রবিবার, ৯ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

ইসরায়েল : বিক্ষোভের আগুন ও শিক্ষা

শহীদুল্লাহ ফরায়জী

ইসরায়েল : বিক্ষোভের আগুন ও শিক্ষা

সরকারের ‘ক্ষমতা-বাসনার’ বিরুদ্ধে অগ্নিগর্ভ বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছিল ইসরায়েল নামক দেশটি। পার্লামেন্ট ভবন থেকে শুরু করে নেতানিয়াহুর ব্যক্তিগত বাসভবন পর্যন্ত সরকার পতনের লক্ষ্যে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত গণজাগরণ ও বিক্ষোভ তীব্রভাবে বিস্তার লাভ করছে। ক্ষমতাকে নিজস্ব সম্পত্তি বানানোর চক্রান্তের বিরুদ্ধে দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতি চরম অস্থির হয়ে ওঠে। জনতার ঢলে রাজপথ জনসমুদ্রের রূপ  নেয় এমনকি সেনাবাহিনীর মধ্যেও অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে। ইসরায়েলি হারেটজ সংবাদপত্রে এ গণজোয়ারকে ‘দেশের ইতিহাসে বৃহত্তম বিক্ষোভ’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

ইসরায়েলের ৭৪ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে উগ্রপন্থি নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন নতুন সরকার এবার বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। জনতার উত্তাল তরঙ্গে ডানপন্থি সরকার আগামী মে মাস পর্যন্ত তার পরিকল্পনা পিছিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। সংসদের গ্রীষ্মকালীন অধিবেশনে বিচার সংস্কার বিলম্বিত করার জন্য নেতানিয়াহু একটি চুক্তিতেও স্বাক্ষর করেছেন। নয়তো বিদ্যমান সরকার সর্বনাশ এড়ানোর কোনো সুযোগ পেত না। বিচারব্যবস্থা সংস্কারের বিরুদ্ধে কথা বলায় প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্তকে বরখাস্ত করায় ফুঁসে উঠেছে দেশের আপামর জনগণ।

 

সুপ্রিম কোর্টের এখতিয়ার ক্ষুণœ করে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্বাধীন করার লক্ষ্যে এবং বিচারক নিয়োগকারী কমিটির ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতে রেখে বিচার বিভাগের সংস্কারের নামে সরকারের পরিকল্পনাকে ইসরায়েলের সংগ্রামী জনতা নস্যাৎ করে দিয়েছে। এ ছাড়া আইনপ্রণেতাদের কেউ দায়িত্ব পালনের জন্য অযোগ্য হলে তাকে অপসারণ করা আদালতের জন্য আগের চেয়ে জটিল ও কঠিন করার প্রস্তাব করা হয়েছে বিচারব্যবস্থা সংস্কারে। ইসরায়েলি সচেতন জনগণ মনে করে, বিচার বিভাগ সংস্কারের বিধানটি ক্ষমতাসীন নেতা নেতানিয়াহুর স্বার্থ বিবেচনা করে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিচার বিভাগ সংস্কারের ফলে বিচারক নিয়োগে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ জোরালো, মামলা খারিজ এবং আইন পাসের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের এখতিয়ার সীমিত, সেই সঙ্গে পার্লামেন্টের অবারিত হস্তক্ষেপের নীলনকশা প্রণয়ন করা হয়। সেই নীলনকশা উন্মোচিত হওয়ার পর সরকার প্রচ- বিক্ষোভ-প্রতিরোধের মুখে পড়ে।

প্রধানমন্ত্রী মূলত তার নিজের ওপর থেকে দুর্নীতির মামলা অপসারণ করতেই তড়িঘড়ি করে এ উদ্যোগ নিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন প্রতিবাদকারীরা। তারা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না দুরভিসন্ধিমূলক এ সংস্কার।

তেল আবিব, হাইফা, জেরুজালেম, বিরশেবা, হার্জলিয়া শহরসহ সমগ্র ইসরায়েলে প্রতিবাদের আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। বিক্ষোভকারীরা ইসরায়েলের পতাকা উড়িয়ে হাঁড়ি-পাতিল পিটিয়ে বিক্ষোভ প্রকাশ করে পার্লামেন্ট নেসেটে পৌঁছান। তারা প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহুর প্রস্তাবিত পরিবর্তনকে গণতান্ত্রিক শাসনের ওপর আক্রমণ বলে বর্ণনা করেন।

