মঙ্গলবার, ১৭ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

মৃণালের মা গীতা রাণী দাসের শ্রাদ্ধে

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

মৃণালের মা গীতা রাণী দাসের শ্রাদ্ধে

বেশ কয়েক বছর পর বিক্রমপুর গিয়েছিলাম। দেশে ফিরে বিক্রমপুর গিয়েছিলাম সে অনেক দিন। বিক্রমপুর এক খালের পাড়ে বিরাট মাঠে সংবর্ধনা ছিল। লোকজন হয়েছিল আশাতীত। প্রবীণ রাজনীতিক আমির হোসেন আমুর সঙ্গে গিয়েছিলাম। সেদিন যেমন প্রিয় ওবায়দুল কাদেরের সভামঞ্চ ভেঙে পড়েছিল তেমনি আমাদের মঞ্চও ভেঙে পড়েছিল। দয়াময় আল্লাহর মেহেরবানি কারও কোনো ক্ষতি হয়নি। বিশেষ করে আমির হোসেন আমুর।  আমির হোসেন আমুকে আমি আগাগোড়া ভীষণ শ্রদ্ধা করি, ভালোবাসি। দলের জন্য, দেশের জন্য তাঁর দরদের শেষ নেই। অনেক বছর নির্বাসনে ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে হত্যার প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করেছিলাম। তার আগে মুক্তিযুদ্ধে ছোটখাটো ভূমিকা রেখেছিলাম। স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে লন্ডন-দিল্লি হয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ফিরে এলে তাঁর এক কথায় ২৪ জানুয়ারি, ১৯৭২ আমাদের সব অস্ত্র তাঁর পায়ের কাছে বিছিয়ে দিয়েছিলাম। প্রথম প্রথম চিন্তা করেছিলাম, প্রতীক হিসেবে একটা অস্ত্র পিতার হাতে দেব। কিন্তু কেন যেন দুই দিন আগে মনে হচ্ছিল হাতে নয়, পায়ের কাছে বিছিয়ে দেওয়া দরকার। অন্তত এটা বোঝাতে, অস্ত্র কোনো শক্তি নয়। অস্ত্র যারা চালায় তারাই আসল শক্তি। যাঁর নির্দেশে, যাঁর কথায় অস্ত্র পরিচালিত হয় তিনি লোহালক্কড়ের অস্ত্রের চাইতে অনেক বেশি শক্তিমান, অনেক বেশি মহান। তাই বঙ্গবন্ধুর হাতে অস্ত্র না দিয়ে পায়ের সামনে বিছিয়ে দিয়েছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে আমার ব্যবহৃত পুলিশের ব্যাটাগানটি বঙ্গবন্ধুর পায়ের সামনে বিছিয়ে দিয়েছিলাম। তিনি অস্ত্রটি তুলে হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আনোয়ারুল আলম শহীদের হাতে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে কিছু বলতে মাইক এগিয়ে দিলে তিনি বলেছিলেন, ‘তুই বল’। প্রথম প্রথম বলার কোনো ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু দ্বিতীয়বার বলায় আদেশ মনে করে বলেছিলাম, ‘উপস্থিত ভাই-বোনেরা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু আমাদের হাতে একটা চাকুও দিয়ে যেতে পারেননি। শুধু হুকুম দিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর নির্দেশ মাথায় নিয়ে পাকিস্তান হানাদারদের সঙ্গে রাতদিন যুদ্ধ করে নিজেদের যেমন রক্ষা করেছি, তেমনি দেশকে রক্ষা করেছি। উপরন্তু হানাদারদের পরাজিত করে দেশ স্বাধীন করেছি। আমাদের মা-বাবা-ভাই-বোন কেউ হানাদারদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেননি। আমাদের হাতের অস্ত্র পাকিস্তানি হানাদারদের রুখেছে। তাই যাঁর নির্দেশে যুদ্ধ করেছি তাঁর কাছেই আমরা আমাদের সব অস্ত্র ফিরিয়ে দিলাম। আবার যাতে বাঙালি জাতি নির্যাতিত না হয়। দুষ্টের দমন শিষ্টের পালনে এইঅস্ত্র যেন ব্যবহৃত হয়। যারা আমাকে বিশ্বাস করে পাশে দাঁড়িয়েছে, যুদ্ধ করেছে, রক্ত দিয়েছে, কেউ কেউ জীবন দিয়েছে তারা যেন প্রতারিত না হয়।’ এরপর বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘কাদের-লতিফকে আমি মায়ের পেট থেকে পড়তে দেখেছি। আমি তোমাদের সব কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করব। ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মচারী কাউকে রাখা হবে না। তোমরা কাদেরকে বলবে, লতিফকে বলবে, শহীদকে বলবে। যে কর্মচারী দুর্নীতি করবে আমি তাকে জানিয়ে দেব Your services are no longer required.’ এরপর ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সভা হয়েছিল টাঙ্গাইলে। পার্ক ময়দান লোকে ভরে গিয়েছিল। তখন দেশে ছিল সাড়ে ৭ কোটি মানুষ। এখন ১৭-১৮ কোটি। এখন কেউ চেষ্টা করেও ও রকম ১২-১৫ লাখ লোকের সমাবেশ ঘটাতে পারবে না। তখন যেটুকু নিয়ে টাঙ্গাইল পার্ক ছিল এখন সেটা তিন-চার টুকরো হয়েছে। তখন সময়ই ছিল আলাদা। মানুষের মধ্যে এক নবজাগরণের সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু আমরা অস্ত্র জমা দেওয়ার পর খুব বেশি শান্তিতে থাকতে পারিনি। আমার দলের শ্রেষ্ঠ বীর আবদুস সবুর খান বীরবিক্রম এবং আবুল কালাম আজাদ বীরবিক্রমকে অযথাই গ্রেফতার করা হয়েছিল। আমি ইচ্ছা করলে জেল থেকে তাদের বের করে আনতে পারতাম। সে সময় সবুর খান ও আবুল কালাম আজাদ আইনের হাতে ধরা না দিলে শক্তিতে প্রশাসন কিছুই করতে পারত না। জেলারকে বললে অথবা জেল সুপারকে গাড়ি করে বীরবিক্রম আবদুস সবুর খান ও আবুল কালাম আজাদকে বাড়ি পৌঁছে দিতে বললে তারা দিয়ে যেত। কিন্তু আমি কোনোমতেই সবুর খান ও আবুল কালাম আজাদকে ছেড়ে দিতে বলতে পারিনি। মন সায় দেয়নি। জেল সুপার ও জেলার বিকাল ৫টায় আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। সবুর খান ও আবুল কালাম আজাদকে গ্রেফতারের পরপরই টাঙ্গাইলের ডিসি পালিয়েছিলেন। বিকাল থেকে আমার যেন কেমন লাগছিল। বারবার ভাবছিলাম, যে সবুর না হলে মুক্তিযুদ্ধে আমি হয়তো বেঁচে থাকতাম না। নাগরপুরের যুদ্ধে আমি হয়তো মরেই যেতাম। যে আবুল কালাম আজাদ হানাদারদের হাতে গ্রেফতার হলে রেডিও পাকিস্তান ঢাকা না হলেও ১০-১৫ বার তার সাক্ষাৎকার প্রচার করেছিল, আমি যে একজন দুর্দান্ত মানুষ। গাছের মতো লম্বা। কেউ সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে সাহস পায় না। ভর-পাহাড় গাছের গোড়ে গোড়ে মুক্তিযোদ্ধা, বেশুমার, কোনো হিসাব নেই। এ ধরনের একটি সাক্ষাৎকারে সারা পৃথিবীর মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকার কথা জেনেছিল। বিশেষ করে দেশের মানুষ আমাদের শক্তি-সামর্থ্যরে কথা জেনেছিল। সেজন্যই আবুল কালাম আজাদের নাম বীরত্বসূচক খেতাবের জন্য সুপারিশ করা হয়েছিল। শুধু আর্মির লোকদের নিয়ে গঠিত খেতাব প্রদান কমিটি আবুল কালাম আজাদকে