রবিবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

শিশুর সুন্দর চরিত্র গঠনে পিতা-মাতার দায়িত্ব ও কর্তব্য

মুফতি রুহুল আমিন কাসেমী

শিশুর সুন্দর চরিত্র গঠনে পিতা-মাতার দায়িত্ব ও কর্তব্য

পৃথিবীতে সন্তান-সন্ততি মহান রাব্বুল আলামিনের এক বিশেষ নিয়ামত। তাই তাদের চরিত্রবান করে গড়ে তোলার জন্য একদিকে পিতা-মাতা যেমনিভাবে সচেষ্ট থাকবেন, এর পাশাপাশি তারা এ বিষয়ে আল্লাহতায়ালার দরবারে দোয়াও করবেন। কেননা আল্লাহর অনুগ্রহ ছাড়া মানুষের চেষ্টা কখনই ফলপ্রসূ হতে পারে না। কোরআন মাজিদে পিতা-মাতাকে তাদের সন্তানের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করার উপদেশ এবং শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের জন্য এমন স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি দান কর, যারা আমাদের জন্য নয়ন প্রীতিকর এবং আমাদের মুত্তাকিদের জন্য ইমাম বানিয়ে দাও। (সুরা ফুরকান আয়াত ৭৪) প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, প্রতিটি শিশুই ফিতরাত তথা ইসলাম গ্রহণের যোগ্যতাসহ জন্মগ্রহণ করে, তারপর তার পিতা-মাতা তাকে ইহুদি, খ্রিস্টান অথবা অগ্নিপূজক বানায়। (বুখারি ও মুসলিম) উপরোক্ত হাদিস দ্বারা এ কথা বোঝা যায় যে, প্রতিটি শিশুই জন্মলগ্নে নিষ্পাপ, নিষ্কলঙ্ক, পাক ও পবিত্র হয়ে জন্মগ্রহণ করে। যার মাঝে উত্তম চরিত্রে চরিত্রবান হওয়ার সব যোগ্যতা বিদ্যমান থাকে। অতঃপর তার পিতা-মাতা হয়তোবা তার পবিত্রতা রক্ষা করে, অথবা তার পবিত্রতা বিনষ্ট করে। কেউবা মুসলিম হয়, অথবা কেহ কাফের মুশরিক হয়ে যায়। তাই প্রতিটি পিতা-মাতার জন্য আল্লাহপাকের দেওয়া নেয়ামতকে সুন্দরভাবে সুরক্ষা করার ব্যাপারে সচেতন হওয়া জরুরি। শিশুকালেই প্রথমে তারা নিজেদের সন্তানকে আল্লাহর অস্তিত্বের কথা, তার একত্ববাদের কথা এবং তার ওপর ইমান আনার কথা বলবে। চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র, আসমান-জমিন, তথা কুল কায়েনাতের একজন স্রষ্টা রয়েছেন, তিনিই সৃষ্টিকর্তা এবং তাঁর ইঙ্গিতেই সবকিছু চলে, এ কথাটা বুঝাবে। আমরা তার কাছ থেকে এসেছি, তার কাছেই আবার ফিরে যেতে হবে। অতঃপর তাদের শিখাতে হবে, রসুল, ফেরেশতা, কোরআন মাজিদ, কবর, হাশর-নশর, আখেরাত, বেহেশত-দোজখ ইত্যাদির ওপর ইমান আনয়নের কথা। শিরিক ও বিদআতের অকল্যাণ ও ভয়াবহতার কথা তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে। প্রিয় নবী, শ্রেষ্ঠ নবী, সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর ইমান আনা ও তার অনুসরণই আমাদের একমাত্র মুক্তির উপায়। পর্যায়ক্রমে ইমান ও ইসলামের বিষয়গুলো সহজসাধ্য ও বোধগম্য উপায়ে তাদের সামনে তুলে ধরা। এ প্রসঙ্গে হজরত লোকমান (আ.) তাঁর পুত্রকে যে নয়টি নসিহত করেছিলেন, যা আমাদের জন্য অনুসরণীয় এবং আল্লাহর কাছে খুবই পছন্দনীয়। তা কোরআন মাজিদে এভাবে উল্লেখ রয়েছে।

