শুক্রবার, ৮ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে অপ্রচলিত পদক্ষেপ

মেজর আখতার (অব.)

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে অপ্রচলিত পদক্ষেপ

বাংলাদেশ ২০২০ সালে ৫২.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য আমদানি করেছিল। ২০১৬ সালে আমদানি হয়েছিল ৪৪.৭৭ বিলিয়ন যা বেড়ে ২০১৮ সালে পৌঁছেছিল ৬০.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। তার মানে আমাদের বার্ষিক আমদানি খরচ মোটামুটি বলা যেতে পারে ৬১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা তার কাছাকাছি। ২০২০ সালে আমাদের নেট বার্ষিক আয় ছিল ২.৭৭৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আমাদের বর্তমান রিজার্ভ ৪৮.০৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আমরা ২০২০ সালে যেসব দ্রব্য আমদানি করেছি তার একটি হিসাব বিলিয়ন মার্কিন ডলারে এবং মোট আমদানির শতকরা কত ভাগ তা এখানে ক্রমহারে তুলে ধরা হলো। তুলা ৪.৯ যা মোট আমদানির ১০.৫%, কম্পিউটারসহ মেশিনারিজ ৪.৮ যা মোট আমদানির ১০.৩%, খনিজ তেল ৩.৬ যা ৭.৯%, বৈদ্যুতিক মেশিনারিজ ও ইকুইপমেন্ট ৩.৩ যা ৭.১%, আয়রন ও স্টিল ২.৪ যা ৫.২%, প্লাস্টিক ও প্লাস্টিক দ্রব্যাদি ২ যা ৪.৪%, খাদ্যশস্য ১.৭ যা ৩.৭%, পশু/উদ্ভিজ্জ ফ্যাট, তেল ও মোম ১.৩ যা ২.৯%, নিট ও ক্রোচেট ফেব্রিক্স ১.৩৪ যা ২.৯% ও কৃত্রিম আঁশ ও সুতা ১.৩৩ যা ২.৯%। মোটামুটি এ ১০টি দ্রব্যই বড় আকারে আমদানি করা হয়। উল্লিখিত এ ১০টি দ্রব্য বাবদ মোট আমদানি খরচ হয় ২৬.৬৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কম বা বেশি। এখন সরকার যদি আমদানি ব্যয় বিবেচনায় নিয়ে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে কোনো বিশেষ পদক্ষেপ নিতে পারে তাহলে অনেকের ধারণা দ্রব্যমূল্য অনেকটা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা সম্ভব। আমি এ ব্যাপারে একটি গাণিতিক এক্সারসাইজ করতে চাই যার মাধ্যমে দেখাতে চাই দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনা যায় কীভাবে। প্রথমে আলোচনা করতে চাই বিদেশি মুদ্রার বিনিময় হার কীভাবে ক্রমাগত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে যাচ্ছে। বিদেশি মুদ্রার বিনিময় দর টাকায় ক্রমাগত বৃদ্ধি করার ফলে টাকার মূল্য কমে যেমন মুদ্রাস্ফীতি বাড়াচ্ছে তেমনি বাজারে অসম চাহিদা বৃদ্ধি করছে। বিদেশি মুদ্রার উচ্চমূল্য ধরে রাখার জন্য টাকার সরবরাহ বাড়াতে হয়, তাতে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যায়। আবার বিদেশি মুদ্রার বিনিময় টাকায় বেশি হওয়ায় কিছু মানুষের কাছে কৃত্রিম আয় বেড়ে যায়, ফলে বাজারে অনেক বাড়তি চাহিদা তৈরি হয় যা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে সরাসরি সহায়তা করে।