লক্ষণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বিক্ষোভকারীরা অভিযোগ করেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কট্টর ডানপন্থি সরকার গণতন্ত্র চায় না। দেশটি স্বৈরশাসনের আওতায় নিতে চাইছে বর্তমান সরকার। বিক্ষোভকারীরা মনে করেন একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে যেসব আইনকানুন বা নিয়মনীতি থাকা উচিত তার সীমা অতিক্রম করেছে নেতানিয়াহুর সরকার।

নীলনকশার এসব সংস্কার বাস্তবায়ন হলে ইসরায়েলের পার্লামেন্টের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের রায়গুলোকে বাতিল করা সহজ হবে। আরও ভয়ংকর হলো, সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তগুলো অগ্রাহ্য করার অনুমতি পাবে দেশটির পার্লামেন্ট। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হুমকিতে বা ঝুঁকিতে পড়বে, এজন্য বিক্ষোভকারীরা বলেছেন, যতটুকু গণতন্ত্র আছে সেটুকু রক্ষার চেষ্টা করছি। এ দুশ্চিন্তায় আমরা ঘুমাতে যেতে পারি না। সরকারকে এ পাগলামি অবশ্যই বন্ধ করতে হব।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে সমালোচকরা বলছেন, নেতানিয়াহু সরকারের এ সংস্কার পরিকল্পনা ইসরায়েলের বিচারিক স্বাধীনতাকে পঙ্গু করবে, দুর্নীতিকে আরও উৎসাহিত করবে, সংখ্যালঘুদের অধিকার নষ্ট করবে এবং ইসরায়েলের আদালত ব্যবস্থাকে বিশ্বাসযোগ্যতা থেকে বঞ্চিত করবে। আর এ কারণেই বিক্ষোভের ব্যানারে নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন নতুন জোটকে ‘লজ্জার’ সরকার বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ সংস্কার পরিকল্পনার বিরোধিতাকারীদের মধ্যে ইসরায়েলের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এসথার হায়াত এবং অ্যাটর্নি জেনারেলও রয়েছেন। ট্রেড ইউনিয়নগুলো দেশে সর্বাত্মক ধর্মঘটের ডাক দেয়। দেশটির সবচেয়ে বড় ও জাতীয় শ্রমিক ইউনিয়ন সংগঠন ‘হিসট্রাদ’ ধর্মঘটে নামায় পরিস্থিতি বড় জটিল হয়ে ওঠে। বিমান ওড়ানো স্থগিত করা হয়, সমুদ্রবন্দরের কাজকর্ম স্থবির হয়ে পড়ে। বিশ্বব্যাপী ইসরায়েলের দূতাবাসগুলোয় কর্মচারীরা যেন ধর্মঘটে যোগ দেন সে আহ্বানও জানানো হয়েছে।

সংসদীয় রাজনীতিতে আরেকটা দৃষ্টান্তমূলক ঘটনা ঘটেছে ইসরায়েলে। ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট ইসাক হারগোস সংস্কার পরিকল্পনা স্থগিত করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি আরও বলেন, দেশের ঐক্য, ইসরায়েলের জনগণ ও দায়িত্বশীলতার স্বার্থে বিচার বিভাগ সংস্কারের পরিকল্পনা বন্ধ করতে হবে। সংসদীয় ব্যবস্থায় সাধারণত প্রেসিডেন্ট রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রশ্নে কোনো ব্যাপারে মন্তব্য করেন না; কিন্তু ইসরায়েলে বর্তমান পরিস্থিতির বিবেচনায় জাতীয় স্বার্থে প্রেসিডেন্টকেও উদ্যোগী ভূমিকা নিতে দেখা গেছে। ইসরায়েলের এ আন্দোলনের অন্যতম দিক হচ্ছে কোনো রাজনৈতিক দল নয়, জনগণ স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে।

