রবিবার, ২ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

নারীদের ছোট করে দেখা ঠিক নয়

আফরোজা পারভীন

নারীদের ছোট করে দেখা ঠিক নয়

দুজন নারী কর্মকর্তাকে নিয়ে তোলপাড় সারা দেশ। আর এই দুই ইস্যুতে চাপা পড়ে গেল আরাভ খান ইস্যু। এটাই বরাবর হয়ে আসছে। তুলনামূলকভাবে ছোট ছোট ইস্যুর নিচে চাপা পড়ে বড় বড় ইস্যু। কথা হতে পারে আমি বড় বড় দুটো ব্যাপারকে ছোট করে দেখছি। একদম তা না। আমাদের আগে দেখতে হবে দেশের স্বার্থ। দেখতে হবে দেশের জন্য কোনটা বেশি ক্ষতিকর।  এটাও কথা হতে পারে, আমি নারী বলে নারীর পক্ষে কলম ধরেছি বা সরকারি চাকরি করতাম বলে তাদের পক্ষে লিখছি। আমি কারও পক্ষে বিপক্ষে লিখছি না। এই পত্রিকাতেই অনেক কলাম লিখেছি নারী কর্মকর্তাদের  অনৈতিক অশোভন আচরণের প্রতিবাদে। কিন্তু আজকের বিষয়টা ভিন্ন।

রংপুরের ডিসি তাকে আপা ডাকায় অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলেছেন, ‘তার চেয়ারের একটা সম্মান আছে। তাকে স্যার ডাকা উচিত’। যাকে বলেছেন তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক তাকে সরাসরি জানিয়ে দিয়েছেন, ‘তিনি রাষ্ট্রের ভৃত্য। কাজেই তাকে স্যার ডাকার প্রয়োজন নেই’। তারপর কিন্তু ডিসি তাকে স্যার ডাকতে বাধ্য করেননি বা অন্য কোনো তপ্ত কথা বলেননি। অন্তত আমরা সামাজিক মাধ্যম বা পত্রিকায় পাইনি। এরপর শিক্ষক মহোদয় তার মেয়েকে নিয়ে প্লাকার্ড হাতে বসে গেলেন অবস্থান ধর্মঘটে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টা ছড়িয়ে দিলেন। রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা ছুটে এলেন। তোলপাড় অবস্থার সৃষ্টি হলো। একপর্যায়ে ডিসি নেমে এসে দুঃখ প্রকাশ করলেন। এমনকি অবস্থানরতদের সঙ্গে ছবিও তুললেন। এরপর কি এ বিষয়টা চলমান থাকা উচিত? দিনের পর দিন ডিসির গায়ে কাদা ছোঁড়া উচিত? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার ছবি পোস্ট করে অশ্লীল মন্তব্য করা উচিত? সেটাই চলছে। স্যার সম্বোধনের বিপক্ষে ভূরি ভূরি লেখা প্রকাশিত হচ্ছে প্রতিদিন। ফেসবুকে এমনও মন্তব্য হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্ররা শিক্ষকতা করে আর আগাগোড়া থার্ড ক্লাস পাওয়া ছাত্ররা সচিব হয়। বাস্তবতা কী তাই? যারা এসব লিখছেন তাদের বলি, ‘আঙ্গুর ফল টক’ বাক্যটার সৃষ্টি এমনি এমনি হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিঃসন্দেহে মেধাবী। কিন্তু সচিবদেরও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে আসতে হয়। আর সে পরীক্ষাটা অত সহজও নয়। তাছাড়া পেশা পছন্দের একটা ব্যাপার আছে। সবাই শিক্ষক হতে বা সবাই আমলা হতে পছন্দ করবেন এমনটাও নয়।

‘স্যার’ সম্বোধন তুলে দেওয়াতে আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু ডিসি একজন আমলা বলেই আমলাদের প্রতি বিদ্বেষপ্রসূত এই সম্বোধন তুলে দিলে আপত্তি আছে। ডিসি যেমন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, সব চাকরিজীবীই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে সবাই বেতন নেন। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় তাদের অন্নসংস্থান হয়। তাই শুধু ডিসিকে ভৃত্য কেন বলা হবে, ভৃত্য তো সবাই, সেবক তো সবাই। আর হ্যাঁ, তাহলে তো ইওর অনার, হিজ বা হার এক্সিলেন্সি শব্দগুলোও তুলে দিতে হবে। সবাই তো সমান।

