মঙ্গলবার, ১০ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

আসুন বিষণ্ণতাকে ‘না’ বলি

প্রকাশ চন্দ্র অধিকারী

আসুন বিষণ্ণতাকে ‘না’ বলি

ব্যক্তিমাত্র সুস্থ দেহ-মনের প্রত্যাশী। কিন্তু কখনো কখনো ব্যস্ত জীবনের কর্মধারা ও পরিবেশ-প্রতিবেশ আমাদের সুস্থ দেহ-মন বিষিয়ে জীবন করে তুলছে ভারাক্রান্ত। তখন মনে ভর করে বিভিন্ন মানসিক সমস্যার বিষময়তা, ফলে জীবন হারিয়ে ফেলে তার স¦াভাবিক ছন্দ। মনের ছন্দপতনের তথা জীবন বিষময় করতে অন্যতম দায়ী এমন এক মনস্তাত্ত্বিক বিষ হলো বিষণ্ণতা।

সাধারণ ব্যক্তি প্রায় প্রতিদিন বেশির ভাগ সময় দুঃখিত থাকে। ব্যক্তির নিজের বাস্তব কাজকর্মের প্রতি আগ্রহ ও আনন্দহীনতা দেখা দেয়। সহজে ব্যক্তির ঘুম আসে না, আর ঘুম এলেও মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে আর ঘুম আসে না। কেউ কেউ খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে পড়ে। আবার কখনো কখনো কারও করও খুব ঘুম বেড়ে যায়। ব্যক্তির সক্রিয়তার মাত্রায় পরিবর্তন ঘটে। হয়তো ব্যক্তি অলস হয়ে যায় নতুবা বেশি উত্তেজিত বা কর্মক্ষম হয়ে ওঠে। ব্যক্তির ক্ষুধা কমে যায় ও ওজন কমে যায় অথবা ক্ষুধা বেড়ে যায় ও ওজন বেড়ে যায়। দিনের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যক্তি ক্লান্তি বা অবসন্ন বোধ করে। রোগীর মধ্যে নেতিবাচক আত্মধারণা বিকাশ ঘটে। নিজেকে দোষ দেওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়, নিজেকে অপদার্থ মনে করার বদভ্যাস গড়ে ওঠে। বেশির ভাগ কাজে ব্যক্তি সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। ব্যক্তির মধ্যে পুনঃ পুনঃ আত্মহত্যা চিন্তা অথবা মৃত্যুচিন্তা পেয়ে বসে। ব্যক্তির মনোযোগ সমস্যা দেখা দেয়। সমাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়।

ডিএসএম-৫ অনুযায়ী উপোরক্ত লক্ষণগুলোর থেকে বক্তির মধ্যে পাঁচটি বা তার বেশি কমপক্ষে ১৫ দিন স্থায়ী হলে তাকে ব্যক্তির গুরুতর বিষণ্ণতা হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। মেজাজ প্রভাবক জীবনধারার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নিত্য রুটিনে কতিপয় অভ্যাস গ্রহণ করার মাধ্যমে : মানুষ যখন বিষণ্ণতায় ভোগে, ওষুধ ছাড়া তখন জীবনধারার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কতিপয় ব্যবস্থাপনাকে পরিবর্তন সাধন করে বিষণ্ণতাকে দূর করতে পারা যায়। জীবনধারার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঘটনাগুলো যেমন সকালে ঘুম থেকে উঠে শারীরিক ব্যায়ামের অভ্যাস, ভোরের প্রকৃতিকে আনন্দের সঙ্গে উপলব্ধি করা, মন দিয়ে শখের কাজ করা, স্রষ্টার কাছে চিঠি লেখা, খোলা আকাশের নিচে গিয়ে নীল মেঘের দিকে তাকিয়ে থাকা ইত্যাদি পদক্ষেপ মনকে ভালো করে যা বিষণ্ণতা দূর করতে সহায়ক।

চিন্তার অভ্যাসের পরিবর্তে মনের ভিতর লুক্কায়িত কল্পনাকে লিখে প্রকাশ করা : জার্নালে লেখার অভ্যাস বিষণ্ণতা দূরীকরণে বেশ কার্যকর থেরাপি হিসেবে কাজ করে যা বিষণ্ণতা হ্রাসে সহায়ক হিসেবে বিবেচিত। ব্যক্তিগত জার্নালে নিজের অনুভূতি, চিন্তা ও উদ্বেগ সততার সঙ্গে লিপিবদ্ধ করুন এবং বিষণ্ণতাকে চ্যালেঞ্জ করুন। আপনি ভেবে অবাক হবেন যে প্রতিদিন নিয়ম করে কয়েক মিনিট এক টুকরা কাগজে আপনার অনুভূতিকে লিপিবদ্ধের মাধ্যমে বিষণ্ণতা থেকে মুক্তির অন্যতম পথ খুঁজে পেতে পরম সহায়ক হতে পরে।

