বুধবার, ৩১ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা

আল্লাহতে বিশ্বাস মোমিনকে নাজাতের পথ দেখায়

মুফতি রুহুল আমিন কাসেমী

আল্লাহতে বিশ্বাস মোমিনকে নাজাতের পথ দেখায়

মহান রব্বুল আলামিন আল কোরআনে উল্লেখ করেছেন, পৃথিবীর শুভলগ্ন থেকেই আল্লাহ ১২টি মাসকে নির্ধারণ করেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য চারটি মাসকে হারাম সাব্যস্ত করেছেন। যথা জিলকদ, জিলহজ, মহররম, রজব। এ চারটি মাসে সব রকমের হানাহানি, মারামারি, অন্যায়, অপরাধ, অবিচার, তথা দুর্বলের প্রতি সবলের জুলুম, অত্যাচার সম্পূর্ণরূপে হারাম ঘোষণা করেছেন। এখানে একটু বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মহররম আরবি ক্যালেন্ডারের প্রথম আর জিলকদ শেষ মাস। এ দুটি মাসের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ রহস্য লুক্কায়িত আছে। আদি পিতা হজরত আদম (আ.) ও মা হাওয়া জান্নাতে একটি ভুলের কারণে পৃথিবীতে নেমে আসেন দুজন পৃথক স্থানে। এরপর ৯ জিলহজ আরাফাতের ময়দানে এ পৃথিবীর দুই মানব-মানবী, স্বামী-স্ত্রীর প্রথম সাক্ষাৎ হয়। এখানেই তাঁদের ভুলের জন্য কৃত তওবা কবুল করে ক্ষমার ঘোষণা করা হয়। মহান রব্বুল আলামিন তাঁর তওবা কবুল করে তাঁকে পাক ও পবিত্র করে আগের নবুয়তের সব সম্মান ও মর্যাদা ফিরিয়ে দেন। এ দিনটি কেয়ামত পর্যন্ত মানুষের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কেননা আল্লাহর রসুল ঘোষণা করেছেন, আরাফাতের ময়দানে যত মানুষ উপস্থিত হয় আল্লাহ সবাইকে ক্ষমা করে দেন। আর এ ক্ষমার কারণে ইবলিশ সবচাইতে বেশি লাঞ্ছিত, অপমানিত হয়। ব্যর্থতার গ্লানিতে, আফসোস ও পেরেশানিতে নিজের মুখেই নিজে মাটি মারতে থাকে। চিৎকার ও ক্রন্দন করতে থাকে। ১০ জিলহজ হজরত ইবরাহিম (সা.) আল্লাহর নির্দেশে তাঁর পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে কোরবানি করার উদ্দেশ্যে তাঁকে সঙ্গে নিয়ে মিনায় গমন করেন। পিতা-পুত্র ইমানের ওপর সুদৃঢ় ও আল্লাহর হুকুম বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকা সত্ত্বেও শয়তান তাঁদের বারবার ধোঁকা দেয়। আল্লাহর হুকুমে তাঁরা ইবলিশ শয়তানকে পাথর মেরে তাকে তাড়িয়ে দেন। এরপর আল্লাহতায়ালা পিতা-পুত্রের আত্মবিসর্জন ও আত্মত্যাগ এবং ইমানের ওপর অবিচলতা দেখে সন্তুষ্ট হন এবং তাঁরা ইমানি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে আল্লাহর নির্দেশে পশু কোরবানির মাধ্যমে ইবরাহিম (আ.)-এর এ ভালোবাসার পরীক্ষার নিদর্শন কেয়ামত পর্যন্ত সব মুসলমানের জন্য করণীয় হিসেবে ঘোষণা করেন। এর থেকে আমরা শিক্ষা পাই : ইবরাহিম (আ.) আত্মত্যাগের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু একজন পিতার চোখের সামনে নিজ হাতে সন্তানকে কোরবানি করা অত্যন্ত কষ্টকর। আল্লাহ তা চাইলেন না। ইবরাহিম (আ.)