জনগণ উপলব্ধি করতে পেরেছে বিচার বিভাগ ভেঙে পড়লে গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণ করা সম্ভব হবে না। আর বিচার বিভাগকে সুরক্ষা না দিলে জনগণের ন্যায়বিচার এবং সব ধরনের অধিকার ভূলুণ্ঠিত হয়ে পড়বে। এ ছাড়া বিচার বিভাগ ধ্বংস হয়ে গেলে অন্য সব অর্জন ধ্বংস হয়ে যাবে। গণতন্ত্র রক্ষায়, বিচার বিভাগ রক্ষায়, ন্যায়বিচার রক্ষায় ইসরায়েলের প্রভাবশালী সেনাবাহিনীসহ বিরোধী দল, গুরুত্বপূর্ণ সিভিল সোসাইটিসহ আপামর জনসাধারণ সমর্থন জানিয়ে রাস্তায় নেমেছে। একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্বরাজনীতিতে এ আন্দোলন ও সংগ্রাম জনসচেতনতার নবতর মডেল। জনগণ ন্যায়সংগত অধিকারের সপক্ষে রাজপথে অবস্থান গ্রহণ করলে সেনাবাহিনীসহ সব পক্ষই জনগণের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে, সেনাবাহিনী জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় না। জনগণের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে এই এক বড় ধরনের বিজয়। বিচার বিভাগের নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা ছাড়া গণতন্ত্র টিকতে পারবে না, জনগণের অধিকার সুরক্ষা পাবে না এবং রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না।

এ আন্দোলনের আরও শিক্ষণীয় দিক হলো, বিচারব্যবস্থা এবং গণতন্ত্র সুরক্ষিত না হলে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা চরম ঝুঁকিতে পড়ে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংসদে জাতীয় স্বার্থবিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণ করলে তা ন্যায্যতা পায় না এবং জনগণ মেনে নেয় না বা নেবে না।

বিশ্বরাজনীতিতে ইসরায়েলের জনগণের গণজাগরণ এক নতুন ‘ডিসকোর্স’, যা গণতন্ত্র ও মুক্তিকামী মানুষের জন্য আশাবাদী বার্তা নিয়ে এসেছে। প্রতিরোধ ছাড়া ইতিহাস নির্মিত হয় না। শাসকদের ইতিহাসের বিপরীতে এটাই জনগণের পাল্টা ইতিহাস। এটাই মুক্তির সম্ভাব্য পথ।

ইসরায়েলি জনগণসহ সমগ্র বিশ্বের গণতন্ত্রকামী মানুষ উপলব্ধি করতে সক্ষম হচ্ছে গণতন্ত্র ও বিচার বিভাগ ধ্বংস হওয়া মানে স্বাধীনতা ধ্বংস হওয়া, দুর্নীতিকে উৎসাহিত করা, সমাজকে অতল গহ্বরের দিকে ঠেলে দেওয়া। সুতরাং জনগণই গণতান্ত্রিক, মানবিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের মূল কারিগর। জনগণই ইতিহাসের নির্মাতা। জনগণই রাষ্ট্রের সুরক্ষিত মালিক। একনায়কী শাসন, স্বৈরতন্ত্র, সামরিক শাসন বা একদলীয় শাসন কোনোটাই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকল্প নয়। ন্যায়বিচারের অভাবে, গণতন্ত্রের অভাবে, সাম্যের অভাবে একটি সমাজের বিকাশ এবং বহুমুখীনতা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়।

গণতন্ত্র এবং বিচার বিভাগ ধ্বংস করার যে কোনো চক্রান্ত জনগণ রুখে দেবে। রাজনৈতিক স্বার্থে রাষ্ট্র ও জনগণের নিরাপত্তা নিয়ে কোনো সরকার খেলা খেলতে পারবে না। ইসরায়েলের জনগণের সংগ্রামী ও পরিকল্পিত এ বার্তা সবার কাছে পৌঁছে যাক, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সুশাসন নিশ্চিত হোক এবং স্বৈরাচারী, অগণতান্ত্রিক, অসাংবিধানিক শাসকরা ইসরায়েলের এ বিক্ষোভ ও গণজাগরণ থেকে শিক্ষা নিক- জনগণের আন্দোলন আকস্মিক নয়, এটা অনিবার্য; এটাই আন্দোলন-সংগ্রাম ও লড়াইয়ের ঐতিহাসিকতা।

লেখক : গীতিকবি

[email protected]

সর্বশেষ খবর