কাজের মাধ্যমে নিজেকে ব্যস্ত রাখুন : যাদের বিষণ্ণতার অভিজ্ঞতা বিদ্যমান, তারা নিম্নমাত্রার আত্মমর্যাদাবোধ করে যে কারণে তার কোনো কাজে আনন্দ না পাওয়ার দরুন সাধারণত সমাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে একাকী সময় কাটাতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এ ক্ষেত্রে তাদের বন্ধুবৎসল হওয়া সময়ের দাবি। বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতে নিজেকে নিয়োজিত করুন, তাদের হ্যালো করুন, একসঙ্গে ডিনার করুন, একসঙ্গে ঘুরতে বের হোন, একসঙ্গে হাঁটতে বের হোন, গল্পে একসঙ্গে মেতে উঠুন। মোট কথা ব্যস্তজীবনের মূল্যবান সময়কে কাজ ও আনন্দের সঙ্গে অতিবাহিত করুন। তবেই দেখবেন বিষণ্ণতা কোনো প্রকার ওষুধ ছাড়া এমনিতেই দূর হয়ে গেছে। আত্মধারণার উন্নতি সাধনে আত্মনিয়োগ করুন : বিষণ্ণ ব্যক্তিদের নিম্নমাত্রার আত্মমর্যাদার অভিজ্ঞতা থাকার কারণে তারা তাদের আত্মক্ষমতা সঠিকভাবে প্রকাশ করতে ব্যর্থ হয়। সে কারণে আপনার ভিতর লুক্কায়িত বিদ্যমান সম্ভাবনাময় শক্তিকে ফোকাসকরণের মাধ্যমে ইতিবাচক চিন্তার অভ্যাসকরণ ব্যক্তির সম্ভাবনাকে ফুটিয়ে তুলতে সহায়ক; যা বিষণ্ণতা দূরকরণে পথ হিসেবে বিবেচিত।

রুটিন অনুযায়ী কাজ করুন : বিষণ্ণ ব্যক্তিদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কাজের আগ্রহে নেতিবাচক প্রবণতার ধারা প্রতীয়মান হয়। সময়োযোগী ও নিয়মমাফিক রুটিনব্যবস্থার মাধ্যমে কাজের অভ্যাস আপনার বিষণ্ণতা হ্রাসকরণে অন্যতম সহায়ক হিসেবে কাজ করতে পারে।

স্বাস্থ্যসম্মত ঘুমের অভ্যাস গড়ে তুলুন : রাতের পর্যাপ্ত ঘুম ব্যক্তির সুন্দর মেজাজ বজায় রাখতে অন্যমত সহায়ক। বিষণ্ণ ব্যক্তিরা ঘুমের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় সমস্যায় ভুগে থাকেন। যদিও অনেক সময় তারা বেশি সময় ব্যাপী ঘুমায় তথাপি তা অনেক ক্ষেত্রে অদক্ষ ঘুম হিসেবে বিবেচিত। নিয়মিত কমপক্ষে সাত আট ঘণ্টা দক্ষ ঘুমের শিডিউল বজায় রাখতে প্রতিদিনি নির্দিষ্ট রুটিন অনুযায়ী বিছানায় ঘুমাতে যাওয়া এবং সকালে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস গড়ে তুলুন; যা বিষণ্ণতা অনেকাংশে দূর করতে সহায়ক।

সুন্দর মেজাজ বাহক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলুন : ব্যক্তির সুন্দর মেজাজ তথা সুন্দর জীবনযাপনে খাদ্য ও পুষ্টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। খাবারে যত দূর সম্ভব বিশুদ্ধ সাদা চিনি ও ভাজা জাতীয় খাবার, ক্যাফেইন বা সোডাসমৃদ্ধ খাবার যতদূর সম্ভব খাবার তালিকা থেকে পরিত্যাগে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে কারণ এরূপ খাবার আমাদের নার্ভাস সিস্টেম দুর্বল করে তুলতে সহায়ক।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি সুন্দরবন আদর্শ কলেজ, খুলনা

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর