শুক্রবার, ২১ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা

আদর্শিক রাজনীতির ধ্রুবতারা

সাইফুদ্দিন আহমেদ মণি

আদর্শিক রাজনীতির ধ্রুবতারা

বাংলাদেশে আদর্শভিত্তিক রাজনীতিতে যাঁকে বিরল নক্ষত্র গণ্য করা হয় তিনি অলি আহাদ। জন্ম নিয়েছিলেন ১৯২৮ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। গতকাল ২০ অক্টোবর ছিল তাঁর মৃত্যু দিবস। ২০১২ সালে তিনি মারা যান। মেধাবী ছাত্র অলি আহাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিকমে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হন। কিন্তু চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে সমর্থন দেওয়ায় তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয় এবং তিনি এমকম ডিগ্রি লাভ থেকে বঞ্চিত হন। তাঁর লেখা বই ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ৭৫’ ইতিহাসের এক অনন্য দলিল। কর্মজীবনে তিনি ‘ইত্তেহাদ’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তাঁর স্ত্রী রাশিদা বেগম ছিলেন মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতরের প্রথম মহিলা মহাপরিচালক। তাঁর একমাত্র কন্যা ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বিএনপিদলীয় এমপি এবং আলোচিত টিভি টকশো ব্যক্তিত্ব। ১৯৪৬ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে অলি আহাদের রাজনীতির সূচনা। ছিলেন ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং ঢাকা মহানগরীর আহ্বায়ক। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষার দাবিতে আন্দোলনের সময় সচিবালয় এলাকায় তিনি গ্রেফতার হন। ১৯৪৮ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত দুঃশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মেয়াদে কারাগারে ছিলেন। এ দেশের যুব আন্দোলনের সূচনা করেন অলি আহাদ। ১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক তিনি। অলি আহাদকে বলা হয় ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের মহানায়ক। ’৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতের সভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে যে চারজন ভোট দেন অলি আহাদ তাঁদের অন্যতম। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা। ২৭ ফেব্রুয়ারি তিনি গ্রেফতার হন। দীর্ঘদিন কারাভোগের পর মুক্তি পেলেও গ্রামের বাড়িতে অন্তরিন করে রাখা হয়। ১৯৫৩ সালের সম্মেলনে তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রচার সম্পাদক নির্বাচিত হন। ’৫৫ সালে হন সাংগঠনিক সম্পাদক। ’৫৪ সালের নির্বাচনে বয়স ২৫ বছর না হওয়ায় তিনি প্রার্থী হতে পারেননি। ’৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে অলি আহাদ ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানীর অনুসৃত নীতি সমর্থনের অপরাধে তিনি দল থেকে বহিষ্কৃত হন। তাঁর বহিষ্কারের প্রতিবাদে আওয়ামী মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটির নয়জন সদস্য পদত্যাগ করেন। ’৫৭ সালে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি প্রতিষ্ঠা হলে অলি আহাদ তাঁর যুগ্মসম্পাদক নির্বাচিত হন। ’৫৮ সালের সামরিক শাসন জারির পর চার বছর কারাগারে ছিলেন। ’৬৪ সালে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে এনডিএফের অন্যতম নেতা অলি আহাদ। ’৬৯ সালে তিনি ‘জাতীয় লীগ’ প্রতিষ্ঠা করে দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। মহান মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৪ সালে তাঁকে ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ দেওয়া হয়। ’৭৩ সালে অলি আহাদ গঠন করেন ‘বাঙলা জাতীয় লীগ’।

১৯৭২-৭৫ সরকারের বিরুদ্ধে তাঁর আজাদ বাঙলা আন্দোলন অনন্য আন্দোলন হিসেবে সবার নজর কাড়ে। ’৭৪ সালের ৩০ জুন তিনি গ্রেফতার হন এবং ’৭৫ সালে মুক্তি পান। এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করায় তিনি সামরিক আদালতে বিচারের সম্মুখীন হন। এরশাদ আমলে তিনি আটবার কারাবরণ করেন। মৃত্যুকালে অলি আহাদ ডেমোক্রেটিক লীগের সভাপতি ছিলেন। ফরোয়ার্ড স্টুডেন্টস ব্লকের সদস্য হিসেবে অলি আহাদের সঙ্গে আমার। রাজনীতিতে লেখাপড়ার ওপর তিনি বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। দেশের পত্রপত্রিকার বাইরেও বিদেশি পত্রিকা পড়তেন। তাঁর কর্মী-সহকর্মীদের পড়তে বলতেন। মিথ্যা কথা বলতেন না, মিথ্যাবাদীকে ঘৃণা করতেন। সাধারণ জীবনযাপন করতেন। হরতালের দিন সবার সঙ্গে বসে আলু সিদ্ধ বা সাধারণ মানের পাতলা খিচুড়ি খেতেন। হরতালের দিন কখনো তিনি হরতালের সময় শেষ হওয়ার ১ মিনিট আগেও রিকশায় চড়তেন না। আদর্শিক রাজনীতির ধ্রুবতারা অলি আহাদ আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ ও নির্দেশনা আমাদের সুস্থ রাজনৈতিক ধারা প্রতিষ্ঠায় প্রেরণা জোগায়। অলি আহাদের ধ্যান-ধারণার রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত হলে গণতন্ত্র ও জনগণের রাজনীতি বিকশিত হবে। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতবাসী করুন।

লেখক : সাধারণ সম্পাদক ডেমোক্রেটিক লীগ

সর্বশেষ খবর