প্রথম নসিহত : হে বৎস! আল্লাহর সঙ্গে শিরক কর না, নিশ্চয়ই শিরক হচ্ছে চরম জুলুম। (সুরা লোকমান আয়াত ১৩) এখানে হজরত লোকমান (আ.) তার প্রিয় পুত্রকে যে নসিহত করেছেন, তার প্রথম কথাটিই হচ্ছে শিরিক পরিহার করে তাওহিদ তথা আল্লাহর একত্বের বিশ্বাস মনের মধ্যে দৃঢ়মূল ও স্থায়ী করার নির্দেশ।

দ্বিতীয় নসিহত : হে বৎস! কোনো কিছু যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয় এবং তা যদি থাকে শিলাগর্ভে অথবা আকাশে কিংবা মাটির নিচে, আল্লাহ তাও উপস্থিত করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সূক্ষ্মদর্শী সম্যক অবহিত। এখানে হজরত লোকমান (আ.) আল্লাহতায়ালার ইলম ও কুদরতের ব্যাপকতা ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মতার অকাট্য বর্ণনা পেশ করেছেন। আল্লাহ সম্পর্কে এ আকিদা মানুষকে সব ধরনের গোপন ও প্রকাশ্য গুনাহ এবং নাফরমানি থেকে বিরত রাখে।

তৃতীয় নসিহত : হে বৎস! সালাত কায়েম করবে। এখানে বোঝানো হয়েছে আকিদার ক্ষেত্রে তাওহিদ যেমন মূল তেমনি আমলের ক্ষেত্রে নামাজই হচ্ছে সবকিছুর মূল। সুতরাং নাবালক সন্তান-সন্ততি যেন শিশুকাল হতেই নামাজ কায়েমের ব্যাপারে অভ্যস্ত হয়ে যায়।

প্রিয় নবী ইরশাদ করেন : তোমরা তোমাদের সন্তান-সন্ততিদের নামাজ আদায় করতে আদেশ করবে, যখন তারা সাত বছর বয়সে পদার্পণ করবে এবং নামাজের জন্য তাদের শাসন করবে, যখন তারা ১০ বছর বয়সে পৌঁছবে। আর তখন তাদের জন্য আলাদা শয্যার ব্যবস্থা করবে। (আবু দাউদ)

চতুর্থ নসিহত : সৎকাজের আদেশ দেবে এবং অসৎ কাজে বাধা দেবে। এখানে বোঝানো হয়েছে, শুধু নিজে আমল করলেই হবে না। বরং অন্যকেও আমলে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

পঞ্চম নসিহত : বিপদে-আপদে ধৈর্য ধারণ করবে নিশ্চয়ই ইহাই দৃঢ় সংকল্পের কাজ। এর দ্বারা বোঝা যায়, প্রতিটি শিশুকে শিশুকাল থেকেই বিপদে-আপদে ধৈর্যশীল, সহনশীল, সৎ ও সাহসী হওয়ার শিক্ষা দিতে হবে।

ষষ্ঠ নসিহত : অহংকারবশত তুমি মানুষকে অবজ্ঞা ও তুচ্ছ জ্ঞান করবে না। অর্থাৎ পাড়া-প্রতিবেশী আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সুখে-দুখে মিলেমিশে জীবনযাপন করার শিক্ষা দেওয়া। নিজেকে কখনই আলাদা ও শ্রেষ্ঠ মনে না করা।

সপ্তম নসিহত : পৃথিবীতে উদ্যতভাবে বিচরণ করবে না। কারণ আল্লাহ কোনো উদ্যত অহংকারীকে পছন্দ করেন না।

অষ্টম নসিহত : তুমি পদক্ষেপ করবে সংযতভাবে।

নবম নসিহত : এবং তুমি তোমার কণ্ঠস্বর নিচু করবে। কেননা স্বরের মধ্যে গর্দবের স্বর সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর। চিৎকার চেঁচামেচি করে উচ্চৈঃস্বরে হুংকার দিয়ে বেয়াদবের মতো কথা বলা অনুচিত।  বরং বিনয়ের সঙ্গে নিচু স্বরে সম্মান বজায় রেখে কথা বলা ভদ্রতার পরিচায়ক। (উল্লিখিত বিষয়গুলো আলোচিত হয়েছে সুরা লোকমান আয়াত ১৩ থেকে ১৯ পর্যন্ত) হজরত  লোকমানের এই নয়টি নসিহতের গুরুত্ব অপরিসীম।

লেখক : ইমাম খতিব, কাওলারবাজার জামে মসজিদ, দক্ষিণখান, ঢাকা

সর্বশেষ খবর