীটা যেন বাচ্চাদের খেলার মাঠ, প্রতিটি রাত আর দিনে কেবল তামাশাই ঘটে যাচ্ছে।’ আর্থিক দেনা, মদপান, জুয়া খেলা নিয়ে গালিব জীবনে বারবার মহাবিপর্যয়ে পড়েন। পাওনাদারদের মামলায় একবার তাঁকে যেতে হলো জেলখানায়। জেলখানায় গালিব দেখলেন এক যুবক ঝরঝর করে কাঁদছে।

গালিব তার কাছে প্রশ্ন করলেন, তুমি কাঁদছো কেন? যুবক বলল তার তিন দিনের জেল হয়েছে। গালিব হাসলেন। তারপর বললেন, একবার চিন্তা কর যাকে বছরের পর বছর জেলে কাটাতে হয় তার কথা। গালিবকেও তিন মাস জেলে কাটাতে হয়েছিল। জেল থেকে বের হতে সহায়তা করেন মৌলানা নাসিরুদ্দিন। এরপর সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের কাছে সুপারিশ করে দরবারে ইতিহাস লেখকের চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। ১৮৫০ সালে বাদশাহ তাঁকে তৈমুর বংশের ইতিহাস লেখার কাজ দেন। বছরে বরাদ্দ ৬০০ টাকা। আলাদা ভাতারও ব্যবস্থা করা হয়। এ সুখের সময় বেশি দিন ছিল না। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ বাহাদুর শাহের পাশাপাশি গালিবের জীবনে আবার বিপর্যয় এনে দেয়। গালিব ইংরেজ শাসকদের কাছে আবেদন করেন পেনশনের জন্য। ১৮৬০ সালে পুনরায় চালু হয় পেনশন। যোগ দেন দরবারে। সরকার থেকে পাওয়া পারিবারিক পেনশনের টাকা তুলতে তাঁকে সব সময় লড়তে হয়েছে। ১৮২৮ সালে কলকাতা আসেন গালিব। বছরখানেক ছিলেন। কলকাতায় গালিবের নামে একটি সড়কও আছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার গালিবকে সম্মান জানিয়েছে।

গালিব ছাড়াও নিজামুদ্দিনে শুয়ে আছেন সম্রাট শাহজাহানের মেয়ে জাহানারা। তাঁর সমাধি খুঁজে বের করতে কষ্ট হয়েছে। সমাধিতে লেখা- ‘বেগায়র সবজা না পোশদ বসেমাযারে মারা/কে কবর পোশে গরিবান গিয়াহ বসন্ত’, অর্থাৎ ‘আমার সমাধিতে ঘাসই জন্ম নিক। ফকিরের সমাধিতে ঘাসই যথেষ্ট।’ কিন্তু জাহানারার সমাধিতে এখন ঘাস নেই। পাথরের সমাধিতে ঢেকে গেছে মাটি। বুকভরা কষ্ট ছিল জাহানারার। ভাইয়ের হাতে বাবার বন্দিজীবন কোনোভাবে মানতে পারতেন না। বন্দি শাহজাহানকে দেখভাল করতেন জাহানারা। শেষ বয়সটা বাবার পাশেই কাটে তাঁর। মা মমতাজমহল মৃত্যুর আগে মেয়েকে অসিয়ত করে গিয়েছিলেন বাবাকে দেখে রাখতে। সে অঙ্গীকার রক্ষা করেন। রাজদরবার তাঁকে টানেনি ভাই আওরঙ্গজেবের অনুরোধের পরও। প্রথম জীবনে জাহানারার গভীর প্রেম ছিল এক যুবকের সঙ্গে। কিন্তু সে প্রেম পিতা মেনে নেননি। নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছিল জাহানারার প্রেমিককে। তার পর থেকে জাহানারা মাঝেমধ্যে কবিতা লিখতেন। পিতার জীবিতকালে ভাইদের ক্ষমতার লড়াই তাঁকে ব্যথিত করেছিল। কষ্ট দিয়েছিল। মসনদের লড়াইয়ে আওরঙ্গজেব ভাইদের সবাইকে হারান। নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেন দারাকে। দারার খণ্ডিত মাথা প্লেটে সাজিয়ে পিতার কাছে পাঠিয়েছিলেন আওরঙ্গজেব। আঁতকে ওঠেন জাহানারা। এ ঘটনা বদলে দেয় জাহানারাকে। তাঁর মধ্যে আধ্যাত্মিকতা ভর করতে থাকে। দীন-দুনিয়ার প্রতি আগ্রহ হারান। জীবনের সব বিলাসিতা ভুলে ছবি আঁকতেন। কবিতা লিখতেন। আওরঙ্গজেবের ধারণা ছিল ভাই দারাকে ক্ষমতায় বসাতে চান বাদশাহ শাহজাহান। বন্দি করেন শাহজাহানকে। অভিযোগ আনেন ক্ষমতার অপব্যবহার করে, রাজকোষের অর্থের অপব্যবহার করে তাজমহল নির্মাণের। যমুনার তীরে দুটি তাজমহল করতে চেয়েছিলেন শাহজাহান। একটি করতে পেরেছিলেন। আরেকটি শুরুর পরই বিপত্তি বাধে। পুত্রদের ক্ষমতার লড়াই শুরু হয়। যার শেষ পরিণতি ছিল ভয়াবহ। শাহজাহানের অমর সৃষ্টি দেখতে সারা দুনিয়ার মানুষ এখন ভিড় করে আগ্রায়। অথচ সেই সৃষ্টির খেসারত অন্যভাবে দিতে হয়েছিল তাঁকে। আগ্রা ফোর্টে বন্দি থাকা অবস্থায় শাহজাহান নীরবে অশ্রু ফেলতেন। চাঁদনি রাতে জোছনার আলোয় যমুনায় মায়াবী ছায়া তৈরি করত তাজমহল। অশ্রুজলে কন্যা জাহানারার বুকে মাথা রেখে অসহায় বাদশাহ আবৃত্তি করতেন কবিতা। কারাবন্দি শাহজাহানের দেখার দায়িত্বে ছিলেন আওরঙ্গজেবের এক পুত্র। দাদার প্রতি অধিক সহানুভূতিশীল থাকায় আওরঙ্গজেব এ পুত্রকেও শাস্তি দিয়েছিলেন।

