সোমবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

একটি মৃত সরকারের আত্মকথা

মহিউদ্দিন খান মোহন

একটি মৃত সরকারের আত্মকথা

আপনারা আমাকে শুনছেন? আমার নাম ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’। বর্তমানে আমি মৃত। একদিন খুব ঘটা করে সবাই মিলে আমাকে পয়দা করেছিল। এখন কারও কারও কাছে আমি অচ্ছুত। কদিন আগে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিএনপিকে পরামর্শ দিয়েছেন, মাথা থেকে আমার ভূত নামিয়ে ফেলতে। তার মানে আমি মরে ভূত হয়ে গেছি! কোনো কোনো শাস্ত্রমতে মানুষ অপঘাতে মারা গেলে নাকি ভূত হয়ে যায়। আমারও অপঘাতেই মৃত্যু হয়েছে। সুতরাং কাদের সাহেব ভুল বলেননি। আবার ১৩ নভেম্বর তিনি বলেছেন, আমি নাকি এখন মিউজিয়ামে রাখা শোপিস। অথচ এই আমি একসময় সবার কত কাক্সিক্ষত ছিলাম! সবই ভাগ্যের ফের!

আমার প্রথম জন্ম ১৯৯০ সালে। তখন স্বৈরশাসক এরশাদের প্রদীপ নিভুনিভু। এরশাদের পতন হলে কীভাবে নির্বাচন হবে এ নিয়ে নানা বিতর্ক তখন মাঠেঘাটে। সে সময় আন্দোলনরত দলগুলোর লিয়াজোঁ কমিটিতে আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হলো- এরশাদের পতনের পর প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত হবে দলনিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তখন প্রধান বিচারপতি ছিলেন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। তিনি শর্ত দিলেন, তিন মাসের দায়িত্ব পালন শেষে তাঁকে পুনরায় তাঁর পদে ফেরত যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সবাই তাতেই রাজি। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে ১৯৯১-এর নির্বাচনে গঠিত দেশের পঞ্চম জাতীয় সংসদে সেজন্য একটি বিশেষ বিল পাস করাতে হয়েছিল। সর্বসম্মতিক্রমেই হয়েছিল সেটা। আমার জন্মের পর যে নির্বাচনটি হলো তা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষতার জন্য দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছিল। নির্বাচনে জিতে বিএনপি সরকার গঠন করল। আমি বিশ্রামে গেলাম। পাঁচ বছর পরে আবার ডাক পাব- এ আশা ছিল মনে। এরপর ১৯৯৪ সালে মাগুরা-২ আসনের উপনির্বাচন কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতি কাজে লাগাল আওয়ামী লীগ। তারা বলল, বিএনপি সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে তারা অংশ নেবে না। পরবর্তী সংসদ নির্বাচন হতে হবে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের’ অধীনে। কিন্তু বিএনপি নারাজ। তারা বলল, নির্বাচন সংবিধানের নিয়মমতো হবে। এ নিয়ে রাজপথ উত্তপ্ত হলো। আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত হলো জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামীসহ সব বিরোধী রাজনৈতিক দল। বিএনপি তখন একদম একা। আমার খুব কষ্ট লাগছিল নিজের ভাগ্যবিড়ম্বনা দেখে। আমার বদৌলতে ক্ষমতায় আসা বিএনপি আমাকেই অস্বীকার করছে! নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে অভাগা মনে হচ্ছিল।

এদিকে আমাকে প্রতিষ্ঠিত করার আন্দোলনের অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগ সংসদ থেকে পদত্যাগ করল, জাতীয় পার্টি-জামায়াতও তাদের অনুগামী হলো। সৃষ্টি হলো আরেক ফ্যাসাদ। বিএনপি ততক্ষণে উপলব্ধি করতে পেরেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু ততদিনে জাতীয় সংসদে সংবিধান সংশোধনের মতো সদস্যসংখ্যা অবশিষ্ট নেই। ফলে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা এবং সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে সংসদ গঠনকল্পে একটি সাধারণ নির্বাচন দেওয়া ছাড়া তাদের কোনো গত্যন্তর রইল না। ১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৬ তারিখে অনুষ্ঠিত হলো সেই নির্বাচন। কিন্তু আওয়ামী লীগসহ আন্দোলনরত সবকটি দল সে নির্বাচন বর্জন করল। ফলে একটি একতরফা নির্বাচন করতে হলো বিএনপিকে।