আমরা সবাই জানি দ্রব্যমূল্য অস্থিতিশীল হওয়ার পেছনে মূলত দুটি কারণ- যথা চাহিদা ও মুদ্রাস্ফীতি। তবে দুটি কারণই নিয়ন্ত্রণযোগ্য। যেমন সরবরাহ বাড়িয়ে বা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করেও চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কিন্তু আমরা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে চাহিদা নিয়ন্ত্রণের পক্ষে নই। বরং আমরা কম মূল্যে সরবরাহ বৃদ্ধি করে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের পক্ষে। আবার মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণ করা যায় মুদ্রার সরবরাহ বাড়িয়ে অথবা মুদ্রার মূল্য কমিয়ে দিয়ে। আমি মুদ্রার সরবরাহ বাড়িয়ে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে চাই না। কারণ তাতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গিয়ে শেষ পর্যন্ত দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করতেই সহায়তা করবে। আমি বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে এবং সুনির্দিষ্ট পণ্যের বেলায় বিদেশি মুদ্রার মূল্য কমিয়ে দিতে চাই অথবা সম্ভব হলে বিদেশি মুদ্রার বিনিময় হার যথেষ্ট পরিমাণ নিচে নামিয়ে আনতে চাই যাতে একই পরিমাণ বিদেশি মুদ্রায় বেশি পণ্য পাওয়া যায়। বিদেশি মুদ্রার বিনিময় হার কমিয়ে দিলে বিদেশি সরবরাহ- উৎপাদন-কারীদের বিক্রয়মূল্যে কোনো হেরফের এবং তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। আবার রেমিট্যান্সের ফলে তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না এবং বিদেশি মুদ্রায় তাদের আয়ও কমবে না এবং প্রাথমিকভাবে সমস্যা হলেও দীর্ঘমেয়াদে তা সুফল বয়ে আনবে। তবে তাতে আমাদের রপ্তানিকারকরা সাময়িক ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন কিন্তু জাতির বৃহত্তর স্বার্থে তাদের সাময়িক ক্ষতি মেনে নিলে দীর্ঘমেয়াদে তারাও লাভবান হবেন। বিদেশি মুদ্রার বিনিময় হার টাকায় কমিয়ে দিতে পারলে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং মুদ্রাস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হবে। যেমন এখন মার্চের শেষের দিকে মার্কিন ডলারের মূল্য ৮৬.২২ টাকা। এখন যদি মার্কিন ডলারের মূল্য ৭০ টাকা থাকত তাহলে আমরা ১ মার্কিন ডলার মূল্যে কেনা দ্রব্য ৮৬.২২ টাকার জায়গায় ৭০ টাকায় পেতাম। তার মানে আমরা ১৬.২২ টাকা কম মূল্য দিয়ে একই পরিমাণ বিদেশি পণ্য কিনতে পারতাম। এতে বিদেশি পণ্য রপ্তানিকারকের কোনো ক্ষতি হতো না অথচ আমাদের ১৬.২২ টাকা সাশ্রয় হতো। আমাদের বাজার মূলত আমদানিনির্ভর। আমরা যদি বিদেশ থেকে কম মূল্যে কিনতে পারি তাহলে আমাদের বিক্রয় মূল্যও কমে যাবে। কিন্তু ঢালাওভাবে বিদেশি মুদ্রার টাকার বিনিময় হার বাড়িয়ে দিলে সরকারের আয়ও বেড়ে যায়, ফলে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক ধরনের কায়েমি স্বার্থে টাকার মূল্য ক্রমান্বয়ে কমাতে থাকে। যেমন বলা যায় যদি প্রতি বছর ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা তার সমমূল্যের আমদানি হয় এবং সেখানে যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৫ টাকা বিদেশি মুদ্রার বিনিময় হার টাকায় বাড়িয়ে দেয় তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বছরে ২৫০ বিলিয়ন টাকা আয় করতে পারে যা দেশি হিসাবে ২৫ হাজার কোটি টাকা যা আমাদের মোট রাজস্বের ৬%-এর বেশি। ২০২০ সালে আমাদের মোট রেমিট্যান্স বাবদ আয় ছিল ২৪.৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের। সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি টাকার অবমূল্যায়ন করায় ৫ টাকা আয় আসে তাহলে রেমিট্যান্স থেকে আয় আসবে আরও ১২৩ বিলিয়ন টাকা বা ১২.৩ হাজার কোটি টাকা। আবার আমরা প্রতি বছর প্রায় ৭ বিলিয়নের মতো বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণ পাই এবং সেখান থেকে অতিরিক্ত আয় হয় ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।