ইতিহাসের আড়ালে সব সময় একটা নিষ্ঠুর অধ্যায় থাকে। আওরঙ্গজেবের ন্যায়পরায়ণতা নিয়ে শাসনের সঙ্গে তাঁর ক্ষমতা দখলের নিষ্ঠুরতা মেলে না। তবে বোন জাহানারার প্রতি একটা বিশেষ শ্রদ্ধাবোধ ছিল আওরঙ্গজেবের। মুঘল হেরেমের অভ্যন্তরীণ চক্রান্তে শাহজাদা দারাশিকোর কথায় আওরঙ্গজেবকে একবার সুবাদারি পদ থেকে সরিয়ে দেন সম্রাট শাহজাহান। জাহানারা এ নিয়ে কথা বলেন বাবার সঙ্গে। বাবাকে জানান, দারাশিকো নিজের স্বার্থে ভুল তথ্য দিয়েছে সম্রাটকে। জাহানারার সুপারিশে সে পদ ফিরে পেয়েছিলেন আওরঙ্গজেব। ক্ষমতার মসনদে বসে বোনের সেই উপকারের কথা ভুলে যাননি আওরঙ্গজেব। জাহানারা বিত্তশালী ছিলেন ব্যক্তিগতভাবেও। তিনি সে যুগে ইউরোপে জাহাজে করে পণ্য আনা-নেওয়ার ব্যবসা করতেন। দিল্লির চাঁদনিচকের পরিকল্পনা জাহানারার। এ ছাড়া পারিবারিক সম্পদ তো ছিলই। ক্ষমতার নিষ্ঠুরতা জাহানারাকে পুরোপুরি বদলে দেয়। বাবার মৃত্যুর পর সুফি ভাবধারায় চলে যান তিনি। সম্পদের অভাব ছিল না। সব ছেড়ে দেন। দান করতেন দুই হাতে। জগৎ-সংসারের প্রতি মোহ কেটে যায়। মৃত্যুর আগে জাহানারা অসিয়ত করেছিলেন তাঁকে যেন নিজামুদ্দিনে দাফন করা হয়। পরকালে তিনি একটু শান্তি চান। সাদামাটা দাফন চান। রাজকীয় মর্যাদা চান না। জাহানারার শেষ ইচ্ছায় তাঁকে দাফন করা হয় নিজামুদ্দিনে। জাহানারার বয়স যখন ১৭ তখন তাঁর মা মমতাজমহলের মৃত্যু হয়। আর ১৬৮১ সালে জাহানারা মারা যান। নিজের আত্মজীবনীতে তিনি লিখে গেছেন, ‘আমি আজ সম্রাট বাবরের কথা স্মরণ করছি। আমার আপন আত্মার মতো বিশ্বস্ত কোনো বন্ধু পাইনি। আমার নিজ অন্তর ব্যথিত। আমি কোনো নির্ভরযোগ্য স্থান পাইনি।’ মৃত্যুর আগে এক সাক্ষাৎকারে এমন একটা আক্ষেপ নায়িকা কবরীও করেছিলেন।