ওটা ছিল বিএনপির জন্য একটি শিক্ষা। আর সে শিক্ষা হলো, সময়ের কাজ সময়ে না করার কুফল। প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ‘তৈল’ প্রবন্ধে লিখেছেন- ‘সময়ে এক ফোঁটা ঢালিলে যে কাজ হয়, অসময়ে কলস কলস ঢালিলেও কোনো লাভ হয় না’। বিএনপি সেটা টের পেল। তারা যদি ১৯৯১-এর নির্বাচনে তাদের ক্ষমতায় আসার প্রেক্ষাপট মনে রেখে শুরুতেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিত তাহলে তাদের একটি ভোটারবিহীন নির্বাচনের বদনাম বয়ে বেড়াতে হতো না। তখন বিএনপির স্লোগান ছিল- ‘তিন পাগলের আবিষ্কার, তত্ত্বাবধায়ক সরকার’। আমি খুব ব্যথিত হয়েছিলাম স্লোগানটি শুনে। ১৯৯০ সালে এই আমাকে যারা সবাই মিলে তৈরি করল, ছিয়ানব্বইয়ে এসে সেই আমি কি না হয়ে গেলাম ‘তিন পাগলের আবিষ্কার’! কিন্তু নিয়তির কি নির্মম পরিহাস! ১৫ ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনে গঠিত সংসদে বিএনপিকেই সর্বসম্মতিক্রমে পাস করতে হলো ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ বিল। আমি নতুন জীবন পেলাম। অবাক হলাম বিএনপির স্লোগানের ভাষা ও সুরে পরিবর্তন শুনে। তখন তারা স্লোগান দিল- ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার, দেশনেত্রীর উপহার’। আমি এ মৃত অবস্থায়ও মাঝেমধ্যে হাসি বাংলাদেশের রাজনীতিকদের কায়কারবার দেখে। সড়কে গাড়ি, নৌপথে জলযান আর আকাশপথে উড়োজাহাজের মোড় ঘোরাতে সময় লাগে, কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিকদের কথার মোড় ঘোরাতে সময় লাগে না। শুধু কি তাই? তারা চোখের পলকে আগের অবস্থানের একেবারে বিপরীত দিকে দাঁড়াতে পারেন। আমার কী মনে হয় জানেন? আজ যদি বিশ্ববিজয়ী আলেকজান্ডার তাঁর সেনাপতি সেলুকাসকে নিয়ে বাংলাদেশে তশরিফ আনতেন, তাহলে এ দেশের রাজনীতির হালহকিকত দেখে বলতেন, ‘সেলুকাস, কি বিচিত্র এ দেশের রাজনীতি!’

যা হোক, তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হওয়ার পরদিনই ষষ্ঠ সংসদের পরিসমাপ্তি ঘটল। গঠিত হলো সদ্যসাবেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১১ সদস্যের তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ১২ জুন হলো নির্বাচন। শান্তিপূর্ণ সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে জাতীয় পার্টি ও জাসদকে নিয়ে কোয়ালিশন সরকার গঠন করল। তারা রাষ্ট্রপতি বানাল সাবেক অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে। আওয়ামী লীগের এ সিদ্ধান্ত সর্বত্র প্রশংসিত হলো। একজন গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি করায় জনমনে এ ধারণা জন্মাল যে, ২১ বছর পর রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে। সেই সংসদে বিএনপির আসনসংখ্যা ছিল ১১৬। বাংলাদেশের সংসদীয় ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিরোধী দল ছিল ওটা। ভালোই চলছিল সবকিছু। আমিও খুব আনন্দিত মনে বিশ্রামে গেলাম। আবার পাঁচ বছর পর তিন মাসের জন্য আসব। আমি আশাবাদী হয়ে উঠেছিলাম অমরত্ব লাভ করতে যাচ্ছি ভেবে। কিন্তু তখন কি জানতাম, নিয়তি ক্রুর হাসি হেসে বলেছিল, বেটা তোর জীবন আর বেশিদিন নেই। কারণ এই বাঙাল মুলুকের মানুষের পেটে ভালো জিনিস হজম হয় না।

পাঁচ বছর পর ২০০১ সালে আবার আমাকে ঘুম থেকে জাগানো হলো। বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত হলো সাংবিধানিক দ্বিতীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ওই বছর ১ অক্টোবর হলো ভোটাভুটি। বিএনপি পেল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। এমন অস্ত্র হাতে পেয়ে ওরা আবার আমাকে জবাই করে ফেলবে না তো! যদি সংবিধান সংশোধন করে আবার দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের আইন করে বসে! কিন্তু আমার আশঙ্কা ভুল প্রমাণিত হলো। আমার গায়ে ওরা হাত দিল না। তবে বিচারপতিদের চাকরির বয়স বাড়িয়ে অহেতুক বিতর্কের জন্ম দিল। এতে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিচারপতি কে এম হাসান হয়ে গেলেন সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি। কে এম হাসান একসময় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তাই আওয়ামী লীগ বলল, দলীয় লোককে প্রধান উপদেষ্টা করার উদ্দেশ্যে বিএনপি এটা করেছে। আবার শুরু হলো হইহট্টগোল। বিএনপি সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার অগেই কে এম হাসান বলে দিলেন, তিনি প্রধান উপদেষ্টা হবেন না। তাহলে কে হবেন প্রধান উপদেষ্টা? নানারকম বিতর্ক, কূটচাল শেষে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ নিজেই নিজেকে প্রধান উপদেষ্টা ঘোষণা করলেন। গঠিত হলো তৃতীয় সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার। কিন্তু মতের মিল না হওয়ায় ১০ জনের মধ্যে চারজন উপদেষ্টা পদত্যাগ করলেন। এদিকে আওয়ামী লীগ তখন ধনুকভাঙা পণ করে বসে আছে ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদক প্রধান উপদেষ্টা রেখে তারা নির্বাচন করবে না। তারা জমা দেওয়া সব মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিলেন। আরেকটি একতরফা নির্র্বাচনের দিকে ধাবিত হচ্ছিল দেশ। আমার তখন ভীষণ মন খারাপ। দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছিলাম সামনে আমার দুর্দশা ঘনিয়ে আসছে।