এই গেল টাকার অবমূল্যায়ন করে সরকারের বাজেটবহির্র্ভূত আয়। এ আয় বাজেটে দেখানো হয় না। এ আয় থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বছরে ১০-১২টি বোনাস পান। এ টাকার অপচয় তো আছেই, যা শুধু সংশ্লিষ্টরাই ভোগ করেন।

বিদেশি মুদ্রার বিনিময় হার অবমূল্যায়নের আরেক সুবিধাভোগী হলো জাতীয় রাজস্ব বিভাগ। তারা আমদানি দ্রব্যের ওপর বিভিন্ন হারে টাকায় শুল্ক ধার্জ করেন। টাকার মূল্য কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টাকায় শুল্কের পরিমাণ বাড়ে তাতে সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি পায় কিন্তু তাতে সরাসরি দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায়। এ বর্ধিত মূল্য কোনো আমদানিকারক, বিদেশি রপ্তানি বা উৎপাদনকারক, পাইকারি বা খুচরা কোনো ব্যবসায়ী পান না। এটি সরাসরি সরকারি কোষাগারে জমা হয়। এ মূল্য বৃদ্ধির জন্য একান্তভাবেই সরকার দায়ী।

সরকার ইচ্ছা করলেই এখানে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সরকার যদি ইচ্ছামতো টাকার অবমূল্যায়ন না করে তাহলে অবশ্যই দ্রব্যমূল্য অনেকটা নিয়ন্ত্রণে থাকবে। সরকারের গৎবাঁধা ভাষ্য হলো, যদি টাকার অবমূল্যায়ন না করা হয় তাহলে নাকি দেশের রপ্তানি আয় কমে যাবে। এটি সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ বাস্তব তথ্য নয়। এ বিষয়ে গভীর সমীক্ষা চালালে মূল তথ্য বেরিয়ে আসবে।

২০২০ সালে আমরা মোট রপ্তানি করেছি ৩৯.৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের। এখানেও টাকা অবমূল্যায়ন করে সরকার আয় করেছে যা সরাসরি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ ঘটিয়েছে। যা হোক ৩৯.৫০ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের বিপরীতে ৮৬.২২ টাকা বিনিময় হারে আমরা মুদ্রা আয় করেছি ৩ লাখ ৪০ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা। একই বছর আমরা আমদানি করেছি ৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণ যা টাকার বিনিময় হার ৮৬.২২ টাকা হিসেবে মোট আমদানি ৪ লাখ ৪৮ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা। ওই বছর টাকায় আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ১ লাখ ৭ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা। অথচ আমরা যদি টাকার অবমূল্যায়ন না করে ডলারপ্রতি ৭০ টাকা ধরে রাখতাম তাহলে একই ডলারের বিপরীতে আমাদের রপ্তানি বাবদ আয় হতো ২ লাখ ৭৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। একই বছরে আমদানি বাবদ ব্যয় হতো ৩ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা এবং বাণিজ্য ঘাটতি হতো ৮৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ২০ হাজার ২৭৫ কোটি টাকার বাণিজ্য ঘাটতি কম হতো। যদি মার্কিন ডলারের মূল্য ৭০ টাকায় ধরে রাখতে পারতাম তাহলে আমরা টাকায় সাশ্রয় করতে পারতাম ১৮.৮১%। তার মানে আমাদের দ্রব্যমূল্যের হার সম্ভবত আরও ১৮%-এর নিচে রাখতে পারতাম। এতে হয়তো আমাদের জিডিপি কমে যেত কিন্তু মুদ্রাস্ফীতি অবশ্যই অনেক বেশি নিয়ন্ত্রণে থাকত। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরাসরি অবদান রাখতে পারত।

মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকলে মানুষের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। কম কাজে বেশি আয় করতে পারলে মানুষ কাজ করতে চায় না, অলস হয়ে যায়। আয়ের সঙ্গে মানুষের কর্মক্ষমতা সমান্তরাল। মানুষ অতিরিক্ত আয়ের জন্য বেশি কাজ করে এবং বেশি কাজ করলে উৎপাদন বেশি হয়। আবার বেশি কাজ করলে কাজের অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। ফলে উৎপাদনের মান ও পরিমাণ উভয়ই বাড়ে এবং সেই সঙ্গে উৎপাদন খরচও কমে। উচ্চ মানসম্পন্ন উৎপাদনের সরবরাহ বাড়লে বাজারে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পায় যা সব সময় উৎপাদনের মূল্য নিম্নমুখী রাখে। ফলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং বাড়তি চাহিদা সৃষ্টি করে। সরবরাহ ও চাহিদা সমান্তরাল বৃদ্ধি পাওয়ায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকে। টাকার অবমূল্যায়ন সরাসরি মুদ্রাস্ফীতি ঘটাচ্ছে, ফলে কম কাজে বেশি আয় হচ্ছে যা মূলত মানুষের কর্মক্ষমতা কমিয়ে দিয়ে উৎপাদন ক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে। উৎপাদন ক্ষমতা কমার কারণে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গিয়ে সরাসরি দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দিচ্ছে। এতে একশ্রেণির মানুষের আয় বাড়ছে কিন্তু তা সমাজে প্রকট বৈষম্য সৃষ্টি করছে। এতে সমাজে নৈরাজ্য ও অশান্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন অজুহাতে বা কখনো কখনো প্রয়োজনে ত্রাণ ও বিভিন্ন সাহায্য-সহযোগিতা দিয়ে একশ্রেণির মানুষকে কর্মে অনুৎসাহী করে তোলা হচ্ছে, যার ফলে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। পাশাপাশি উৎপাদন খরচ সরাসরি বৃদ্ধি করে ক্রমাগত দ্রব্যমূল্য বাড়াতে সরাসরি অবদান রাখছে। শ্রমিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বার্ষিক বেতন-ভাতা বৃদ্ধি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে দারুণভাবে সহায়তা করছে। দুর্নীতি করার সুযোগ মানুষের কর্মক্ষমতা কমিয়ে দিয়ে একদিকে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি করে আবার সেই সঙ্গে সামাজিক বৈষম্য বৃদ্ধির মাধ্যমে নৈরাজ্য ও অশান্তি সৃষ্টি করে সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট করে। এর ফলে উৎপাদন সরাসরি ব্যাহত হয় এবং উৎপাদন কমে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ঘটায়। শিক্ষাব্যবস্থার ওপর মানুষের কর্মক্ষমতা ও উৎপাদনশীলতা বহুলাংশে নির্ভর করে। দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষাব্যবস্থাও মানুষকে উৎপাদনমুখী কর্ম থেকে বিমুখ করে তোলে। ফলে জাতীয় উৎপাদন হ্রাস পায় যা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আবার উচ্চশিক্ষাও মানুষকে উৎপাদনমুখী কর্ম থেকে দূরে রাখে। মানুষ যত বেশি উচ্চশিক্ষিত হয় তত বেশি উৎপাদনশীল কর্ম থেকে দূরে থাকে, যদিও তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যক্ষমতা বহুগুণ বেড়ে যাওয়ার ফলে তাদের চাহিদাও বহুগুণে বেড়ে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