বাদশাহ থেকে ফকির- মানুষের এক জীবনে চাওয়া-পাওয়ার হিসাব কখনই মেটে না। শান্তি ও স্বস্তির সন্ধানে জীবনভর শুধু লড়াই করে যায়। স্বস্তি মেলে না। বুকের ভিতরটা বেদনার নীল জলে শুধুই সাঁতার কাটে। করোনা মহামারি এবার জানিয়ে দিয়েছে মানুষের নিষ্ঠুরতা আদিযুগের মতোই এখনো ভয়াবহ। হিংসা, বিদ্বেষ, যুদ্ধ, দুনিয়ায় সবকিছুই বেড়েছে। ভেবেছিলাম এ লেখাটা শেষ করব হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়াকে দিয়ে। সুলতান গিয়াসুদ্দিন তুঘলকের মতো শাসককে তিনি মোকাবিলা করেন দিল্লিতে অবস্থান করে। কী কারণে বলেছিলেন দিল্লি অনেক দূর- সেসব কথা আনব। মানুষকে দুই হাতে দান করতেন নিজামুদ্দিন আউলিয়া। জীবনভর লড়েছেন মানুষের জন্য। তাঁর কাছে গেলে কেউ খালি হাতে ফিরত না। এ কারণে মৃত্যুর পরও নিজামুদ্দিন আউলিয়ার মাজারে মানুষের ভিড়। আজমিরের মতো এখানেও ধর্মের ভেদাভেদ নেই। খাজা মাইনুদ্দিন চিশতির (রহ.) মাজারে সব ধর্মের মানুষের ভিড় আছে। আবার নিজামুদ্দিনেও একই চিত্র। আজমির গিয়েছিলাম সর্বশেষ ২০০৫ সালের অক্টোবরে। তারপর আর যাওয়া হয়নি। আজমিরেও সব ধর্মের মানুষ দলে দলে যান মানত পূরণ করতে। সিলেটে হজরত শাহজালালের (রহ.) মাজারেও সব মানুষের ভিড় দেখেছি। একবার মুম্বাই হাজি আলি শাহ বুখারির (রহ.) মাজারে গিয়েছিলাম। তিনি ইসলাম প্রচারে কাজ করেছেন। মৃত্যুর আগে হজ করতে গিয়েছিলেন। সেখানেই মারা যান। মিথ আছে- তিনি মৃত্যুর আগে অসিয়ত করেন তাঁর লাশ আরব সাগরে ভাসিয়ে দিতে। শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তা-ই করা হয়। লাশ আরব সাগরে ভাসতে ভাসতে দক্ষিণ মুম্বাই ওরলি উপকূলে এসে থামে। এখানে তিনি ধর্ম প্রচারে জীবন কাটিয়েছিলেন। এখানেই তাঁকে দাফন করা করা হয়। সমুদ্রের ভিতরের অংশে এ মাজার। কিন্তু ঝড়-বাদলের পানির ভিতরে কখনো ডোবেনি।

ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে অনেক সময় আশপাশের এলাকা তলিয়ে গেলেও আলি শাহের মাজারের কিছু হয়নি। আল্লাহর দুনিয়ায় অনেক রহস্য ছিল, আছে। অনেক মিথ নিয়েই হাজি আলির মাজারে সব ধর্মের মানুষ ভিড় করেন। শাঁখা-সিঁদুর পরা অনেক নারীকে দেখেছি। গেরুয়া পরা অনেক পুরুষ দেখেছি। হিন্দুসহ ভিন্ন ধর্মের মানুষ মাথা ঠোকান মাজারে। মুসলমানরা করেন জিয়ারত। অনেক বিত্তশালী গিলাফ বদল করেন। যার যার বিশ্বাস। কবি বলেছেন, বিশ্বাসে মেলায় বস্তু তর্কে বহুদূর। সব বিষয়ে অনেক কথা আছে। কিন্তু যার যার বিশ্বাস তার তার।

লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

সর্বশেষ খবর