রবিবার, ২৬ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

মুক্তিযুদ্ধ ‘ভারত-পাকিস্তান’ কিংবা ‘তেরো দিনের যুদ্ধ’ ছিল না

জাফর ইমাম বীরবিক্রম

মুক্তিযুদ্ধ ‘ভারত-পাকিস্তান’ কিংবা ‘তেরো দিনের যুদ্ধ’ ছিল না

প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা দুর্গা প্রসাদ ধর (ডি পি ধর নামে সর্বাধিক পরিচিত) তাঁর লেখা Indira Gandhi, The Emergency & Indian Democracy বইতে বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের রণকৌশল সম্পর্কে লিখেছেন, ‘প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার প্রাক্তন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের নিউক্লিয়াসকে ঘিরে একটি নিয়মিত বাহিনী (এখন যা বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা বাহিনী) গঠন করে। মুক্তিবাহিনীর রণকৌশল জগৎকে অবাক করে দেখিয়ে দেয় কীভাবে একটি অন্তর্ঘাতমূলক (ইনসারজেন্সি) যুদ্ধ করতে হয়।’ (পৃষ্ঠা ১৬৫)

একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি বলব, এখন সময় এসেছে বিলম্বে হলেও মুক্তিযুদ্ধে আমাদের মুক্তিবাহিনীর অবদানের সঠিক ইতিহাস ধারণ এবং সংরক্ষণ করা এবং এর পাশাপাশি আমাদের স্বাধীনতার জন্য ভারতীয় বাহিনীর যেসব সাহসী সৈনিক ও কর্মকর্তা আত্মাহুতি দানের মাধ্যমে আমাদের বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছেন, তাদের যথাযোগ্য সম্মান এবং অবদানের স্বীকৃতি প্রদান করা, যা আমরা সব সময় করে থাকি। তবে বাংলাদেশ ও ভারত উভয় ক্ষেত্রেই মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন তথ্যাবলি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা এবং যারা এখনো জীবিত আছেন, তাদের কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ধারণ করে রাখা অত্যন্ত প্রয়োজন। এরপর হয়তো প্রত্যক্ষ সাক্ষী আর কেউই বেঁচে থাকবেন না। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক যে, মুক্তিযুদ্ধের বহু তথ্য, যুদ্ধনির্দেশ, নিয়োগ ও পদায়ন ফোর্ট উইলিয়ামে পুরনো কাগজের সঙ্গে পুড়িয়ে ফেলা হয়। আমাদের এখানেও মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-প্রমাণ্যাদি যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি। অনেক শীর্ষ ভারতীয় সেনা অধিনায়ক ১৯৭১-এর এসব ঐতিহাসিক তথ্য-প্রমাণ ‘উদ্দেশ্যমূলকভাবে’ ধ্বংস করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন।

এ প্রসঙ্গে দি টাইমস অব ইন্ডিয়া পত্রিকায় ‘সত্য হারিয়ে গেছে : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বেশির ভাগ রেকর্ড ধ্বংস হয়ে গেছে’ শিরোনামে রিপোর্টার জোসি জোসেফ লেখেন : ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কখনোই পূর্ণাঙ্গভাবে লেখা যাবে না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত বেশিরভাগ অফিশিয়াল রেকর্ড ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। সেসব ধ্বংসপ্রাপ্ত ফাইলের মধ্যে ছিল বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী গঠনের প্রামাণ্য তথ্যাদি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সেনাবাহিনীর সব দরখাস্ত এবং মূল্যায়ন, যুদ্ধ নির্দেশনাবলি এবং অন্যান্য স্পর্শকাতর অপারেশনবিষয়ক তথ্য... কলকাতায় পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সদর দফতরে সংরক্ষিত এসব রেকর্ড ১৯৭১-এর যুদ্ধের পরপরই ধ্বংস করে ফেলা হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর অন্তত দুজন প্রাক্তন পূর্বাঞ্চলীয় অধিনায়কের বক্তব্য অনুযায়ী সম্ভবত এসব তথ্য ও ডকুমেন্ট সুপরিকল্পিতভাবেই ধ্বংস করে ফেলা হয়।’ (টাইমস অব ইন্ডিয়া, টিএনএন, ৯ মে ২০১০)

