সোমবার, ৩০ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

জামালপুরের বেগুনে স্বাস্থ্যঝুঁকি নেই

অধ্যাপক ড. মো. আবুল কাসেম

জামালপুরের বেগুনে স্বাস্থ্যঝুঁকি নেই

পৃথিবীর সব দেশের মাটিতে উদ্ভিদের প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় উপাদান রয়েছে। অপ্রয়োজনীয় উপাদানের মধ্যে ক্যাডমিয়াম, লেড ও আর্সেনিক ভারী ধাতুর অন্তর্ভুক্ত। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশের মাটিতে ভারী ধাতুর পরিমাণ খুবই কম। ভারী ধাতুর মূল উৎস হলো মাইনিং, যা আমাদের দেশে প্রায় নেই বললেই চলে। সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষক দল (বুশরা গং ২০২২) অধ্যাপক ড. জাকির হোসেনের নেতৃত্বে জামালপুর জেলার ইসলামপুর ও মেলান্দহ উপজেলা থেকে ৬০টি মৃত্তিকা ও ৮০টি বেগুনের নমুনায়, অন্যান্য পুষ্টি উৎপাদনের সঙ্গে ভারী ধাতুর (বিশেষ করে লেড ও ক্যাডমিয়াম) উপস্থিতি পেয়েছেন। যা নেচার পোর্টফোলিও ২০২২-এ প্রকাশিত হয়েছে এবং বাংলাদেশে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও পত্রপত্রিকায় এসেছে এবং বেগুন খাওয়া নিয়ে জনমনে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে।

