শিরোনাম
রবিবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা
মেগা সিটি ঢাকা

নাগরিক বিড়ম্বনার নাম যানজট

প্রিন্সিপাল এম এইচ খান মঞ্জু

নাগরিক বিড়ম্বনার নাম যানজট

রাজধানী ঢাকা শহর দিন দিন যেন যানজট ও নানাবিধ নাগরিক বিড়ম্বনা এবং দুর্ভোগে পরিণত হচ্ছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে মানবজট। প্রতিদিনই হাজার হাজার মানুষ এসে ভিড় করছে এই ঢাকায়। কর্মহীন মানুষ যেমন আশ্রয় ও কর্মসংস্থানের জন্য ঢাকায় আসছে, আবার স্থানীয় সুযোগ-সুবিধার অভাব এবং সবকিছু ঢাকায় কেন্দ্রীভূত হওয়ার কারণে সচ্ছল ও নব্যধনী পরিবারগুলোও ঢাকামুখী হয়ে থাকে। পর্যাপ্ত রাস্তা ও নাগরিক সুযোগ-সুবিধার প্রতি লক্ষ্য না রেখে বছরের পর বছর অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠার কারণেই ঢাকা আজকের বেহাল দশায় উপনীত হয়েছে। ঢাকার নাগরিক বিড়ম্বনার অন্যতম কারণ যানজট। যানজট নিরসনে গত তিন দশকে প্রতিটি সরকার নানামুখী উদ্যোগ ও পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। যানজট কমাতে গত দুই দশকে শহরের দুই প্রান্তে বেশ কিছু ফ্লাইওভার নির্মিত হয়েছে। বর্তমান সরকার এমআরটি প্রকল্পের আওতায় এক দশক ধরে বিআরটি ও মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এতে প্রকল্প এলাকায় যানজটসহ নাগরিক বিড়ম্বনা আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেলেও আদতে এসব প্রকল্প যানজট ও নাগরিক বিড়ম্বনা কমিয়ে আনতে কতটুকু ভূমিকা রাখবে তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতভেদ ও সন্দেহ আছে। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত বাস্তবায়নাধীন বিআরটি প্রকল্পের অংশবিশেষ খুলে দেওয়ার পর সেখানে নতুন মাত্রায় যানজট ও যাত্রী বিড়ম্বনা দেখা দিয়েছে। ঢাকার যানজটে প্রতিদিন ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে বলে এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এর আর্থিক মূল্য বছরে ৩৭ হাজার কোটি টাকার বেশি। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, যত্রতত্র শিল্প-কারখানা গড়ে তোলা এবং অধিক জনসংখ্যার চাপে ঢাকার চারপাশের নদ-নদী, খাল-জলাভূমি, বায়ু ও মাটি দূষণের পাশাপাশি শব্দদূষণের মাত্রা জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।  এদিকে, রাজধানীসহ সারা দেশে ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচলের বিষয়টি নতুন নয়। বহু বছর ধরে এসব গাড়ি নির্বিঘ্নে চলাচল করছে। এসব যানবাহন যারা চালায় তাদের অনেকের বৈধ লাইসেন্স নেই। দীর্ঘদিন ধরে এই পরিস্থিতি চলছে। একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজধানীতে বৈধ লাইসেন্স ছাড়া বিভিন্ন সড়কে কমপক্ষে ৯০ হাজার যানবাহন চলাচল করছে। অধিকাংশ চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। রাজধানীর প্রায় ৭০টি রুটে এসব যানবাহন চলাচল করছে। রাজধানীর বাইরের ফিটনেসবিহীন যানবাহনও প্রবেশ করছে। মাঝে মাঝে পুলিশ ও বিআরটিএ ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে অভিযান চালালেও তার কোনো প্রতিকার হচ্ছে না। বাধাহীনভাবে এসব যানবাহন চলছে। রাজধানীতেই যদি এত ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন চালক বহাল থাকে, তাহলে দেশের অন্যান্য জেলা শহরে যানবাহনের কী অবস্থা, তা সহজেই অনুমেয়। এসব যানবাহন একদিকে যেমন পরিবেশ দূষণ করছে, অন্যদিকে যানজট সৃষ্টি ও দুর্ঘটনা ঘটিয়ে মানুষকে আহত-নিহত করছে। রাজধানীতে যেসব গণপরিবহন রয়েছে, সেগুলোর যাত্রী সুবিধা বলতে কিছু নেই। কোনো রকমে যাত্রী তুলেই চলাচল করছে। যেগুলোর ফিটনেস নেই, সেগুলো রীতিমতো মারণঘাতী হয়ে রয়েছে। সড়ক থেকে ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও লাইসেন্সবিহীন চালক উচ্ছেদে পুলিশ ও বিআরটিএকে সাঁড়াশি অভিযান চালাতে হবে। এসব যানবাহন ও চালক শনাক্ত করে শাস্তিমূলক কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। কোনোভাবেই এসব যানবাহন সড়কে চলাচল করতে দেওয়া যাবে না। ইট-পাথরের শহরের ঘিঞ্জি পরিবেশে মানুষ হাঁপিয়ে উঠছে। শিক্ষার্থীরা উন্মুক্ত প্রান্তর ও খেলার মাঠবিহীন বহুতল ভবনের কোনো ফ্লোরের দুই-তিন কক্ষ সংবলিত শিক্ষায়তনে প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে ফেলছে। ঢাকাসহ দেশের ব্যস্ত শহরগুলোতে একটু ফাঁকা জায়গা, পাখির গুঞ্জন, গাছগাছালি ও সবুজের মধ্যে স্বস্তিকর পরিবেশের প্রয়োজনীয়তা ভীষণভাবে অনুভূত হচ্ছে। তারপরও মনে হচ্ছে, অবস্থার উত্তরণে যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। ঢাকা নগরীকে বাঁচাতে হলে ঢাকার অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ডিসেন্ট্রালাইজেশন নিশ্চিত করতে হবে। অবিলম্বে ঢাকার ভিতরে ও চারপাশ থেকে কল-কারখানা সরিয়ে নিতে হবে। দেশের বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোর নাগরিক সুযোগ-সুবিধাসহ স্থানীয় কর্মসংস্থান বৃদ্ধির বহুমুখী উদ্যোগ ছাড়া ঢাকামুখী জনস্রোত কমিয়ে আনা সম্ভব নয়। রাজধানী শহরকে বসবাসের অযোগ্য, দূষিত, বিড়ম্বনা-দুর্ভোগের মধ্যে রেখে দেশকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির সোপানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও প্রাক্তন প্রিন্সিপাল এম এইচ খান ডিগ্রি কলেজ, গোপালগঞ্জ।

সর্বশেষ খবর