The Need for Declassification of Histories & other Documents শীর্ষক অন্য এক প্রতিবেদনে ভারতীয় সেনাবাহিনীর লে. জেনারেল সতীশ নামবিয়ার (অব.) ‘মধ্য প্রদেশ ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস’-এর জার্নালে লেখেন : ‘ইচ্ছাকৃতভাবে ১৯৭১-এর যুদ্ধ সম্পর্কিত ডকুমেন্টগুলো ধ্বংস করা প্রসঙ্গে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে প্রমাণিত হয় যে, সেনাবাহিনীর সচেতনতার ঘাটতি রয়েছে। এসব তথ্য সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কলকাতাস্থ সদর দফতরে রাখা ছিল। বিষয়টি এখনো পরিষ্কার না হলেও ভারতীয় সেনাবাহিনীর কেউ যদি আমাকে সঠিক তথ্য দিয়ে সাহায্য করেন তাহলে অনুধাবন করা যাবে যে, এটি সেনাবাহিনীর অযোগ্যতা এবং সামরিক তথ্য সম্পর্কে সচেতনতার অভাব অথবা অজ্ঞতাজনিত। আমরা যারা ভারতীয় বাহিনীতে ছিলাম তারা এটা জানি যে, প্রতি পাঁচ বছর পরপর ইউনিটে অফিসারদের বোর্ডসভায় পুরনো ফাইল এবং প্রামাণ্য তথ্যাদি পর্যালোচনা করা হয় এবং যেগুলোর আর প্রাসঙ্গিকতা নেই, সেগুলো ধ্বংস করে ফেলা হয়। ওই অফিসারের বেশির ভাগই এসব ডকুমেন্টের ঐতিহাসিক গুরুত্ব সম্পর্কে সজাগ নন কিংবা ওই ফাইলগুলো “ডিক্লাসিফিকেশন”-এর পর জাতীয় আর্কাইভে সংরক্ষণ না করে পুড়িয়ে ধ্বংস করে ফেলেন। ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর ত্যাগ এবং অবদান এভাবেই “আনরেকর্ডেড” থেকে গেছে- অর্থাৎ সেনাবাহিনী আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এগুলো ধ্বংস করে ফেলেছে।’

দখলিকৃত এলাকা মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকত : ‘বাংলাদেশের পক্ষে প্রবাসে প্রচারণা চালিয়ে মধ্য-নভেম্বরে (১৯৭১) দেশে ফিরে এসে প্রধানমন্ত্রী (ইন্দিরা গান্ধী) তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকায় আবার অভিযান চালানোর নির্দেশ দেন। অক্টোবরের শুরু থেকে ভারতীয় বাহিনী মুক্তিবাহিনী পরিচালিত সীমান্ত চৌকিগুলোর ওপর আক্রমণে সহায়তা দিচ্ছিল। প্রথম প্রথম এ সহায়তা সীমিত ছিল পাকিস্তানিদের অবস্থানের ওপর কামান হামলা এবং স্বল্পসংখ্যক ভারতীয় বাহিনী সদস্যদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে। অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহ নাগাদ ভারতীয় বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড তাদের সীমান্তগুলোকে শুধু সুরক্ষা করাই নয়, সীমান্তের ১০ মাইল ভিতর পর্যন্ত হামলা চালাতে নির্দেশ দেয়। এ ধারণার মূলে ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানগুলো দখলে নেওয়া যাতে পরবর্তী পর্যায়ে (৩ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর শত্রুর আত্মসমর্পণ পর্যন্ত) পূর্ণাঙ্গ সামরিক অভিযানের পথ সুগম করা যায়। যদিও দখলিকৃত এলাকাগুলো মুক্তিবাহিনীই নিয়ন্ত্রণে রাখত, কেননা অভিযানের পর ভারতীয় বাহিনী সীমান্তের ভিতর দিকে পশ্চাৎপসরণ করত।’