অতিমাত্রায় ধর্ম-কর্মে লিপ্ততা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়ানো, ক্রীড়া ও আমোদ-প্রমোদ নিয়ে ব্যস্ততাও মানুষকে উৎপাদনমুখী কাজ থেকে দূরে রাখে যা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে বিশালভাবে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে। তাই এক কথায় বলা যায়, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ টাকার অবমূল্যায়ন। টাকা সস্তা ও সহজলভ্য হওয়ার কারণে মানুষ উৎপাদনমুখী কর্মে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। কারণ উৎপাদনমুখী কর্ম মানেই কায়িক ও মানসিক পরিশ্রম যা মানুষ বাধ্য না হলে করতে চায় না। তাই মানুষকে প্রথম থেকেই সর্বজনীনভাবে উৎপাদনমুখী কর্মে উৎসাহিত করতে হবে। এজন্য প্রথমেই টাকাকে শক্তিশালী করতে হবে। কায়িক পরিশ্রম আর উৎপাদনমুখী কাজ এক নয়। ধান কাটা শ্রমিক ও ধান উৎপাদনকারী শ্রমিক এক নয়। তাই টাকাকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে টাকা উৎপাদন বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ করতে হবে যাতে উৎপাদনের মাধ্যমে বেশি টাকা আয় করা যায়। মুদ্রা বিনিময় করে বেশি টাকা আয় করার ভ্রান্ত পথ থেকে সরে আসতে হবে। বিদেশি আয় বিদেশি মুদ্রায় প্রতিযোগিতা করে অর্জন করতে হবে, টাকাকে কাগজ বানিয়ে নয়। বিদেশি মুদ্রায় উৎপাদন খরচ কমাতে এবং পরিমাণ বাড়াতে হবে। দেশি শ্রমের মান, দক্ষতা ও উৎপাদন ক্ষমতা বাড়িয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সক্ষমতা বাড়াতে হবে যাতে দেশে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকে। দেশি উৎপাদন বৃদ্ধি, উৎপাদন খরচ কমানো ও মানুষের খাদ্যদ্রব্য এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কেনার ক্ষমতা তথা সহজলভ্য করার জন্য তৎপরবর্তীতে বর্ণিত দ্রব্যাদির আমদানি খরচ কমানোর লক্ষ্যে বৈদেশিক মুদ্রাপ্রতি ২০ থেকে ৩০%  হারে কম মূল্যে বিক্রয় করা গেলে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা অনেকটা সহজ হতে পারে। তুলা, কম্পিউটারসহ মেশিনারিজ, খনিজ তেল, বৈদ্যুতিক মেশিনারিজ ও ইকুইপমেন্ট, খাদ্যশস্য, ভোজ্য তেল, চিনি, সব ধরনের খাদ্যদ্রব্য, ওষুধের কাঁচামাল, সয়াবিন আমদানিতে যত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হবে সে মুদ্রা প্রতি মার্কিন ডলার সমমূল্যের বিনিময় হার ২৫% কমিয়ে দিলে দ্রব্যমূল্য দীর্ঘমেয়াদকাল নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা সম্ভব হতে পারে। এ দ্রব্যগুলো আমদানি করতে গেলে বছরে হয়তো ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার লাগতে পারে। এ ডলার বিক্রিতে বর্তমান দর ৮৬.২২ থেকে ২৫% হারে কম মূল্য নির্ধারণ করলে সরকারকে সর্বোচ্চ ৫ বিলিয়ন ডলার সমমানের টাকা অর্থাৎ সর্বোচ্চ ৪৫ হাজার কোটি টাকা রাজকোষ থেকে জোগান দিতে হতে পারে যা আমাদের অর্থনেতিক সক্ষমতার দিক দিয়ে তত বড় কোনো অঙ্ক নয়। এর সুফল জনগণ ভোগ করবে। দরকার রাজনৈতিক ইতিবাচক বলিষ্ঠ জনবান্ধব ও দেশপ্রেমিক সিদ্ধান্ত।

পরবর্তী লেখায় পরিবহন খরচ, বাল্ক পরিমাণে জাহাজিকরণ, আমদানি পণ্যের নির্দিষ্টকরণ ও শুল্ক হারের ক্রমান্বয় পরিবর্তন করে কীভাবে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা যেতে পারে তা আলোচনার চেষ্টা করব।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য।

সর্বশেষ খবর