বীরবিক্রম খেতাবে ভূষিত করেছিল। কাদেরিয়া বাহিনীতে একটি বীরউত্তম, তিনটি বীরবিক্রম এবং ১৪টি বীরপ্রতীক খেতাব পেয়েছিল। সেই বীরবিক্রম সবুর খান, বীরবিক্রম আবুল কালাম আজাদ জেলে আর আমি কী করে বিছানায় যাব! সত্যিই সে রাত শুতে যাইনি, সারা রাত ছটফট করেছিলাম। এক-দেড় শ কমান্ডার, শ দুই বীরযোদ্ধা, পাঁচ-ছয় জন মাননীয় সংসদ সদস্য, ৫০-৬০ জন রাজনৈতিক নেতা সে রাত বিছানায় যাননি। ওয়াপদা ডাকবাংলোর পুরো মাঠ লোকে ভরা। দু-চার বার আমাদের নেতারা এমনও বলছিলেন, সবুর আর আবুল কালাম আজাদকে ছেড়ে দিতে বলেন। আমি সব সময় তাদের আমার অক্ষমতার কথা জানাচ্ছিলাম। লতিফ সিদ্দিকী, বাছেত সিদ্দিকী, হাতেম আলী তালুকদার, হুমায়ুন খালিদ আরও কে কে জেলগেটে গিয়ে সবুর ও আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে কথা বলে জেলারকে বলেছিলেন, আমরা যদি এদের নিয়ে যাই আপনারা কী করবেন? জেলার বলেছিলেন, স্যার যদি নির্দেশ দেন আমরা তার জিম্মায় দুজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে ছেড়ে দেব। সেটা বোধহয় রাত সাড়ে ৮টা-৯টা। নেতারা যখন বললেন, আপনি একটা কাগজে লিখে দেন এদের ছেড়ে দিতে, অথবা জেল সুপারকে কিংবা জেলারকে ফোনে বলুন। তারা সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দেবেন। আমার মন সায় দেয়নি। রাত সাড়ে ১১টায় নেতা ও পিতা ফোন করেছিলেন, ‘কাদের টাঙ্গাইলে কী হয়েছে?’ বলেছিলাম, আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কেন? আপনার তো অনেক লোক। আপনি তো সব জেনেছেন। পিতার মতো বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ-রে আমি সব শুনেছি। কাল কোর্ট বসার সঙ্গে সঙ্গে ওদের ছেড়ে দেবে। তুই ওদের নিয়ে আমার কাছে আসিস।’ পরদিন সত্যিই ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। টাঙ্গাইলে তখন মারাত্মক উত্তেজনা। তখন হোম মিনিস্টার ছিলেন টাঙ্গাইলের জননেতা আবদুল মান্নান। সেই এক গ্রেফতারের কারণে মান্নান ভাইয়ের জনপ্রিয়তা অনেকটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সেই কাজের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া অনেক দিন ছিল। সত্য কথা বলতে কি, মান্নান ভাইয়ের মৃত্যুর আগে সেই রেষারেষি কখনো পুরোপুরি মেটেনি। কিছু না কিছু কোথাও না কোথাও এর ডালপালা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। শুধু মান্নান ভাইয়ের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বন্দ্ব পরিবেশ-পরিস্থিতির অবনতি ঘটায়নি। লতিফ সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ দুজন একসময় এক আত্মা এক প্রাণ ছিলেন। আমাদের বাইরের ভাঙা বৈঠকখানায় লতিফ সিদ্দিকীর কাছে হাত-পা নাড়িয়ে মাসের পর মাস শাজাহান সিরাজ বক্তৃতা শিখতেন। অথচ তাঁদের দ্বন্দ্বে টাঙ্গাইল এবং সর্বোপরি বৃহত্তর ময়মনসিংহ অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখনো দলাদলি-হানাহানির জন্য কিছু না কিছু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

আমরা অনেক সময় অনেক কাজ করি, ফলের কথা চিন্তা করি না। কিন্তু কোনো কোনো ছোটখাটো কাজেরও মারাত্মক কুফল দেখা দেয়। ১৯৭২ সালে তেমন কোনো কারণ ছাড়া বীরবিক্রম সবুর খান ও আবুল কালাম আজাদকে হঠাৎই গ্রেফতার করে পাওয়ার না দেখালে অনেক ভালো হতো, আমরা ভালো থাকতাম। টাঙ্গাইল সর্বোপরি সারা দেশ উপকৃত হতো। কিন্তু আমরা তখন সেটা বুঝতে পারিনি। ক্ষতি যা হওয়ার হয়েছে। ২০১৪ সালে একটা একেবারে অস্বাভাবিক অসুন্দর নির্বাচনের পর ২৮ জানুয়ারি মতিঝিলে কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগের অফিসের সামনে ফুটপাতে অবস্থানে বসে ছিলাম। প্রচ- শীত এবং নানা রকম উপদ্রবের কারণে ভীষণ কষ্ট হয়েছে। সে সময় টুঙ্গিপাড়ায় পিতার কবর জিয়ারতে গিয়েছিলাম। ফেরার পথে বিক্রমপুর শহরে শহীদ মিনারের পাদদেশে তাঁবু খাটিয়ে এক রাত থাকার কথা ভেবেছিলাম। আমরা শহীদ মিনারে যাওয়ার ঘণ্টা দুই পর হঠাৎই দেখলাম ছাত্রলীগের নামে ১০-১২ জন একটা মাইক নিয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে দেয়। তারা সেখানে সভা করবে। আমাকেসহ আমার কর্মীদের নানাভাবে উত্ত্যক্ত করে। আমরা সেখান থেকে চলে এসে ধলেশ্বরীর পাড়ে কুচিয়ামোড়া স্কুলমাঠে অবস্থানে নিই। প্রথম কথা ছিল কুচিয়ামোড়া সাঁতারে বিশ্বজয়ী ব্রজেন দাসের বাড়ির পাশে স্কুল অ্যান্ড কলেজঘরে রাত কাটাব। দু-চার দিন আগে আমাদের লোকজন প্রিন্সিপালের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি আগ্রহের সঙ্গে আমাদের জন্য কয়েকটা ঘর ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেন। আমরা কুচিয়ামোড়া পৌঁছার কয়েক ঘণ্টা আগেও স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। কিন্তু আমরা পৌঁছার পরপরই সব ওলটপালট হয়ে যায়। ওখানকার এমপি সাহেব সবকিছু বন্ধ করে দেন। প্রিন্সিপালকে আর পাওয়া যায়নি। তাতে আমাদের কোনো অসুবিধা হয়নি। আমরা তাঁবু খাটিয়ে মাঠেই পড়ে ছিলাম। মাঠের পাশে দু-তিনটি বাড়ি থেকে আমার জন্য খাবার এসেছিল। সকালে রুটি ডিম সবজি দিয়ে পাশের বাড়ির একজন খাইয়েছিলেন। অন্য শতাধিক কর্মী তাদের মতো ব্যবস্থা করে নিয়েছিলেন। সেদিনের সেই কুচিয়ামোড়া রাতযাপন আজও আমার জীবনে মধুর স্মৃতি হয়ে রয়েছে। সেই ২০১৫ সালের পর এই প্রথম বিক্রমপুর গিয়েছিলাম মৃণালকান্তি দাস এমপির মায়ের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে। কদিন আগেও মৃণাল ফোন করেছিল, ‘দাদা, ১৪ জানুয়ারি শনিবার আমার মায়ের শ্রাদ্ধ। আপনি এলে আশীর্বাদ করলে আমার মায়ের আত্মা শান্তি পাবে।’ বলেছিলাম, ভেবে দেখব, চেষ্টা করব।