শ্রীনাথ রাঘবন, প্রখ্যাত ভারতীয় ইতিহাসবিদ এবং ফেলো, কার্নেগি এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর বেশ কয়েকটি গ্রন্থের রচয়িতা, যার অন্যতম হলো ‘এ গ্লোবাল হিস্ট্রি অব দ্য ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ’। তাহলে দেখা যাচ্ছে নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশের পর ভারতীয় সেনাবাহিনী সীমিত আকারে অনেক যৌথ অপারেশনে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে অংশগ্রহণ করে এবং মুক্ত এলাকা মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রেখে তারা অপারেশন শেষে সীমান্ত এলাকার ভিতরে নিজ অবস্থানে ফিরে যেতেন। ’৭১-এর নয় মাসব্যাপী এ যুদ্ধ ছিল আমাদের শ্রেষ্ঠতম জাতীয় ঐতিহ্য, ঐতিহাসিক অর্জন এবং স্বাধীন জাতিসত্তা বিকাশের প্রধান অনুপ্রেরণা। কাজেই এ যুদ্ধ কখনোই ‘পাক-ভারত যুদ্ধ’ বা ‘তেরো দিনের যুদ্ধ’ ছিল না। কারণ,

ক) আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয় ২৫ মার্চ মধ্যরাত থেকে, যেদিন বর্বর পাকিস্তানি হানাদাররা নিরস্ত্র জনগণের ওপর গণহত্যা শুরু করে, সেই মুহূর্ত থেকে ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জন পর্যন্ত এ দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী যুদ্ধ কখনোই ‘পাক-ভারত যুদ্ধ’ ছিল না এবং ‘তেরো দিনের যুদ্ধও’ ছিল না। ২৫ মার্চ থেকে ৩ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কর্তৃক যুদ্ধ ঘোষণার আগেই ভারত সরকার, জনগণ ও সেনাবাহিনীর সহায়তায় ইতোমধ্যে সাড়ে আট মাসের মধ্যে আমরা মুক্তিযুদ্ধ সমাপ্ত করি এবং এ পর্যায়ে অর্থাৎ নভেম্বরের শেষ নাগাদ পাকিস্তানি বাহিনীকে বিপর্যস্ত করে ফেলি। তখন তারা ছিল আত্মসমর্পণের অপেক্ষায়।

খ) ইন্দিরা গান্ধী কর্তৃক ৩ ডিসেম্বর যুদ্ধ ঘোষণার পর মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় বাহিনী সমন্বয়ে ‘মিত্রবাহিনী’ গঠিত হয়। ইতোমধ্যে পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণের অপেক্ষায় ছিল। ঠিক এ সময়ই ৩ ডিসেম্বর ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। তাই আমার মতে ইন্দিরা গান্ধীর ৩ ডিসেম্বর যুদ্ধ ঘোষণা Could not have come at a better time. এজন্য আমি ৩ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর এ পর্বকে আত্মসমর্পণ প্রস্তুতি পর্ব বলেছি।

এ প্রসঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল (অব.) মিঠ্ঠা খান তার যুদ্ধ স্মৃতিগ্রন্থ Unlucky Beginning-এ লিখেছেন, Once it was clear that the majority of the East Pakistanis no longer wanted to be a part of Pakistan, there was no sense in continuing to fight except to be able to surrender on honorable terms. (Page 365)

তাহলে দেখা যাচ্ছে ৩ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ’৭১ পর্যন্ত এই তেরো দিনকে ‘পাক-ভারত যুদ্ধ’ হিসেবে অনেক মহল তাদের লেখায়, বক্তব্যে ও বিকৃত প্রামাণ্যচিত্রে উল্লেখ ও ধারণা প্রদান করে। এটি একেবারে সঠিক নয়। এটি আমাদের নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধকে শুধু অবমূল্যায়নই করে না, আমাদের সঙ্গে ভারত সরকার, ভারতীয় জনগণ, সেনাবাহিনী, বিএসএফ যে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছে, যাতে ১৬ ডিসেম্বরের চূড়ান্ত বিজয় ত্বরান্বিত হয় তাকেও বিকৃত এবং উপেক্ষা করে এমন ধারণা দেওয়া হচ্ছে যেন, এই তেরো দিনই ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। অথচ সত্য এই যে, ২৫ মার্চ ’৭১ থেকে ৩ ডিসেম্বর ’৭১ ইন্দিরা গান্ধী কর্তৃক পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা পর্যন্ত ভারতীয় বাহিনী কোনো ফ্রন্টেই সর্বাত্মকভাবে পুরোপুরি দৃশ্যমান (বা all out exposed) হতে পারেনি। কারণ, পাকিস্তান বিশ্ব ফোরামে অভিযোগ করছিল যে, মুক্তিবাহিনী নয় ভারতই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে।

ফলে ভারত সরাসরি দৃশ্যমানভাবে যুদ্ধে জড়িত হতে পারেনি। জেনারেল মানেকশকে ৩ ডিসেম্বরের আগ পর্যন্ত যুদ্ধে ভারতকে সংশ্লিষ্ট হওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছিল এবং বারবারই তিনি সময় চেয়ে আসছিলেন। তবু আমি বলব ভারত সরকার, জনগণ, বিশেষ করে ভারতীয় সেনাবাহিনী আমাদের সামরিক প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন পর্যায়ে সর্বাত্মক সহযোগিতা এবং আমাদের যুদ্ধরত মুক্তিবাহিনী ও বেঙ্গল রেজিমেন্টকে আর্টিলারি সমর্থন দিয়ে আসছিল। ৩ ডিসেম্বর যুদ্ধ ঘোষণার আগে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর-নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধের এ চূড়ান্ত পর্যায়ে দেশব্যাপী গ্রাম পর্যায়ে আমাদের গেরিলাযুদ্ধের এবং সেক্টর ফোর্সের মরণপণ হামলার তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। এ তিন মাসে বিভিন্ন রণাঙ্গনে ব্যাপক সম্মুখযুদ্ধ ছাড়াও ভারতীয় বাহিনী অনানুষ্ঠানিকভাবে আমাদের সঙ্গে বিভিন্ন যৌথ অপারেশনের মাধ্যমে পাক বাহিনীকে এতটাই বিপর্যস্ত করে তোলে যে, ৩ ডিসেম্বরের পর থেকে তারা মূলত আত্মসমর্পণের পথ খুঁজতে থাকে। যার জন্য জেনারেল মানেকশ এ মন্তব্য করেন যে, তারা একটি ‘পরাজিত সেনাদলকে পরাভূত করতে চলেছেন।’

জেনারেল স্যাম মানেকশর মতে, নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ওপর মুক্তিবাহিনীর ক্রমাগত হামলার মুখে তারা এতই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে যে, মিত্রবাহিনী ইতোমধ্যে একটি পরাভূত শত্রু বাহিনীকে চূড়ান্তভাবে বিধ্বস্ত করতে উদ্যত হয়। অনেকের ধারণা, ৩ থেকে ১৬ ডিসেম্বর এ তেরো দিনের ফসল হচ্ছে ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়। অথচ এই তেরো দিন ছিল মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত ‘মিত্রবাহিনী’ কর্তৃক পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ গ্রহণের প্রস্তুতি পর্ব। এ পর্বে মিত্রবাহিনীকে কিছু কিছু আঞ্চলিক প্রতিরোধের মোকাবিলা ছাড়া বড় কোনো যুদ্ধ করতে হয়নি। কেননা আমাদের নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে ৩ ডিসেম্বর ইন্দিরা গান্ধীর যুদ্ধ ঘোষণার আগেই যুদ্ধ কার্যত শেষ হয়ে যায়। অনেকে মনে করেন তেরো দিনের যুদ্ধেই বিজয় অর্জিত হয়। প্রকৃতপক্ষে ১৬ ডিসেম্বরের চূড়ান্ত বিজয় ছিল ২৫ মার্চ মধ্যরাত থেকে শুরু হওয়া টানা নয় মাস যুদ্ধের সফল অর্জন, যার শেষের তেরো দিন ছিল আত্মসমর্পণ অপারেশনাল পর্ব (ফেজ) এবং আমাদের নয় মাসের টানা যুদ্ধের অংশ হলো এই তেরো দিন। এই তেরো দিনের আত্মসমর্পণের পর্ব নয় মাসের যুদ্ধের মধ্যে শামিল যা টানা নয় মাসের যুদ্ধ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার কোনোই অবকাশ নেই।

পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণ : নয় মাসের টানা মুক্তিযুদ্ধ কখনোই ‘পাক-ভারত যুদ্ধ’ কিংবা ‘তেরো দিনের যুদ্ধ’ ছিল না। ৩ ডিসেম্বর যুদ্ধ ঘোষণার আগেই নভেম্বরের শেষ নাগাদ পাক বাহিনী যখন তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী একটি সম্মানজনক আত্মসমর্পণের জন্য প্রস্তুত, যা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল (অব.) মিঠ্ঠা খান তার যুদ্ধ স্মৃতিগ্রন্থ Unlucky Beginning-এ লিখেছেন, ‘যখন এটা পরিষ্কার বোঝা গেল যে, পূর্ব পাকিস্তানিরা পাকিস্তানের অংশ হিসেবে আর থাকতে চান না, তাহলে এ যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার কোনো মানেই হয় না। এখন আমরা শুধু চাই একটা সম্মানজনক শর্তে আত্মসমর্পণ করতে।’ (পৃষ্ঠা ৩৬৫)

আমরা ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড (অর্থাৎ মিত্রবাহিনী) পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণ পর্ব শর্ত সাপেক্ষে এবং সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করা সম্ভব বলে ঐকমত্য পোষণ করি। পাক বাহিনী চাচ্ছিল তারা মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলার জনগণের ক্ষোভ ও গণরোষের শিকার না হয়ে তৃতীয় পক্ষে মধ্যস্থতায় জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। এ পর্যায়ে রমনা রেস কোর্সে পাক বাহিনীর আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণের আগেই জেনারেল জ্যাকব জেনারেল নিয়াজির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং আত্মসমর্পণের দলিল পড়ে শোনান। এ সাক্ষাতে জেনারেল নিয়াজি সেনা সদরে জেনারেল জ্যাকবকে প্রীতিভোজেও আপ্যায়ন করেন; যা জেনারেল জ্যাকব তাঁর স্মৃতি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিগ্রন্থ The Birth of a Nation বইতে উল্লেখ করেছেন। এ ধারাবাহিকতায় জেনারেল জ্যাকবের সঙ্গে জেনারেল নিয়াজির সর্বশেষ দলিলের শর্তের সঙ্গে একমত পোষণের প্রেক্ষিতে রেসকোর্স ময়দানে ১৬ ডিসেম্বর অপরাহ্ণে আনুষ্ঠানিকভাবে পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণ দলিল স্বাক্ষর করেন, যে অনুষ্ঠানে আমাদের পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধের সহ-সর্বাধিনায়ক এ কে খন্দকার বীরউত্তম ও ঢাকার গেরিলাযুদ্ধ পরিকল্পনাকারী, প্রশিক্ষক ও পরিচালক কমান্ডো অফিসার মেজর হায়দার বীরউত্তমও উপস্থিত ছিলেন। আমরা মিত্রবাহনীর অংশ হিসেবে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী যৌথভাবে এ আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান যেন সফল হয়, সেজন্য যে কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুত ছিলাম। এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে যে, সেদিন পুরো বাংলাদেশ এমনকি রাজধানীর ভিতরে ও উপকণ্ঠে আমাদের বিশাল মুক্তিবাহিনী অবস্থান নিয়েছিল, যা জেনারেল জ্যাকব উল্লেখ করে লিখেছেন যে, পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের জন্য তিনি যখন ১৫ ডিসেম্বর নিয়াজির সঙ্গে আত্মসমর্পণের শর্ত নিয়ে আলোচনার জন্য ঢাকার উপকণ্ঠে পৌঁছান তখন দেখতে পান মুক্তিবাহিনী এর আগেই সারা দেশের থানা, মহকুমা, জেলাসহ ঢাকা এবং এর আশপাশ এলাকায় শক্ত অবস্থানে রয়েছে। তারা জেনারেল জ্যাকবকে চিনতে না পেরে তাকে লক্ষ্য করে গুলি করতে শুরু করে। তখন তিনি ‘মিত্রবাহিনী’ বলে চিৎকার করে ওঠায় তারা তাকে সাদর অভিনন্দন জানায়। জেনারেল জ্যাকবের আগমনে আত্মসমর্পণের ‘নেগোসিয়েশন’ পর্বটি ত্বরান্বিত হয়। এখানে অনেকে উল্লেখ করেন, আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানী কেন উপস্থিত ছিলেন না?