তাদের গবেষণার ফলাফল : গবেষক দল মাটিতে গড়ে লেড এবং ক্যাডমিয়ামের পরিমাণ পেয়েছেন ১৬.৯ ও ০.৩২ পিপিএম এবং বেগুনে পেয়েছেন ০.৪৩১ ও ০.০১৮ পিপিএম (তাদের আর্টিক্যালের এস- টেবিল ২,৩,৪)। ১। জামালপুরের মাটিতে ভারী ধাতুর পরিমাণের তুলনা : বেগুন চাষ অঞ্চলের মাটিতে লেড এবং ক্যাডমিয়ামের মান বাংলাদেশ (গবেষক দল : চৌধুরী ২০২১; কর্মকার ২০১৯; ইসলাম ২০১৫;  কাসেম এবং শিং ১৯৯৯ ও মোসলে উদ্দিন ১৯৯৯) ইন্ডিয়া, চীন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, কানাডা, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, আয়ারল্যান্ড, স্পেন,  স্লোবিনিয়া ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন কর্তৃক নির্ধারিত বিপজ্জনক মাত্রার তুলনায় অনেকগুণ কম (ইসিডিজিই ২০১০)। তা ছাড়া সর্বাধিক অনুমোদিত সীমার সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায় জামালপুরের বেগুন চাষ অঞ্চলের মাটিতে লেড এবং ক্যাডমিয়ামের পরিমাণ ৬ ও ৯ গুণ কম (ক্লোক ১৯৮০; এফএও ২০০৭; ইইউ, ২০০২; আওঅস্থি, ইন্ডিয়া-২০০০)। ২। বেগুনে ভারী ধাতুর পরিমাণ ও দৈনিক মানবদেহে প্রবেশ মাত্রা : গবেষক দল (বুশরা গং ২০২২) মাঠ থেকে বেগুন সংগ্রহ করে ৫০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় শুকিয়ে নিয়ে বেগুনে ভারী ধাতুর পরিমাণ নির্ণয় করে ভিজে (ফ্রেশ কন্ডিশন) অবস্থায় সবজির রেফারেন্সের সঙ্গে তুলনা করেন (তাদের উল্লিখিত রেফারেন্স নম্বর ৬৪, পৃষ্ঠা ৭)। কনভার্সন ফেক্টর ১২.৫ ধরে ফ্রেশ ওয়েটে প্রকাশ করলে বেগুনে লেড এবং ক্যাডমিয়ামের মান দাঁড়াত ০.০৩ ও ০.০০১৪ পিপিএম যা নিরাপদ মাত্রার তুলনায় প্রায় ১০ এবং ৩৬ গুণ কম। উল্লেখ্য, ফ্রেশ বা তাজা অবস্থায় বেগুনে প্রায় ৯২.৭% পানি থাকে (বায়োলজি অব বৃনজল, গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া)। বিভিন্ন গবেষণায় মানুষের জন্য সবজির নিরাপদ মাত্রা লেডের জন্য হলো ০.৩ পিপিএম এবং ক্যাডমিয়ামের জন্য হলো ০.০৫ পিপিএম (সিএসি ২০০১; ইসি ২০০৬), চাইনিজ সরকার তাদের সবজিতে লেড এবং ক্যাডমিয়ামের মান সর্বোচ্চ মান ০.২ পিপিএম পর্যন্ত গ্রহণ করেন (পেন গং ২০১৬)। তাদের তুলনায় আমাদের বেগুনে লেড ও ক্যাডমিয়ামের মান যথাক্রমে ৬ এবং ১৪৩ গুণ কম। অন্যদিকে দৈনিক মানবদেহে ভারী ধাতুর প্রবেশের মাত্রা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে লেড (০.০৩) ও ক্যাডমিয়ামের (০.০০১৪) ফ্রেশ মান দিয়ে ৭.২৮ গ্রাম ফ্রেশ সবজির ওজন দ্বারা গুণ  করা দরকার ছিল। তাতে বেগুনের মাধ্যমে মানবদেহে ভারী ধাতুর প্রবেশের পরিমাণ বহুগুণ কমে আসত। ড. জাকির হোসেন ও তার গবেষক দলের মতো এ ধরনের গবেষণা আরও অনেকে করেছেন, তাদের মধ্যে বাংলাদেশের (শাহীন গং ২০১৬ ), চীনের (পেন ২০১৬; হাং ২০১৪) ইংল্যান্ডের (নরটন গং ২০১৫)  আমেরিকার (এমসিব্রাইড গং ২০১৪) উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, যারা তাদের ফলাফল ফ্রেস ওয়েটের ভিত্তিতে নির্ণয় করে আন্তর্জাতিক নিরাপদ মাত্রার সঙ্গে তুলনা করেছেন। সুতরাং উপরোক্ত আলোচনা থেকে দেখা যায় যে জামালপুরের মাটিতে সর্বোচ্চ নিরাপদ মাত্রার তুলনায় লেড ৬ এবং ক্যাডমিয়াম ৯ গুণ কম। অন্যদিকে বেগুনেও নিরাপদ মাত্রার তুলনায় লেড ১০ এবং ক্যাডমিয়াম ৩৬ গুণ কম। তা ছাড়া সবজিতে চাইনিজ সরকারের গ্রহণযোগ্য মাত্রার তুলনায় প্রায় লেড ১০ এবং ক্যাডমিয়াম ১৪৩ গুণ কম। আমরা জানি, চীন সারা পৃথিবীতে তাদের শাকসবজি রপ্তানি করে আসছে। কাজেই সারা পৃথিবীর মানুষ যদি আমাদের চেয়ে অনেকগুণ বেশি ভারী ধাতুর উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও চাইনিজ সবজি নির্ভয়ে খেতে পারে তবে বাংলাদেশের মানুষ কেন বেগুন খেতে পারবে না? কাজেই জামালপুরের বেগুন খাওয়াতে ভারী ধাতু দ্বারা মানবদেহে কোনো সমস্যা তৈরির সম্ভাবনা আছে বলে প্রতীয়মান হয় না। ভারী ধাতু নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে নিচের পরামর্শগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে। ১। যেসব গাছের বা সবজির নমুনা নেওয়া হবে ঠিক সেই সবজির বা গাছের শিখর অঞ্চলের মৃত্তিকার নমুনা (১:১ অনুপাতে) সংগ্রহ করা। ২। অন্য কোনো কোনো উৎস থেকে ভারী ধাতু ফসলের জমিতে জমা হলো কি না জানার জন্য ওই একই  সিরিজের মাটি অন্য জায়গা থেকে (কন্ট্রোল নমুনা) সংগ্রহ করে তুলনা করা।  ৩। অন্যদিকে যখনই কোনো নমুনায় মাত্রাতিরিক্ত ভারী ধাতু পাওয়া যায় সেই ক্ষেত্রে সঠিক ফলাফল নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এ নমুনাসমূহ অন্যান্য যে কোনো দু-তিনটি গবেষণাগারে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা।  ৪। নমুনায় ভারী ধাতুর পরিমাণ অনুযায়ী অ্যাটোমিক এবজ্বরফশন এস্পেকটুফটো মিটারে স্ট্যান্ডার্ড সলিউশন ব্যবহার করা।

লেখক : মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর