বৃহস্পতিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

বিশ্বকাপ উন্মাদনা শেষ : দেশের ফুটবলে নজর দিন

তপন কুমার ঘোষ

বিশ্বকাপ উন্মাদনা শেষ : দেশের ফুটবলে নজর দিন

সদ্যসমাপ্ত কাতার বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচটি ছিল সর্বকালের সেরা ফাইনাল, এ কথা একবাক্যে মানছে ফুটবল দুনিয়া। ফ্রান্স ও আর্জেন্টিনার মধ্যে অনুষ্ঠিত ফাইনাল ম্যাচটি ছিল দুটি সেরা দলের মধ্যে টক্কর। দমবন্ধ করা উত্তেজনা। নির্ধারিত ৯০ মিনিট খেলার পর ফলাফল ২-২। অতিরিক্ত ৩০ মিনিট খেলার পর স্কোরলাইন ৩-৩। সমানে সমান। শেষমেশ ম্যাচের ফয়সালা হয় টাইব্রেকারে। দুই ফরাসি খেলোয়াড় গোল করতে ব্যর্থ হন। ফ্রান্সকে টাইব্রেকারে ৪-২ গোলে হারিয়ে তৃতীয়বারের মতো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছে আর্জেন্টিনা। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় বড়পর্দায় দেখানো হয়েছে ফাইনাল খেলা। রেফারির শেষ বাঁশি বাজানোর পর বাংলাদেশে খুশির জোয়ার বয়ে যায়। বাংলাদেশ যেন বিশ্বকাপ জিতেছে!

কাতার বিশ্বকাপের সেরা ফুটবলার হয়েছেন আর্জেন্টিনা দলের অধিনায়ক মহাতারকা লিওনেল মেসি। জিতেছেন গোল্ডেন বল। তিনি নিজে গোল করেছেন। সতীর্থদের দিয়ে গোল করিয়েছেন। তবে টুর্নামেন্টে মোট ৮টি গোল করে গোল্ডেন বুট জিতেছেন ফ্রান্স দলের তারকা খেলোয়াড় কিলিয়ান এমবাপ্পে। এমবাপ্পে ফাইনালে হ্যাটট্রিক করেছেন। সদ্যসমাপ্ত বিশ্বকাপের অন্যতম চর্চিত ফুটবল তারকা আর্জেন্টিনার গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্তিনেজ। টুর্নামেন্টের সেরা গোলরক্ষক হিসেবে তিনি গোল্ডেন গ্লাভস জিতেছেন। পরবর্তী বিশ্বকাপ (২০২৬) হবে সাড়ে তিন বছর পর। বিশ্বকাপ আবার ফিরে যাবে সেই জুন-জুলাইয়ে। আমেরিকা, মেক্সিকো ও কানাডা বিশ্বকাপ ২০২৬ যৌথভাবে আয়োজন করবে। মোট ১৬টি শহরে খেলা হবে। গণমাধ্যমের খবর, পরের বিশ্বকাপে দলের সংখ্যা ৩২ থেকে বেড়ে ৪৮ হয়েছে। আয়োজক তিনটি দেশ পরবর্তী বিশ্বকাপে সরাসরি খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছে।

সত্তরের দশকে ঢাকায় ফুটবল লিগ ঘিরে আবাহনী ক্রীড়া চক্র ও ঢাকা মোহামেডান সমর্থকদের মধ্যে যে উন্মাদনা ছিল তা এখন ইতিহাস। আমাদের ফুটবলের কেন এই দৈন্যদশা?
বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতায় এ উপমহাদেশের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। কিন্তু আছে প্রিয় দল ও প্রিয় খেলোয়াড়ের কোটি কোটি ভক্ত-সমর্থক। বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীর অধিকাংশই হয় আর্জেন্টিনা নয়তো ব্রাজিলের ফ্যান। বিশ্বকাপ চলাকালে আর্জেন্টিনা-সমর্থক ও ব্রাজিল-সমর্থকদের মধ্যে বচসার জেরে হাতাহাতি ও শেষমেশ খুনোখুনির বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। পতাকা টাঙাতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে বা গাছ থেকে পড়ে গিয়ে অকালে প্রাণ হারিয়েছেন কয়েকজন। খুবই মর্মান্তিক ঘটনা। কাতারে দুই দলের খেলোয়াড়রা যখন নিজেদের নৈপুণ্য ও রণকৌশল প্রদর্শন করে তামাম দুনিয়ার দর্শকদের মাতিয়ে রাখেন, তখন বাংলাদেশে আমরা দর্শকরা নিজেদের মধ্যে মারামারি-খুনোখুনিতে লিপ্ত হই। এই পাগলামির কোনো মানে হয় না! লড়াই শেষে বিজয়ী দলের সদস্যরা বিজিত দলের সদস্যদের সঙ্গে করমর্দন করছেন, সান্ত্বনা দিচ্ছেন- এ দৃশ্য আমরা টেলিভিশনের পর্দায় দেখছি। এ থেকে কী শিক্ষা পাই আমরা? খেলাধুলা বিনোদনের একটা উপলক্ষ মাত্র। বিশ্বকাপ একটা প্রতিযোগিতা। খেলায় জয়-পরাজয় থাকবেই। ফলাফল যা-ই হোক না কেন তা সহজভাবে মেনে নেওয়াটা প্রকৃত খেলোয়াড়ি মনোভাবের পরিচায়ক।

