বুধবার, ১৫ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

মম সরসীতে তব উজ্জ্বল প্রভা

হোসেন আবদুল মান্নান

শিল্পী মান্না দের গাওয়া অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি ছবিতে ‘আমি যামিনী তুমি শশী হে- ভাতিছ গগন মাঝে’ গানটি আমার এবং জেবুর উভয়েরই ভীষণ প্রিয় ছিল। সড়কপথে যেতে যেতে কতবার যে এ গান আমরা শুনেছি এর হিসাব কে রাখে? আজ আমার স্ত্রী জেবুর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁকে ছাড়াই আমরা পুরো দুই বছর ধরে আছি। অর্থাৎ এ গ্রহে আরও ৭৩০ দিন পেছনে ফেলে এসেছি। ভাবলে হতচকিত হয়ে উঠি। অবাক করে তোলে আমাদের পরিবারের সবাইকে। যাঁকে বাদ দিয়ে বাচ্চারা এক বেলার জন্যও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করত না অথচ তাঁর এই সাজানো সংসারে সে নিজেই নেই বিগত ২৪ মাস। তাই আজকে তাঁকে একটা পত্র লিখে বলতে ইচ্ছা করছে তোমার আকস্মিক অনুপস্থিতিতে আমরা কোথায় কেমন করে আছি? ঠিক শরৎচন্দ্রকে লেখা ভূপেন হাজারিকার খোলা চিঠির মতন- ‘এ চিঠি পাবে কি না জানি না’। যদিও এ গানের কথা রচনা করেছিলেন প্রখ্যাত গীতিকার শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। তোমাকে বলছি, পৃথিবীর সব মৃত্যুই সবকিছুকে বিলুপ্ত ও বিলীন করে দেয়। কাজেই দিন শেষে মানুষ নিয়ত ভুলে গিয়েই বাঁচতে চায়। প্রিয়জন হারানোর ব্যথা-বেদনাও নাকি ক্ষণিকের। এটি স্থায়ী রূপ ধারণ করলে মানুষের বাঁচা কঠিনতর হতো। ভুলে যাওয়াই যেন জীবজগতের চিরন্তন উপশম। কিন্তু আমার বেলা হয়েছে উল্টো। যত দিন যাচ্ছে তোমার প্রতি আমার শোক ও দায় বেড়েই চলেছে। সংসারে তোমার অদৃশ্য ঋণের ভারে আমরা প্রত্যেকেই জর্জরিত হয়ে আছি। আজকাল সন্তানরা বলে তোমার কারণে তারা আজকের অবস্থানে, আত্মীয়স্বজন বলে তোমার অসিলায় তারা এখন ভালো আছে। গ্রামের নিম্নবিত্ত মহিলারা তোমার কবরের কাছে এসে এখনো অশ্রুসিক্ত হয়। তোমার মমতা ও মহত্ত্বের বন্দনায় তারা পঞ্চমুখ। আমি বলি, তোমার চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমাজে, সংসারে বা রাষ্ট্রে আমার সরব অস্তিত্বের সংকট প্রকট হয়েছে। এখন কোথাও নেই আমি অথচ কেমন করে যেন বেঁচে আছি। মনে হয়, আজও সারা দিনমান আমার বিচিত্র ভাবনার আকাশজুড়ে তুমি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কত প্রিয়জনকে হারালেন, তিনি যেন মৃত্যুর মিছিলে ডুবে ছিলেন। আবার বললেনও, ‘বেদনা সবসময় ক্ষণিকের, বিস্মৃতিটাই স্থায়ী’। এখন এমন কথায় আমি প্রভাবিত হই না। মাঝেমধ্যে ভাবী, হাসপাতালের মৃত্যুশয্যায় তোমার সঙ্গে আমার শেষ সাক্ষাৎ করাটা খুব জরুরি ছিল। কী এমন ভয় ছিল অভিশপ্ত করোনার? কেন ডাক্তারের বারণ উপেক্ষা করে তোমার শিয়রের পাশে দাঁড়াইনি? সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের নিচে প্রতিদিন ঘুরেছি, দুশ্চিন্তায় আকাশের দিকে তাকিয়ে পায়চারি করেছি। ওপরে ওঠা হয়নি। ঊর্ধ্বলোকে থেকে তুমি হয়তো দেখেছ, তোমার পরে তিন সন্তান, জামাই এবং আমি সবাই করোনাক্রান্ত হয়ে হাসপাতালকে অস্থায়ী ঠিকানা করে নিয়েছিলাম। কিন্তু মরতে মরতেও কেমন করে যেন আমরা বেঁচে যাই। স্বাস্থ্য সচিব হিসেবে তুমি আমাকে মাত্র পাঁচ দিন দেখে গেছ। তবে ১০ মাসের মতো টিকে ছিলাম ওখানে। আমার জন্য এটাও কম কী বল? তোমার অনেক আত্মবিশ্বাস ও মানসিক দৃঢ়তা থাকা সত্ত্বেও মৃত্যুর কাছে পরাজিত হলে। জান, তোমার এমন অকালমৃত্যুতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে শোকবার্তা প্রকাশ করা হয়েছিল। এর জন্য আমরা অকুণ্ঠ চিত্তে কৃতজ্ঞতা জানাই। তোমার যাওয়ার সময় দেশে করোনায় ১ হাজার মানুষও মৃত্যুবরণ করেনি। এখন ৫০ হাজার ছাড়িয়েছে। তোমার পরে পৃথিবী থেকে আরও প্রায় অর্ধ কোটি মানুষ এ ভয়ংকর অস্পৃশ্য ও বায়বীয় রোগে বিদায় নিয়ে চলে গেছে। ইদানীং ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ঘোরাফেরা করতে গিয়ে তোমার স্মৃতি, তোমার চলাচল এমনকি তোমার পদচিহ্ন খুঁজি। আর তোমার অবিচ্ছিন্ন ছায়াও যেন আমার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অফিসার্স ক্লাব বা লেডিস ক্লাবের সাবেক কমিটির সদস্য যাঁদের সঙ্গে তুমি ছিলে, এঁদের প্রায় সবাই দিব্যি ভালো আছেন। কালেভদ্রে হঠাৎ দেখা হয়ে গেলে তোমার জন্য তাঁরাও অশ্রুসজল হন।