বিতর্কের ঊর্ধ্বে আমি এ ঐতিহাসিক সত্যটি উল্লেখ করে বলতে চাই, পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণ ছিল আমাদের ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে ৩ ডিসেম্বর যুদ্ধ ঘোষণার পর গঠিত ‘মিত্রবাহিনীর’ কাছে; এককভাবে ভারতীয় বাহিনীর কাছে নয়। যদি আত্মসমর্পণ এককভাবে ভারতীয় বাহিনীর কাছে হতো তাহলে ভারতের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল স্যাম মানেকশ উপস্থিত থাকতেন এবং প্রটোকল অনুযায়ী আমাদের সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানীও উপস্থিত থাকতেন। আমাদের পক্ষে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে উপসর্বাধিনায়ক এ কে খন্দকারের উপস্থিতি প্রটোকল অনুযায়ী সঠিক ছিল। জেনারেল অরোরার মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত ‘মিত্রবাহিনী’ সর্বাধিনায়ক হিসেবে উভয় পক্ষের তরফে এ অনুষ্ঠানে প্রতিনিধিত্ব করা সঠিক ছিল। এ নিয়ে কোনো বিতর্কের অবকাশ থাকা উচিত নয়।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ৩ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী গঠিত হওয়ার আগে ১০ নভেম্বর বিলোনীয়া যুদ্ধে পাক বাহিনীর দুজন অফিসারসহ ৭২ জন সৈনিক দশম বেঙ্গল রেজিমেন্টের কাছে আত্মসমর্পণ করে। যা ছিল মুক্তিবাহিনীর কাছে পাক বাহিনীর এত বড় সংখ্যায় প্রথম আত্মসমর্পণ। সেখানেও আমরা সেই যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গে জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী আচরণ করি। এ ছাড়া ৩ ডিসেম্বর ‘মিত্রবাহিনী’ গঠনের আগে বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে আত্মসমর্পণকারী পাক বাহিনীর সৈনিকদের সঙ্গেও অনুরূপভাবে জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী আচরণ করা হয়। উল্লেখ্য, ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণকারী পাক বাহিনীর সঙ্গে মিত্রবাহিনী অর্থাৎ ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত মিত্রবাহিনী এদের সঙ্গে একইভাবে জেনেভা কনভেনশনের শর্ত ও বিধি অনুযায়ী যথাযথ আচরণ করে, এ ব্যাপারে আমাদের দেশব্যাপী গেরিলা যোদ্ধা ও জনগণের সহযোগিতা ও সমর্থন ছিল।

আমার মতে ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে আমাদের যে অসীম সাহসী যৌথ অভিযানগুলো পরিচালিত হয়েছিল এবং আমাদের সঙ্গে ভারতের যে সৈনিক ও অফিসাররা যারা আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য তাদের রক্তে আমাদের মাটি রঞ্জিত করেছিল, উভয় দেশেই তাদের প্রতি সঠিক সম্মান দেখাতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। যদিও বাংলাদেশ এই বীরদের যথাযোগ্য শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে এবং বাংলাদেশ সরকার ইন্দিরা গান্ধীকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘স্বাধীনতা পদকে’ ভূষিত করার পাশাপাশি ভারতীয় বীর যোদ্ধাদের যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করেছে।

সর্বশেষে, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বলব, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সৈনিক ও কর্মকর্তারা যে আত্মত্যাগ করেছেন, ভারতের সরকার এবং জনগণ আমাদের এক কোটি শরণার্থীকে মানবিকতার ডাকে সাড়া দিয়ে খাদ্য ও আশ্রয় প্রদান করেন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশে গণহত্যার প্রতিবাদে ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে বিশ্ব জনমত গঠনের লক্ষ্যে সেদিন ২৮টি দেশ সফর করেন। আমাদের কাছে এমনটাই মনে হতো যে, বঙ্গবন্ধুর নামের ওপর যে মুক্তিযুদ্ধ প্রতিদিন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিল, বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আমাদের স্বাধীনতার প্রতি অঙ্গীকারে তথা বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে স্বাধীনতা অর্জনের প্রশ্নে এক আপসহীন ভূমিকা পালন করে যাচ্ছিলেন। বাংলাদেশের জনগণ তার এ ঐতিহাসিক ভূমিকার কথা চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। তাদের সেই আত্মত্যাগ এবং অবদানের ইতিহাস সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি। আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু প্রশ্নœ হলো, তারা তাদের যথাযোগ্য সম্মান ও স্বীকৃতি কি পেয়েছেন? তাই আবারও বলব, বাংলাদেশে এবং ভারতে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যারা এখনো বেঁচে আছেন তাদের কাছ থেকে সমগ্র তথ্য আরও হালনাগাদ করে প্রত্যেকের ব্যক্তিগত অবদানের আলোকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসকে ঢেলে সাজানো অনিবার্যতই অত্যাবশ্যক এবং এটাই জাতির কাছে ইতিহাসের দাবি। আমাদের ’৭১-এর ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই টানা নয় মাসের স্বাধীনতাযুদ্ধে সর্বাত্মক সহযোগিতা ও সমর্থনের জন্য আরও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করব বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জনগণের সমর্থন ও সহযোগিতার কথা। বিশেষভাবে ভারতের পাশাপাশি যুদ্ধকালীন রাশিয়ার সহযোগিতা ও সমর্থনকে আমরা খাটো করে দেখি না। সেদিন যখন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের এ স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক ভূমিকা পালনের জন্য সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিল, তার পাশাপাশি রাশিয়া আমেরিকার সপ্তম নৌবহরের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে তাদের বিশাল নৌবহর পাঠিয়েছিল। সেদিনের রাশিয়ার এ ভূমিকা ছিল আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের পক্ষে এবং যুক্তরাষ্ট্রের এ আচরণের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি ও অবস্থান। আজও আমরা তাদের এ ভূমিকা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি।

পরিশেষে, এ পর্যায়ে আবার আমাদের নয় মাসের টানা মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিশাল মুক্তিবাহিনীর রণকৌশল ও রণনৈপুণ্য এবং সাহসী ভূমিকা সম্পর্কে ভারতীয় জেনারেল  জে এফ আর জ্যাকবের উদ্ধৃতি পুনরায় উল্লেখ করতে চাই। জেনারেল জ্যাকব যুদ্ধকালীন ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সিজিএস হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। জেনারেল জ্যাকব বলেন : ‘আমি সব সময় বলেছি, এটি ছিল আপনাদের (বাঙালিদের) মুক্তিযুদ্ধ। এটি ছিল আপনাদের স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং এতদ্ভিন্ন আর কিছুই নয়। আমি বলতে চাই, মুক্তিযোদ্ধা এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক ও অফিসাররা তাদের সীমাবদ্ধ সম্পদ-সরঞ্জাম নিয়েও একটি শক্তিশালী নিয়মিত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন করেছেন এবং তাদের দেশপ্রেম এ যুদ্ধে তাদের জয়ী করেছে। আমরা তাদের সহায়তা দিয়েছি, আমরা ছিলাম তাদের সহযোদ্ধা। কিন্তু এ যুদ্ধ ছিল তাদের যুদ্ধ, তারা এ যুদ্ধে লড়েছেন। তারা দেশপ্রেমের সঙ্গে লড়েছেন এবং জয়ী হয়েছেন। তাদের প্রতি আমার আন্তরিক অভিনন্দন ও আশীর্বাদ রইল। এ সাহসী মুক্তিযোদ্ধারা আপনাদের এমন এক শক্তি, যাদের নিয়ে গোটা দেশ গর্ব করতে পারে।’

সর্বশেষে গীতিকার ও সুরকার আবদুল লতিফের দেশাত্মবোধক গানের কিছু অংশ নিচে তুলে ধরলাম :

‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা/কারোর দানে পাওয়া নয়।/দাম দিছি প্রাণ লক্ষ-কোটি/

জানা আছে জগৎময়॥/সতেরো’শ সাতান্ন সনে/ভাইবা দেখেন পড়বে মনে।

দাম দিছি পলাশীর মাঠে/ইতিহাস তার সাক্ষী রয়॥’

এ ধারাবাহিকতায় আমাদের নয় মাসের স্বাধীনতাযুদ্ধ আমাদের গর্ব, শ্রেষ্ঠ জাতীয় ঐতিহ্য এবং আমাদের অহংকার।

লেখক : মুক্তিযুদ্ধকালীন সাব-সেক্টর কমান্ডার ও প্রতিষ্ঠাতা অধিনায়ক, দশম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট

সর্বশেষ খবর