’৯০-এ দেশে ফিরলে অনেক তরুণ তাজা ছেলেকে বোন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে ছায়ার মতো দেখেছি। হালুয়াঘাটের সালাম, আয়নাল, ফরিদপুরের বিজন কুমার সাহা, বিক্রমপুরের মৃণালকান্তি দাস এমপি, নেত্রকোনার মানু মজুমদার এমপি ও আরও অনেকে। সারা জীবন আমাকে ঘিরে অনেক মানুষ কাটিয়েছে। তাদের অবদান আমি কোনো দিন বলে শেষ করতে পারব না। নেত্রীর জন্যও কিছু কর্মী জীবন দিয়ে তাঁর পাশে থেকেছে। তাদের মধ্যে মৃণালকান্তি দাস অন্যতম। তাই গিয়েছিলাম। ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জের মুক্তারপুর সেতু হয়ে বিক্রমপুরের দূরত্ব ৩৫-৪০ কিলোমিটার। কিন্তু পদ্মা সেতুর চমৎকার রাস্তায় শ্রীপুর হয়ে বিক্রমপুর অনেক দূর, প্রায় ৮০ কিলোমিটার। ভালো রাস্তায় যেতে শ্রীপুরের রাস্তা ধরেছিলাম। মাঝে রাস্তার পাশে ইছাপুর ইউনিয়ন পরিষদ ভবন দেখে বেশ ভালো লাগল। অনেক বছর পরে গিয়েও বিক্রমপুরের তেমন উন্নতি দেখিনি। শহরেও এখানে ওখানে ছড়ানো ছিটানো অনেক পরিত্যক্ত জায়গা দেখলাম। খুবই অবাক লেগেছে ‘খাল ইস্ট’ বলে একটি জায়গা দেখে। প্রথম প্রথম কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না। কখনো উচ্চারণ করছিলাম খালিস্ট, কখনো অন্য কিছু। প্রায় ১০-১৫ মিনিট চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত সমাধান হলো খাল ইস্ট মানে খালের পূর্ব। ক্যানেল ইস্ট হলেও বুঝতে অত অসুবিধা হতো না, সময় লাগত না। কিন্তু সত্যিই খাল ইস্টের জন্য প্রচুর সময় লেগেছে। ঢাকা থেকে বুড়িগঙ্গায় চীন মৈত্রী সেতু পার হয়ে ধলেশ্বরীর দুটি সেতু ১৯৯০-’৯৫-এর দিকে ১৫-২০ কোটি টাকা প্রাক্কলনে আমিনরা বানিয়েছিল। তার পাশে প্রায় হাজার কোটি টাকায় এখন ধলেশ্বরীর নতুন দুই সেতু। ধলেশ্বরী থেকে পুব দিকে যাওয়ার চিন্তা করছিলাম। কিন্তু পরে শ্রীপুরের ছনবাড়ী হয়ে বিক্রমপুর বাজার দোকানপাট যে যে জায়গায় আছে সেখানে একটু যানজট থাকলেও অন্যসব জায়গা পরিষ্কার। যেতে আসতে কোনো কষ্ট হয়নি। বিক্রমপুরে মৃণালের মায়ের শ্রাদ্ধের জায়গাও ছিল বেশ পরিপাটি। অসাধারণ সম্মান দেখিয়েছে সবাই। আওয়ামী লীগের সম্মেলনের আগের দিন ২৩ ডিসেম্বর সপরিবারে বোনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়ায় অনেকে ধরে নিয়েছেন সবকিছু মিটমাট হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের উচ্ছ্বাস আর আদরযতেœর শেষ ছিল না। মৃণাল আগের মতোই ছুটে এসে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করায় মনে হলো সবাই যেন স্বর্গ পেল। বসেছিলাম মুক্তিযোদ্ধাদের টেবিলে। তাঁরা আরও উজ্জীবিত উদ্বেলিত। কে কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। অন্যদিকে নারায়ণগঞ্জের সভাপতি, কৃষক-শ্রমিক- জনতা লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক দেলোয়ারকে ফোন করেছিলাম। সেও তার বোনজামাই পারভেজসহ বেশ কিছু নেতা-কর্মী নিয়ে এসেছিল। আমি এখন সাধারণত বাইরে তেমন কিছু খাই না। গত বছরের বেশ কিছুদিন সত্যিই অনেকটা কষ্টে কাটিয়েছি। চলাফেরা করতে কষ্ট হতো, উঠতে বসতে লিখতে ছিল অসুবিধা। আল্লাহর অপার মেহেরবানিতে প্রায় অনেক অসুবিধাই চলে গেছে। শরীরে কোনো ব্যথা-বেদনা নেই। তাই একটু সাবধানে থাকি। নেতা-কর্মী, রাস্তাঘাটের সাধারণ মানুষ যে-ই দেখে সে-ই সাবধানে থাকতে অনুরোধ করে, দাবি করে, উপদেশ দেয়। সারা জীবনই সাধারণ মানুষকে শ্রদ্ধা করেছি, ভালোবেসেছি, সম্মান দেখিয়েছি। তারা যেমন আমার কথা শুনেছেন, আমিও কোনো মানুষের কোনো ইচ্ছা পায়ে দলতে চাইনি। তাই সবার কথা শুনেই চলার চেষ্টা করি। মৃণাল কয়েকবার বলছিল, দাদা আপনাকে ভাত খাওয়াব। আমারও তাতে কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের যে টেবিলে বসেছিলাম সেখানে খাবার দেওয়ার কথা বলছিল। মৃণালকে বলেছিলাম, দিয়ে দাও। সবাইকে খাবার দেওয়া হয়েছিল। প্রথমে মালপোয়া, তারপর ডাল সবজি। একটু পর লুচি। আমি একটা মালপোয়া, সামান্য সবজি ডাল এবং একটা লুচি খেয়েছিলাম। বেশ ভালো হয়েছিল। খাবার খেয়ে দোয়া করে এসেছি, আল্লাহ যেন মৃণালের মা শ্রীমতী গীতা রাণী দাসকে স্বর্গবাসী করেন। সন্তানের কাছে মা-বাবার স্বর্গলাভ কামনার চাইতে আর তেমন বড় কিছু নেই।