কাতার বিশ্বকাপ এখন অতীত। বিশ্বকাপ ঘিরে উন্মাদনা এখন থিতিয়ে পড়েছে। এবার চোখ ফেরানো যাক বাংলাদেশের ফুটবলের দিকে। ফুটবলে আমরা এগোতে পারিনি। বরং দিন দিন পিছিয়ে পড়েছি। ফিফার সর্বশেষ ক্রমতালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ২১১ দেশের মধ্যে ১৯২তম। প্রতিবেশী দেশ ভারত ও নেপালের অবস্থান আমাদের ওপরে। একসময় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪৯তম। সত্তরের দশকে ঢাকায় ফুটবল লিগ ঘিরে আবাহনী ক্রীড়া চক্র ও ঢাকা মোহামেডান সমর্থকদের মধ্যে যে উন্মাদনা ছিল তা এখন ইতিহাস। আমাদের ফুটবলের কেন এ দৈন্যদশা? খতিয়ে দেখেছি কখনো আমরা? অভাব কি সদিচ্ছার না পৃষ্ঠপোষকতার?

বিশ্বকাপ ফুটবল প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের অংশগ্রহণ দূর অস্ত। অসম্ভবের পায়ে মাথা কুটে লাভ নেই। এশিয়া কাপ জয়ের স্বপ্ন আপাতত থাক। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের স্বপ্ন তো দেখাই যায়। কিন্তু তার জন্য আমরা কতটা প্রস্তুত? বাংলাদেশ সর্বশেষ ২০০৩ সালে সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়ন হয়। এরপর কেটে গেছে ১৯টি বছর। এটা নিয়ে দেশের ফুটবলের অভিভাবক সংস্থা বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) খুব একটা দুশ্চিন্তা আছে বলে মনে তো হয় না। বাফুফে শীতঘুমে! আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়াতে হবে। অনেকেই আক্ষেপের সুরে বলেন, বাফুফের ভিতরের ‘ঘুঘুর বাসা’ ভাঙতে না পারলে আমাদের ফুটবলের দৈন্যদশা ঘুচবে না। আমাদের ফুটবলের মানোন্নয়নে কী করা দরকার তা সবারই জানা। রাতারাতি উন্নতি করা সম্ভব নয়। মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা করে অভীষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে। তৃণমূল পর্যায়ে উদীয়মান ও প্রতিভাবান ফুটবল খেলোয়াড়দের খুঁজে বের করতে হবে। প্রতিভার লালন করতে হয়। নইলে প্রতিভা অকালেই ঝরে পড়ে। প্রতিভা অন্বেষণ, প্রতিভা বাছাই, ক্যাম্পে নিবিড় প্রশিক্ষণ, প্রতিযোগিতা আয়োজন, বিদেশে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ- এভাবে ধাপে ধাপে শক্তিশালী টিম গড়ে তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই অর্থের জোগান বড় ফ্যাক্টর। করপোরেট যুগে স্পনসরের অভাব হওয়ার কথা নয়। বসুন্ধরা গ্রুপ পেশাদার লিগসহ সাতটি লিগের স্পনসর করছে। আমরা ফুটবলকে সত্যি ভালোবাসি কি না এবার তা প্রমাণ করতে হবে। বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল দেশের জন্য আন্তর্জাতিক সম্মান বয়ে এনেছে। চলতি বছর সাফ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এদের অনেকেই উঠে এসেছে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি) থেকে। ভাবতে ভালো লাগে, বাংলাদেশ একদিন ফুটবলের বড় মঞ্চে খেলবে। আমরা বাংলাদেশিরা যে যেখানেই থাকি না কেন, বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকি না কেন ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ বলে চিৎকার করে গলা ফাটাব। কবে আসবে সেই দিন? আমাদের ফুটবলের মরা গাঙে জোয়ার আসবে কবে?

লেখক : ফুটবলপ্রেমী

সর্বশেষ খবর