যখনই কোনো নারী কর্মকর্তাকে নিয়ে কোনো ঘটনা ঘটে তখন তার দেহকে টেনে আনে পুরুষ জাতি। পুরুষ কর্মকর্তার ব্যাপারে যদি বাজি ফোটে নারীর বেলায় বোমা ফাটে। কেন, নারীর প্রতি এত বিদ্বেষ কেন! যে শিক্ষক মহোদয় এ ঘটনাটি ঘটিয়েছেন তিনি তো ছাত্রদের পড়ান। তাকে যদি ছাত্ররা স্যার না বলে নাম ধরে ডাকতে থাকে তার কেমন লাগবে জানতে ইচ্ছে করছে। আমেরিকায় শিক্ষকরা সাইকেল চালিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন। আমার মেয়ের প্রফেসর ঘাসের ওপর বসে মেয়ের সাইকেলের নাটবল্টু লাগিয়েছেন। আমার চোখে দেখা। আমাদের দেশের কতজন শিক্ষক ছাত্রবান্ধব হতে পেরেছেন? আছেন দু-চারজন হাতেগোনা। তাদের স্যার ডাকা হলো না ভাই ডাকা হলো, না নাম ধরে ডাকা হলো, তা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। শিক্ষাদানই তাদের কাজ। তাদের সালাম জানাই।

আমি আমার সব শিক্ষককে স্যার ডাকি। আমার থেকে বয়সে আট দশ বছরের ছোট, যাঁর অধীনে আমি পিএইচডি করেছি তাকেও বরাবর স্যার সম্বোধন করেছি। তিনিও আমাকে সম্মান করে আপা ডাকেন। প্রশাসনে যারা বয়সে আমার ছোট কিন্তু আমার আগে চাকরিতে এসেছে তাদের সবাইকে স্যার ডাকি। এই ডাকে আমার মর্যাদা কিছু কমেনি। আমি এতটুকু ছোট হয়ে যাইনি।

আসল কথা হচ্ছে আচরণ, শালীন ব্যবহার। কী সম্বোধন করা হলো সেটা বড় ব্যাপার না। ব্যাপার হচ্ছে ব্যবহার কেমন ছিল, যে কাজে গিয়েছেন সে কাজে তার সহযোগিতা পেয়েছেন কি না। শিক্ষক মহোদয় শিক্ষার্থীদের জড়ো করে অবস্থান ধর্মঘট করলেন, ছাত্রদের প্রতিবাদ করতে শেখালেন। ভালো। কোনো দিন হয়তো ছাত্ররা তার বিরুদ্ধেই বসে যাবে। এটা করে তিনি কিন্তু হিরো হননি।

বগুড়ার একজন মহিলা জাজ দুজন ছাত্রীর অভিভাবককে দিয়ে পা ধরিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। আমি বেশ কয়েকটা ভিডিও দেখেছি। সেখানে পা ধরতে বলেছেন এমন কথা শুনিনি। মামলা-মোকদ্দমা, ছাত্রীদের টিসি দেওয়ার ভয় দেখিয়েছেন বলে ভাষ্য দিয়েছেন অভিভাবক। অর্থাৎ তিনি এমন অবস্থার সৃষ্টি করেছিলেন যে ভয়ে অভিভাবকরা পা ধরেছে। বিষয়টা ঘটেছে বিচারক মহোদয়ের কন্যার স্কুল পরিচ্ছন্ন করতে অনীহা প্রকাশ এবং পরবর্তীতে সোশ্যাল মিডিয়ায় তার দেওয়া একটা স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে। যেখানে মেয়েটি অন্য ছাত্রীদের বস্তির মেয়ে বলেছে।

এ ঘটনায় সম্পৃক্ত হওয়ার কোনো কারণ ছিল কী বিচারক মহোদয়ের? ছাত্রীদের ব্যাপার তারাই মিটিয়ে নিত। স্কুল কর্তৃপক্ষ ছিল। কেন তিনি স্কুলে গেলেন, অভিভাবক কল করালেন, মামলার ভয় দেখালেন! আমরা অবশ্য বিচারকের বক্তব্য পাইনি। যা শুনছি তা একপক্ষের। উল্টোপিঠও থাকতে পারে। বিচারক বক্তব্য দিয়ে বিষয়টা পরিষ্কার করলে ভালো হতো। তার মেয়ে এত অল্প বয়সে এই জাতীয় স্ট্যটাস দিতে শিখেছে তাকি তিনি লক্ষ্য করেননি? এটা কি সমীচীন? বিচারকদের নিয়ে কথা বলতে অবশ্য ভয় লাগে। তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে। একবার একজন বিচারক আমার শুনানি না নিয়েই একটা মামলায় স্টে অর্ডার দিয়ে দিয়েছিলেন। আমি যখন তাকে বললাম, এটা আপনি পারেন না। শুনানি নিলেন না কেন। তখন তিনি বলেছিলেন পরের ডেটে আমার শুনানি নেবেন। এ কথা যখন তিনি বলেছিলেন তখনই তিনি বদলির আদেশাধীন। জানতেন পরের তারিখ পর্যন্ত তিনি থাকবেন না। তবে অনেক ভালো বিচারক আছেন। পরের তারিখে দায়িত্বে যিনি ছিলেন তিনি অন্যায়ভাবে দেওয়া স্টে ভ্যাকেট করে দিয়েছিলেন। তার কাছে আমাকে যেতেও হয়নি। বগুড়ার জাজকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলেও জেনেছি। তারপরও কেন এত কথা। এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কী নেই?

