জ্ঞানতাপস শিক্ষক, ভাষাসংগ্রামী, বাংলাদেশের প্রথম মহিলা জাতীয় অধ্যাপক ড. সুফিয়া আহমেদের (১৯৩২-২০২০) আজ দ্বিতীয় প্রয়াণ দিবস। তাঁর এ মহাযাত্রায় আমরা হারিয়েছি বাঙালি সংস্কৃতির প্রতিভূ একজন উদার, সত্যিকারের অসাম্প্রদায়িক বাঙালিকে। বাঙালি সংস্কৃতি তিনি হৃদয়ে ধারণ করতেন। তাঁর বেড়ে ওঠা উদার পরিবেশে। তাঁর বাবা ছিলেন ঢাকা হাই কোর্টের বিচারপতি মুহাম্মদ ইব্রাহিম যিনি পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং পাকিস্তানের আইনমন্ত্রী হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন একজন অসাম্প্রদায়িক বাঙালি। সুফিয়া আহমেদের প্রাথমিক শিক্ষাজীবন কেটেছে ঢাকার ‘সেন্ট ফ্রান্সিস জ্যাভিয়ার্স’ স্কুলে এবং দার্জিলিংয়ের কার্শিয়াংয়ের উড়ি Dow Hillস্কুলে। Dow Hill স্কুলে থাকা অবস্থায় ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় ফলে তিনি পূর্ব বাংলায় চলে আসেন। পূর্ব পাকিস্তানের Intermediate of Arts পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় তিনি অষ্টম স্থান অধিকার করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ থেকে ১৯৫৩ সালে স্নাতক (সম্মান) ও ১৯৫৪ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬০ সালে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ‘স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ (সোয়াস) থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় বাঙালির মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির আন্দোলন সফল করার জন্য তিনি ঢাকার বিভিন্ন স্কুল-কলেজে গিয়ে শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলনের যৌক্তিকতা ও প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে তাদের উদ্বুদ্ধ করেন। ২১ ফেব্রুয়ারি তিনি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। কলা ভবনের ফটক (বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজের ইমারজেন্সি গেট) পেরিয়ে প্রথম যে ছাত্রীদের মিছিল বের হয় তার অগ্রভাগে ছিলেন সুফিয়া আহমেদ। পুলিশের লাঠিচার্জে তিনি আহতও হন। ২১ ফেব্রুয়ারির পর আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা ও আন্দোলন চালিয়ে নেওয়ার জন্য তিনি ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় মানুষের কাছ থেকে চাঁদা/অনুদান সংগ্রহ করেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ তাঁর জীবনের অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা। ভাষা আন্দোলনের অব্যবহিত পরে ১৯৫২ সালেই পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে তিনি তুরস্ক গমন করেন। সেখানেও তিনি বাংলা ভাষায় গান পরিবেশনের দাবিতে অনুষ্ঠান বয়কটের হুমকি দেন। শেষ পর্যন্ত বাংলা ভাষায় গান পরিবেশনের অনুমতি আদায় করেন।
শুধু সাংস্কৃতিক দলের প্রতিনিধি নয়, তিনি ১৯৬৯ সালে প্রথমবার এবং ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয়বার জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে দেশের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেন। এ ছাড়া ১৯৮৩ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত UNESCO-র অধিবেশনেও দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৬১ সাল থেকে চার দশকের অধিক তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। ১৯৯৫ সালে তিনি বাংলাদেশের প্রথম মহিলা জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন।
আমৃত্যু তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। শিক্ষার আলো ছড়িয়েছেন বহু শত শিক্ষার্থীর মধ্যে। তাঁর গুণমুগ্ধ শিক্ষার্থী অসংখ্য। তিনি শুধু দেশে নন, বিদেশেও শিক্ষকতা করেছেন। ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে কাজ করেছেন তুরস্কের বসফরাস ইউনিভার্সিটিতে এবং এলভার্নো কলেজে ছিলেন ফুলব্রাইট ভিজিটিং প্রফেসর।
তাঁর গবেষণার ক্ষেত্র ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মুসলমানদের ইতিহাস, আধুনিক তুরস্কের ইতিহাস এবং বাংলাদেশ ও তুরস্কের নারী উন্নয়ন। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘মুসলিম কমিউনিটি ইন বেঙ্গল’ বাংলাদেশ ও বহির্বিশ্বে পাঠ্যবই হিসেবে পঠিত। এ ছাড়া তাঁর অধীত বিষয়ে বহু প্রবন্ধ দেশে ও বিদেশের নামকরা জার্নাল থেকে প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণা ক্ষেত্রে তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল ঈর্ষণীয়। গবেষণার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বরিত হন জাতীয় অধ্যাপকরূপে। ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা এবং বাংলাদেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিকাশে তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি লাভ করেন রাষ্ট্রীয় অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরস্কার একুশে পদক (২০০২)। এ ছাড়া অনেক পদক, সম্মাননা, সংবর্ধনা, আজীবন সম্মাননা প্রভৃতিতে ভূষিত হয়েছেন।
শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি অনেক সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ গার্লস গাইডের ইন্টারন্যশনাল কমিশনার, বাংলাদেশ ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের সদস্য, বাংলাদেশ ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের সদস্য, চেশায়ার ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। এ ছাড়া তিনি আমৃত্যু তুর্কি-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ সোসাইটির সভাপতি ছিলেন।
জাতীয় অধ্যাপক সুফিয়া আহমেদ শিক্ষক ও সমাজসেবী হিসেবে যেমন সফল ছিলেন তেমনি পারিবারিক জীবনেও ছিলেন অত্যন্ত সফল। তাঁর স্বামী সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী, বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা প্রয়াত ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ। তাঁদের দুই সন্তানও স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। ছেলে ড. সৈয়দ রিফাত আহমেদ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট ডিভিশনের মাননীয় বিচারপতি এবং কন্যা ডা. তাসনীম বায়না ফাতেহ লন্ডনের দুটি খ্যাতনামা ক্লিনিকে কর্মরত।
একজন সফল উদার বাঙালি চেতনা- সমৃদ্ধ শিক্ষক হিসেবে জাতীয় অধ্যাপক ড. সুফিয়া আহমেদ আমাদের কাছে চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন। সারা জীবন তিনি ছিলেন মনেপ্রাণে বাঙালি। তিনি ছিলেন বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাতিঘর। তাঁর শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি এ চেতনারই আলো সারা জীবন ছড়িয়ে গেছেন। ৯ এপ্রিল তাঁর প্রয়াণ দিবস। তাঁর প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক : উপ-উপাচার্য, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।