বিশ্বাস কর, তোমার সর্বাধিক ত্যাগ ও কষ্টে তৈরি গ্রামের বাড়ি, গৃহস্থালি গরু, গাছপালা, শাকসবজি, লেবু, কবুতরের বাসা সবই ঠিকঠাক আছে। শফিক আজও এগুলো সযতেœ লালনপালন করছে। সাজেক ভ্যালি থেকে নিয়ে আসা সেই ফন্সি (কুকুরছানা) অনেক অবহেলিত হয়েও মান-অভিমানে আমাদের সঙ্গেই আছে। মনে হয় এখনো তোমার পথ চেয়ে বসে থাকে। আমাদের বিরুদ্ধে তার পাহাড়সমান অভিযোগ। তোমার ছোট ছেলে অম্লান একে কোথাও যেতে দেবে না। সপ্তাহান্তে ভিডিওকলে ওকে দেখে। কাজেই ফন্সিকে কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির জিম্মাদারিতে দেওয়া যাচ্ছে না। তোমার সেই ছেলে কিন্তু যশোরে বিমানবাহিনীর ট্রেনিং করছে। আহা! এখন ছেলের জন্য তোমার কত যে চিন্তা থাকত! ইদানীং আমি প্রায়ই ভাবী, সংসারে তোমার অনিঃশেষ অবদানের কথা জীবদ্দশায় তোমাকে বলা হয়নি। এটা আমার এক প্রকার অপরাধ। তোমার তিন দশকের বিরামহীন শ্রমের যথাযথ সম্মান ও স্বীকৃতি দিতে পারিনি। পৃথিবীতে মানুষের নিয়তিই বুঝি এমন, সব সময় কাছাকাছি বাস করলে এর মূল্য বা কদর কেউ বোঝে না। আরও একটি কথা- মা-বাবা, ভাইবোন, নিকটাত্মীয়- বলতে পার আর কারও মৃত্যু বা অকস্মাৎ চলে যাওয়া আমাকে এতটা বিচলিত, মর্মাহত বা বেদনার্ত করতে পারেনি। শুধু তোমার ক্ষেত্রে আমার হৃদয়ে নিরন্তর রক্তক্ষরণ, যা থামছেই না। জান, তোমার চলে যাওয়ার এত দিন পরও আমাদের মেয়েকে মনের অজান্তে ভুল করে তোমার নামে সম্বে^াধন করে বসি। কী লজ্জা বলত, জামাই কী ভাববে? আজকাল পুরনো অ্যালবাম দেখেও সময় কাটাই। মাঝেমধ্যে আমার ১০ বছরের টুকিটাকি লেখার ডায়েরিটাও অলক্ষ্যে চোখে জল এনে দেয়। আগে এমনটা হয়নি। তোমার আর বাচ্চাদের ছবিগুলোর সাল, তারিখ ইত্যাদি স্মরণ করে কখনো আনন্দ আবার কখনো দুঃখ অনুভব করি। চাকরির একেবারে শুরুর দিকের ছবিগুলো আমাকে বেশি কষ্ট দেয়। আমাদের কিছুই ছিল না অথচ চারপাশে কত স্বপ্নাতুর মায়াবী অনুভূতি ছিল। চাঁপাইনবাবগঞ্জের জীবনে একটি সাদা কালো টিভি কিনতে গিয়ে দুজনে কতবার কিস্তির হিসাব গুনেছি। আমার মনে পড়ে, কী প্রগাঢ় ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে নিত্য টানাপোড়েনের ছোট্ট সংসারকে তুমি জয় করেছিলে। এ কাজে সত্যিই তুমি ছিলে অতুলনীয়া ও অনন্যা।

দ্যাখো, তোমাকে আসল কথাটি বলা হয়নি, এ পৃথিবীতে তোমার শেষদিনের শেষ মুহূর্তে আমি ইচ্ছা করেই তোমার মুখটি দেখিনি। অনেকে বললেও আমি তা পারিনি। করোনায় আক্রান্ত হয়ে পাঁচ দিন হাসপাতালে- শুনেছি শেষনিঃশ্বাসের আগে হার্টঅ্যাটাকে তোমার রক্তক্ষরণ হয়েছিল, সত্যি বলছি, এগুলোসহ এক অচেনা রূপে আমি তোমাকে দেখতে চাইনি। আমার চোখে তুমিই সেরা ছিলে, আছ এবং থাকবে।

                লেখক : গবেষক ও গল্পকার।

সর্বশেষ খবর