আমরা ছিলাম ব্রিটিশের কলোনি। তারা নিজেরা স্যার ডাকে না অথচ স্যার ডাক শুনতে চাইত। ডাকটা আমাদের দেশে চালু করে দিয়ে গেছে। সেটা আজও চলছে। এই সম্বোধন তুলে দিতে হলে সর্বত্রই তুলতে হবে। শুধু অফিস-আদালতে নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও। বিদেশে ছাত্ররা শিক্ষকদের নাম ধরেই ডাকে। আগে ভাবুন সেটা কজন মানতে পারবেন।

অনেক প্রতিকূলতা পেরিয়ে একজন নারী চাকরিতে আসে। কর্মক্ষেত্রে তাদের সম্মুখীন হতে হয় নানা বাধা বন্ধের। আজও তারা ন্যায্য পদোন্নতি, ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। বিদেশ যাত্রা আর চালেঞ্জিং কাজে মেয়েদের কথা সহজে ভাবা হয় না। সহকর্মীদের কাছ থেকে সব ক্ষেত্রে ভালো আচরণ, শোভন ব্যবহার পায় এমনো না। তারপরও নারীরা কাজ করে যাচ্ছে। আমি ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার পর দেখেছি কালেক্টরেটের পিয়ন-দারোয়ানরা পুরুষ ম্যাজিস্ট্রেট এলে উঠে দাঁড়াচ্ছে, লেডি ম্যাজিস্ট্রেট এলে গ্যাট হয়ে বসে থাকছে। দাঁড়ালে সবার ক্ষেত্রে দাঁড়াবে না দাঁড়ালে কারও ক্ষেত্রে না এটাই তো হওয়ার কথা। মোবাইল কোর্ট, ইলেকশন ডিউটিতে নারী অফিসারদের কথা ভাবা হতো পরে। কারণ কাজগুলোতে ঝুঁকি আছে। জেলখানা ভিজিটে যাওয়ার সময় মহিলা ম্যাজিস্ট্রেটদের নেওয়া হতো না কারণ কয়েদিরা নারী দেখলে উত্তেজিত হয়ে যেতে পারে। ভাবা যায়। কী চিন্তা আমাদের! এখন অবশ্য অবস্থা অনেকটা বদলেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নারীদের ফ্রন্ট লাইনে নিয়ে এসেছেন। দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে তারা। তবে দুঃখের বিষয় ভালো কাজ করলে তারা প্রশংসিত হন কমই, হঠাৎ কোনো বিচ্যুতি ঘটে গেলে সেটাই ফলাও করে প্রচার করা হয়। নারীরা অদক্ষ এটাই প্রমাণ করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হয়।

ভুললে চলবে না এ দেশের জন্মের পেছনে নারীর অবদান অনস্বীকার্য। বীরকন্যা প্রীতিলতা নিজ হাতে পটাসিয়াম সায়ানাইড গিলেছিলেন ব্রিটিশের হাতে ধরা দেবেন না বলে। কল্পনা দত্তের যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে তারামন বিবি, শিরিন বানু মিতিল, ফোরকান বেগম, আশালতা বৈদ্যসহ অনেকে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন। শহীদ হয়েছেন কবি মেহেরুন্নেসা, সাংবাদিক সেলিনা পারভীন, মুক্তিযোদ্ধা লুৎফুননেসা হেলেন। এদেশের প্রতিটি আন্দোলনে সংগ্রামে নারী পুরোভাগে ছিল, আছে।  কাজেই তাদের ছোট করে দেখার কিছু নেই।

নারী অফিসারদের উচিত আরও সতর্কভাবে কাজ করা, মানবিক হওয়া, জনবান্ধব হওয়া।  মনে রাখবেন আপনাদের বিপক্ষ দল বড্ড ভারি। আপনাদের টেনে নামাতে এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে তারা।  তারা যাতে কোনো সমালোচনার সুযোগ না পায় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকুন।

লেখক : কথাশিল্পী, গবেষক, সাবেক যুগ্ম সচিব

সর্বশেষ খবর