আমি ছেলেবেলায় গ্রামের স্কুলে পড়েছি। সেখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রাধান্য। টাঙ্গাইলের আকুরটাকুর পাড়ায় যেখানে বড় হয়েছি সেখানেও ছিল অনেক বেশি হিন্দুর বাস। তাই তাদের পূজাপার্বণ, নানা আচার অনুষ্ঠান সম্পর্কে আমার আগাগোড়াই জানা। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হলে তার প্রতিবাদে প্রায় ১৬ বছর ভারতে নির্বাসনে কাটিয়েছি। তাতে অনেক জ্ঞান অর্জন হয়েছে। তাই শ্রাদ্ধানুষ্ঠান বিষয়ে প্রায় ৫০-৫৫ বছরে অনেক কিছু দেখেছি শুনেছি জেনেছি। ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে মহামান্য রাষ্ট্রপতি শ্রী প্রণব মুখার্জির স্ত্রীর শ্রাদ্ধে শামিল হয়েছিলাম। তিনি এক পাশে তাঁর নাতনি আর এক পাশে আমাকে অনেকক্ষণ বসিয়ে রেখেছিলেন। রাষ্ট্রপতির পাশে বসে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান দেখেছিলাম। শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে যে আচার অনুষ্ঠান পালন করা হয় তা দেখেছিলাম ১৩ নম্বর তালকাটরা রোডে। আমার ডানে বসেছিলেন কংগ্রেসের এক সাধারণ সম্পাদক, বাঁয়ে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল এবং আরও অনেকে। সামান্য একটু দূরেই মহামান্য রাষ্ট্রপতি শ্রী প্রণব মুখার্জি।

মৃণালের মায়ের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে উৎফুল্ল চিত্তে মোহাম্মদপুরের দিকে রওনা হয়েছিলাম। ৩টায় খাবার খেয়ে সেদিনই টাঙ্গাইল ফিরেছিলাম। বারবার মনে হচ্ছিল মা-বাবা কী অমূল্য সম্পদ। অনেকেই মা-বাবা বেঁচে থাকতে বুঝতে পারে না, চলে গেলে বোঝে। আবার মা-বাবা থাকতেই অনেক সন্তান মা-বাবাকে বুকে আগলে রাখে।  জন্মিলে মরিতে হবে অমর কোথা কে কবে। তাই মৃত্যু শাশ্বত সত্য। মৃত্যুকে এড়াবার কারও পথ নেই।

লেখক : রাজনীতিক

www.ksjleague.com

সর্বশেষ খবর