এলোও শেষ পর্যন্ত। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন জারি করলেন জরুরি অবস্থা। বন্ধ হয়ে গেল নির্বাচন। আমি বেঁচে রইলাম অর্ধমৃতের মতো। আমাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ডাকা হলেও ওটা তখন সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত একটি অদ্ভুত সরকার। দুই বছর তারা ক্ষমতা দখলে রেখে শেষ পর্যন্ত নির্বাচন দিয়ে মানে মানে কেটে পড়ল। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর হলো নবম সংসদ নির্বাচন। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পেল ২৩০ আসন। বিএনপি মাত্র ৩০টি। কথায় আছে, সংসদীয় গণতন্ত্রে ‘ব্রুট মেজরিটি’ অর্থাৎ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া সরকার অনেক সময় ‘ব্রুটাল’ মানে নিষ্ঠুর হয়ে যায়। এবার হলোও তাই। ২০১১ সালে সংবিধান সংশোধন করে আমাকে হত্যা করা হলো। আর এর পেছনে যুক্তি দেখানো হলো ইতঃপূর্বে হাই কোর্টের দেওয়া একটি রায়ের অবজারভেশনকে। বলা হলো, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কারণ সংবিধানে বলা হযেছে, বাংলাদেশ সবসময় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত হবে। যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং অন্য উপদেষ্টারা নির্বাচিত হন না, তাই এ পদ্ধতি সংবিধানবিরোধী। ব্যস! আমার সমাধি রচিত হয়ে গেল। অথচ সংবিধানের সঙ্গে আমার গঠন পদ্ধতির যে বৈপরীত্য তা সহজেই দূর করা যেত। দরকার ছিল রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও ঐকমত্য। সবাই মিলে যদি সংসদে এ আইনটি পাস করত- সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ১১ জন বিশিষ্ট নাগরিককে ঐকমত্যের ভিত্তিতে ১১টি আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত করে আনা হবে এবং তাদের নিয়েই গঠিত হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, তাহলে বিষয়টি সংবিধানের সঙ্গে আর সাংঘর্ষিক থাকত না।

এখন আমি কবর থেকে শুনতে পাচ্ছি আমার জন্য অনেকেই কান্নাকাটি করছে; বিশেষত বিএনপি। একদা যারা আমাকে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল তারাই আমাকে ফিরে পাওয়ার জন্য জানবাজ আন্দোলনেরও হুংকার দিচ্ছে! অন্যদিকে আওয়ামী লীগ বলছে, আর কখনই নাকি আমার মুখ বাংলাদেশে দেখা যাবে না। জানেন তো, আমার জন্মস্থান বাংলাদেশে হলেও এরই মধ্যে বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে আমার মডেলে নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। আর আামি হয়ে গেলাম নিজভূমে পরবাসী! বলতে দ্বিধা নেই, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর সংকীর্ণতা ও ক্ষমতালিপ্সাই আমার অপমৃত্যুর জন্য দায়ী। একবার ক্ষমতায় গেলে তারা আর নামতে চায় না। এ মানসিকতার কারণে ২০০৭ সালে একদল আমাকে বগলদাবা করে পুনরায় ক্ষমতায় আসতে চেয়েছিল, আরেক দল সুযোগ পেয়ে আমাকে চিরবিদায় দিয়েছে। বিএনপি আজ আমার জন্য অঝরে কাঁদছে। কে জানে এমন দিনও তো আসতে পারে, যেদিন আওয়ামী লীগ আমার জন্য মাতম করবে! ফিরিয়ে আনতে চাইবে আমাকে। সবই নির্ভর করে রাজনীতির মৌসুমি বায়ুর ওপর। ওটা যে কখন কোন দিক থেকে বইতে শুরু করবে, কেউ বলতে পারে না।

                লেখক : সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক

সর্বশেষ খবর