-এর সন্তানকে তাঁর কোলে ফিরিয়ে দিলেন তাঁর একটি পশমেরও কোনো ক্ষতি হলো না। এভাবেই যারা আল্লাহর জন্য ত্যাগ স্বীকার করবে তাদের দুনিয়ায়ও কোনো ক্ষতি হবে না বরং আখেরাতে তাদের জন্য থাকবে মহাপুরস্কার ও আল্লাহর সন্তুষ্টি। ঠিক তেমনিভাবে হিজরি সনের প্রথম মাস মহররম। এ মাসের ১০ তারিখ ঐতিহাসিক বরকতময় আশুরার দিন। এ ১০ তারিখই প্রিয় নবীর দৌহিত্র হজরত হুসাইন (রা.) কারবালার ময়দানে সপরিবারে প্রচ- পানির পিপাসার কষ্ট নিয়ে পাপিষ্ঠ এজিদ বাহিনীর নিকৃষ্ট ও নির্দয় হত্যাকান্ডের মাধ্যমে শাহাদাতবরণ করেন। তাঁদের উদ্দেশ্য প্রিয় নবীর ইসলামকে দুনিয়া থেকে চিরতরে মিটিয়ে দেওয়া। আর হজরত হুসাইন (রা.) তাঁর প্রিয় নানাজির ইসলামকে নিজের রক্ত এবং জীবন দিয়ে পরিবারের আত্মবিসর্জন দিয়ে পৃথিবীতে টিকিয়ে রাখার জন্য শাহাদাতবরণ করলেন। তবু তিনি বাতিলের সামনে মাথা নত করেননি। দুনিয়ার লোভ-লালসা তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। এখান থেকেই আমাদের শিক্ষা নিতে হবে, হকের পক্ষে থাকা, নিজের জানমাল ও প্রয়োজনে আত্মবিসর্জন দিয়ে হলেও কখনই বাতিলের সামনে মাথা নত না করা। কেননা পৃথিবীটা মুসলমানদের জন্য জেলখানা আর কাফেরদের জন্য বেহেশত। কোনো মুসলিম ইমান বিসর্জন দিয়ে বাতিলের সঙ্গে আঁতাত করে সুখশান্তির আসা করতে পারে না। এমনিভাবে হজরত মুসা (আ.) ও ফেরাউনের মধ্যে হক-বাতিলের লড়াই হলো। আল্লাহ মুসা (আ.)-কে অলৌকিক ক্ষমতায় নীল নদ পার করে নিরাপদে ওই পাড়ে পৌঁছে দিলেন আর একই নীল নদে দুনিয়ার প্রতাপশালী ফেরাউন সদলবলে নিমজ্জিত হয়ে সলিলসমাধি লাভ করল। এতে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে, হকের বিজয় আসবেই, আর বাতিল ধ্বংস হবেই। হজরত ইউনুস (আ.) প্রকান্ড মাছের পেটে গভীর সমুদ্রের নিচে চলে গেলেন। তিনি নিজের দোষ স্বীকার করে মহান রব্বুল আলামিনের সাহায্য কামনা করলেন। আল্লাহ তাঁকে সাহায্য করলেন। মুহূর্তের মধ্যে তাঁকে সমুদ্রের ওপরে পৌঁছে দিলেন এবং সুস্থ করলেন। এ থেকে আমাদের শিক্ষা, যে-কোনো বিপদে আল্লাহকে স্মরণ করা, একমাত্র তাঁর কাছেই সাহায্য চাওয়া। আর একমাত্র তিনিই প্রভু যিনি তাঁর বান্দাকে কঠিন বিপদে সাহায্য করে উদ্ধার করতে পারেন। ঠিক এমনিভাবে হজরত ইবরাহিম (আ.)-কে নমরুদ আগুনে নিক্ষেপ করল, কঠিন বিপদে তিনি আল্লাহর সাহায্য কামনা করলেন। আল্লাহ তাঁর খলিলকে ভয়াবহ অগ্নিকুন্ডের সব রকমের কষ্ট থেকে হেফাজত করলেন। হজরত নুহ (আ.) ভয়াবহ বন্যায় ৪০ দিন নৌকায় ভাসলেন, এরপর আল্লাহ তাঁকে পুনরায় জমিনে ফিরিয়ে আনলেন। হজরত আইয়ুব (আ.) ১৮ বছর দুরারোগ্য কুষ্ঠ রোগে ভুগলেন। তিনি আল্লাহর সাহায্য চাইলেন, আল্লাহ তাঁকে রোগমুক্ত করলেন। তাঁর রাজত্ব এবং যৌবন ও পরিবার ফিরিয়ে দিলেন। ওপরের ঘটনাগুলোর দ্বারা আমরা এ শিক্ষা পাই যে-কোনো কঠিন বিপদে মহান রব্বুল আলামিনের কাছে আমাদের ফিরে যাওয়া উচিত আর তিনিই আমাদের সাহায্য করতে পারেন এবং তিনিই নিঃস্বার্থভাবে তাঁর প্রিয় বান্দার সাহায্যার্থে এগিয়ে আসেন, বান্দার দুঃখদুর্দশা ঘুচিয়ে দেন। সুতরাং বান্দার আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের সঙ্গে তাঁর সাহায্য কামনা করা উচিত।

লেখক : ইমাম ও খতিব, কাওলার বাজার জামে মসজিদ, দক্ষিণখান, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর