মঙ্গলবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

পথপ্রদর্শক ড. আকবর আলি খান

হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ

পথপ্রদর্শক ড. আকবর আলি খান

নব্বইয়ের দশকে ঢাকা ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটির সভাপতি থাকাকাল থেকেই আমি ড. আকবর আলি খান স্যারকে চিনি। তিনি তখন পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে সচিব। ইতিহাসের ছাত্র হয়েও পিএইচডি ডিগ্রি নেন অর্থনীতির ওপর। বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনে ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের কারণে পাকিস্তান সামরিক আদালত তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁকে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদন্ড দিয়েছিল। ২০০২ সালে মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে অবসর নেন তিনি। ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। ইতিহাস, অর্থনীতি, সাহিত্য, সমাজব্যবস্থাসহ সব ক্ষেত্রেই ছিল তাঁর অগাধ পা-িত্য। সর্বশেষ ৯ এপ্রিল আমার উপস্থাপনা ও পরিচালনায় বর্তমান নির্বাচন কমিশনের প্রতি জনগণের আস্থা নিয়ে আয়োজিত এক ছায়া সংসদ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন তিনি। সেদিন বলেছিলেন, ‘শরীরটা ভালো যাচ্ছে না, আর তোমাদের অনুষ্ঠানে আসতে পারব কি না জানি না।’ এটিই ছিল ড. আকবর আলি খানের সঙ্গে মক স্পিকার হিসেবে আমার সর্বশেষ পাশে বসে বিতর্ক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ।

ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি আয়োজিত এ বিতর্ক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানে তিনি বহুবার প্রধান অতিথি হিসেবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ মতামত ব্যক্ত করেছেন। দেশের গণতন্ত্র, অর্থনীতি, রাজনীতি, সুশাসন, জবাবদিহিতা, অনিয়ম, দুর্নীতিসহ নানা বিষয়ে অত্যন্ত নির্মোহভাবে তাঁর বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন তরুণ শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে আয়োজিত ছায়া সংসদে। শারীরিকভাবে চলাফেরায় কষ্ট হলেও তাঁর কথা ছিল খুবই স্পষ্ট ও সুন্দর শব্দচয়নে। তথ্য ও তত্ত্ব তিনি এতটাই সহজভাবে উপস্থাপন করতেন, তাতে অনেক সময় বিস্মিত হতাম। ভাবতাম কীভাবে তিনি শারীরিক এত অসুস্থতার মধ্যেও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সাম্প্রতিক সব বিষয় নিয়ে দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দেন। জনস্বার্থ বিষয়ে তাঁর তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য শুধু আমার স্মৃতিতে নয়, সমগ্র জাতির স্মৃতির মণিকোঠায় ঠাঁই নিয়ে থাকবে। গত এক দশকে বহুবার তাঁর বাসায় গেছি। অতি সাদামাটা বাসায় দেখেছি শুধু বই আর বই। মাঝেমধ্যে তাঁর নিজের লেখা দু-একটি বই উপহার হিসেবেও পেয়েছি।

৮ সেপ্টেম্বর তাঁর মৃত্যুসংবাদে হোঁচট খাই। জানতাম অসুস্থ। স্বাভাবিক চলাফেরা অনেক আগেই সংকুচিত হয়েছে। এরই মধ্যে স্ত্রী-কন্যা বিয়োগ মানসিকভাবে তাঁকে আরও বেশি বিপন্ন করেছিল। ২০১৬ সালে তাঁর স্ত্রী শিক্ষিকা হামীমা খান মারা যান। একই বছর মেয়ে মেহরীন খানও মৃত্যুবরণ করেন। থাকতেন শতায়ু শাশুড়ি জাহানারা রহমানসহ এক বাসায়। চলাফেরায় সব সময় সঙ্গে থাকতেন ব্যক্তিগত সহকারী ফারুক ভাই। অসুস্থতা আমলে না নিয়ে তিনি জনসম্মুখে আসতেন, কথা বলতেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. আকবর আলি খান ছিলেন একজন চৌকশ আমলা। বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক হিসেবেও কাজ করেছেন। ইতিহাস ও অর্থনীতি নিয়ে তাঁর পা-িত্য সর্বত্র প্রশংসিত। অর্থশাস্ত্র নিয়ে তিনি যে গবেষণাধর্মী লেখা লিখেছেন তা জাতির কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ইতিহাসের ভিতরে ঢুকে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামো, আমলাতন্ত্র, গণতন্ত্র, সুশাসন নিয়ে অনেক প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন। তিনি ছিলেন বহু জনপ্রিয় বইয়ের লেখক। ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’ এবং ‘আজব ও জবর-আজব অর্থনীতি’ এ বই দুটি তাঁর লেখনীতে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। ‘ডিসকভারি অব বাংলাদেশ’ এবং ‘সাম অ্যাসপেক্ট অব পেজ্যান্টস বিহেভিয়ার ইন বেঙ্গল’ প্রশংসিত হয়েছে আন্তর্জাতিকভাবে। নিজ দেশকে নিয়ে তাঁর যে বেদনা বা যন্ত্রণা বোধ তা আমরা দেখতে পাই তাঁর লেখা ভীষণ পাঠকপ্রিয় ‘অবাক বাংলাদেশ : বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি’ বইটিতে। বইটি ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয়। বইয়ের মুখবন্ধে তিনি লেখেন, ‘উইনস্টন চার্চিলের ভাষায় বলতে গেলে বাংলাদেশ একটি রহস্যঘেরা প্রহেলিকাচ্ছন্ন হেঁয়ালি। একদিকে এখানে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রকট অপ্রতুলতা সত্ত্বেও উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জিত হয়েছে; অন্যদিকে সুশাসনে নিশ্চিত অবক্ষয় ঘটেছে। বাংলাদেশের অনেক অর্জনের জন্য আমি গর্বিত। তবু রাজনৈতিক অবক্ষয় ও সুশাসনের ক্রমাগত অধোগতি আমার প্রজন্মের যারা আমার মতো গণতান্ত্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, তাদের জন্য দৈহিক যন্ত্রণার চেয়েও মর্মান্তিক মানসিক যন্ত্রণার সৃষ্টি করেছে।’

দেশের রাজনৈতিক অবক্ষয় ও সুশাসনের অধোগতি নিয়ে তিনি বিভিন্ন সময় প্রাঞ্জল, যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণের জন্য পথও বাতলে দিয়েছেন। ড. আকবর আলি খানের সর্বশেষ গ্রন্থ ‘পুরানো সেই দিনের কথা’। আত্মজীবনীমূলক এ গ্রন্থটিতে তাঁর বহুমাত্রিক জীবনের উন্মেষ ও বিকাশের কাহিনি প্রকাশিত হয়েছে। ড. আকবর আলি খান তাঁর এক লেখায় বলেছেন, আধুনিক আমলাতন্ত্রের বড় বৈশিষ্ট্য হলো রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা। কিন্তু বাংলাদেশে সেই দৃশ্য অনুপস্থিত। যারা ক্ষমতায় এসেছেন তারাই অনুগত প্রশাসন তৈরি করেছেন। তাই বারবার বলেছেন সংস্কারের কথা। বলেছেন প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচনসহ আরও বিভিন্ন বিষয়ে জরুরি সংস্কার প্রয়োজন। আর এসবের জন্য দরকার গণবিতর্ক, উন্মুক্ত আলোচনা। তাই তিনি বারবার অতিথি হয়ে ছুটে এসেছেন তরুণ শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে ছায়া সংসদ অনুষ্ঠানে। মন-খুলে কথা বলেছেন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সারথিদের সঙ্গে। বলেছেন সংকটের কথা, জানিয়েছেন সমাধানও। মণিমুক্তা ছড়িয়ে দিয়ে গেছেন স্পষ্ট বক্তব্যে।

ড. আকবর আলি খানকে নিয়ে কোনো কিছু লেখা বা মূল্যায়ন করা খুবই কঠিন। কেননা তাঁর কর্মের ব্যাপ্তি সীমানাহীন। তিনি অসংখ্য মৌলিক কাজ আর ভাবনার পথপ্রদর্শক। এক জীবনে একজন মানুষ কত বৈচিত্র্যময় এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে পারতেন তিনি তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। অর্থবিত্ত, লোভ-লালসা, ক্ষমতা তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। জীবন অবধি কাজকেই ভালোবেসেছেন এবং যে কাজ কেবলই নিবেদিত হয়েছে মানুষের কল্যাণে। জাতীয় বা রাষ্ট্রীয় কোনো পদকে ভূষিত না হলেও গণমানুষের ভালোবাসায় বেঁচে থাকবেন তিনি চিরকাল। শ্রদ্ধাঞ্জলি বিবেকের বাতিঘর ড. আকবর আলি খানকে।

 

লেখক : চেয়ারম্যান, ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি

[email protected]

সর্বশেষ খবর