বুধবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

রোজার সেকাল ও একাল

মেজর জিল্লুর রহমান (অব.)

  রোজার সেকাল ও একাল

জীবনের ঊষালগ্নে পবিত্র রোজাকে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের রূপে দেখেছি! সিয়াম সাধনার দিবা-রাতে চলেছে কোরআন তেলাওয়াত তাসবিহ তাহলিল। আর এখন কোন ভোগ-বিলাস রোজার মাঝে দেখছি। গ্রামের বড় মসজিদের তদারককারী এক যুবক আমাকে কল দিয়ে বলল, মামা ইফতারের জন্য কিছু টাকা দেন। জিজ্ঞাসা করলাম কত টাকা, উত্তরে সে যে অঙ্ক আমাকে জানাল, আমি নিজেকে বেমানান মনে করছিলাম।  ঢাকা শহরে এত টাকা কেউ ইফতারে খরচ করবে না। গ্রাম কি রাজধানী হয়ে গেল না কি। একবার রোজার সময় ওই মসজিদে ইফতারের সময় গেলাম, দেখি তুঘলকি কান্ড। মসজিদের এক অংশ ডেকচি সসপেন হাঁড়ি কড়াই তৈজসপত্র দখলে নিয়েছে। সেখানে ছোলা, পিঁয়াজু, বেগুনি, চপ, জিলাপি, বুন্দিয়া গরম গরম তৈরি হচ্ছে। মসজিদে ইফতারের নামে চেয়েচিন্তে টাকা এনে চলছে একেবারে নির্ভেজাল ইফতার উৎসব। ইমানটা এখন ভেজালে ভরপুর। রোজা যেমন সহিভাবে পালন করা হয় ইমান তেমন হলে দেশে ঘুষ, ওজনে কম, ভেজাল, কালোবাজারি, দখলদারি, বোনকে মেয়েকে ঠকানো থাকত না।

কিছুদিন পর জানতে পারি মুসল্লিরা ওই আয়োজকদের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকেছে মসজিদের টাকা চুরি করেছে এ অভিযোগে। আগে কাঁচাঘরের মসজিদ ছিল, শুকনা চাল, চিড়া, অর্ধ মুঠি মুড়ি দিয়ে ইফতার করেই নামাজে দাঁড়াত মুসল্লিরা। ভালোমন্দ আহার করার ক্ষমতা অধিক মানুষের ছিল না। টাইলসের পাকা ইমারতের মসজিদ ছিল না। মানুষের ছিল মানুষ্যত্ব ইমান আকিদা তাকওয়া। এ জমানায় পাড়ায় মহল্লায় মসজিদ নির্মাণ হচ্ছে, মার্কেটে দেখা যায় মা-বোনেরা হিজাবের দিক নজর দিয়েছেন। বাহ্যিক লেবাসের উন্নতি ঘটেছে। কিন্তু অন্যায় অনিয়মের বিস্তৃতি দেখে মনে হয় ইমানের  ক্ষেত্রে উন্নতির পথ অনেক বাকি।

শোনলাম মসজিদের সম্পত্তি সরকার নিয়েছে, একোয়ারের সেই টাকাও হজম করেছে নবীন ইমানদাররা। তারা আবার রাজনৈতিক দলের রেজগি নেতা! বিচার হয় হয় করে আর হলো না। আজও সেই টাকা আল্লাহর ঘর মসজিদের ফান্ডে ফিরে আসেনি। আমার শৈশবে দেখা পবিত্র রোজার মাসের শূন্য পকেটের পাক্কা ইমানদার মুসল্লি রোজাদারদের আদব-কায়দা জীবনাচার আর বর্তমান এ ভোগ বিলাসের রোজা এক নয়।

চোখের সামনে কী ঘটে গেল রোজার মাসের আকিদা, কিছুই কূলকিনারা করতে পারছি না। বাল্যকাল শৈশবে রোজা আসত শীতের মৌসুমে। বিদ্যুতের নাম শুনিনি। রোজার দিনে তখনকার মা-চাচিরা চুলায় লেগে থাকত কাঁচা কাঠে অনেক সময় ধোঁয়া হতো, বাঁশের চুঙ্গা দিয়ে ফুঁ দিতে দিতে শ্বাসকষ্ট হতো চুলা জ্বালাতে। বাগানে গিয়ে শুকনা ডালপালা কুড়িয়ে আনত। অনেক সময় কাঠ চলা করত। মা-চাচি-দাদিরা খাবার জোগাড় করা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। বাকি সময় নামাজ রোজা কোরআন তেলাওয়াত করত। প্রতিবারের খাবার মাছ তরিতরকারি জোগাড় করতে মা-চাচিদের বেশি পেরেশানি করতে দেখেছি। কিছু কম পড়লে এ বাড়ি ও বাড়ি ধার-উধার করে চালাত সেই বেলা। সপ্তাহে দুই দিন গ্রামের হাট বসত, দুবারে কেনাকাটা করত সাত দিনের জন্য।

ডিজিটাল মায়েরা ক্রেডিট ডেবিট কার্ডের ওপর ভর করে রহমতের দরজা খুলে রোজার বন্দেগির স্থান তালাশ করে পেয়েছেন শপিং মলে, লাচ্ছি-শরবতের দোকানে, নামিদামি হোটেলের সাহরিতে। ত্যাগের মহিমা চিরদিনের। ভোগের পুরস্কার নেই।

খাল বিল অথবা পুকুরের মাছ দিয়ে খাবার চলত। মাঝেমধ্যে হাঁস-মুরগি পালন করে তা দিয়ে কোনোমতে টেনেটুনে চালিয়ে রাখতেন। কালেভদ্রে একটা গরু জবাই হলে সবাই লাইন দিয়ে এক সের পাঁচ সের কিনত। হাঁস-মুরগির ডিম বাড়িতেই হতো আর বেশি দরকার হলে পাড়ায় ঘুরে ঘুরে কিনতে হতো। ডিম সিদ্ধ করলে দেখা যেত তার বেশ কিছু পচা হতো। এখন লেয়ার ফার্মের ডিম যেমন পচা নেই বললেই চলে। আমরা ভাই-বোনরা দল বেঁধে মা-চাচিদের ডিমের খোসা ছিলে দিতাম।

বাড়ির আনাচে-কানাচে ভিটায় গিমি শাক, ঢেঁকি শাক, থানকুনি শাক, ঝুড়ি কাথা শাক, হেলেঞ্চা শাক, কলমি শাক, বউত্তা শাক, ডাঁটা শাক কুড়াত। না খাওয়া শুকনা মুখে চিংড়ি মাছ দিয়ে শাক ভাজি একটা সুস্বাদু স্বাস্থ্যকর লোভনীয় পদের খাবার ছিল। বাড়ির লাউ, কুমড়া, শিম, বরবটি, বেগুন, মরিচ, টমেটো, বেগুন, শসা দিয়েই চলত। সাহরির খাবার ছিল- একটা শাক, একটা তরকারি, কখনো ডাল, কলা দুধ বা দুধ ও গুড়।

বাড়ির সেই সম্মানিত সিনিয়র সদস্য আমাদের বুড়ি গাই আধ সের দুধ দিত, তাই কলা দিয়ে কলা না থাকলে দুধ গুড় দিয়ে খাওয়া হতো সাহরি। কখনো দুধ না থাকলে নারিকেল কোরা আর গুড় দিয়ে খেতে হতো। আমাদের বুড়ি গাই বড় বংশ বিস্তার করেছে, তাই তার মর্যাদা বেশি ছিল। আশাতীত বাছুর দিয়েছে, দুধ দিয়েছে, বিনিময়ে তার উন্নত কোনো খাবার কপালে জোটেনি। সে মাঝেমধ্যে বুঝতে পারত নিষ্ঠুরতা করে তার সন্তানের অধিকার বঞ্চিত করে মানব সন্তানকে দুধ খওয়াচ্ছে। সে দেখেছে তার ত্যাগের প্রাপ্তি শূন্য, তাই বুদ্ধি করে মাঝেমধ্যে রাতে চালাকি করে তার ওলান আটকান বাছুরের মুখের দিক ধরত। আর অমনি বাছুর খেয়ে নিত। সকাল বেলা মা যখন গাই দোহাতে আসত আমি বাছুর ধরার জন্য মার সঙ্গে সঙ্গে যেতাম, মা বেশ কায়দা-কানুন করে ছোট চৌকির ওপর বসে এক হাতে দুধ দোহানোর হাঁড়িতে পানি নিয়ে বসেই বাছুর ছাড়তে বলতেন। যেদিন চুরি করে রাতে দুধ খেয়েছে সেদিন বাছুর দুধে মুখ দিতে চাইত না। মা ওলানে তাকিয়ে দেখতেন ফুটা বেলুনের মতো চুপসে গেছে ওলান। মা রেগে তাকে গালমন্দ করে বলত এত যত্ন করি তুই চুরি করে সব দুধ তোর বাছুরকে খাইয়েছিস, আমরা কী খাব। তোকে আজ ভাতের ফেন কুড়া ঘাস খেতে দেব না দেখি তুই কী খাস। এমন কত অভিযান চালাতে হতো সাহরির খাবারের তাগিদে। শেষ রাতে সাহরি খাওয়ার সময় বাবা চাচা চাচি ভাই বোন বাড়ির কিষাণদের নিয়ে সবাই একসঙ্গে বসে খেত। কাচারি ঘরে মৌলভি জায়গিরদারের জন্য খাবার পাঠাত। সঙ্গে কয়টা পান পাঠাত। বাড়ির সবার খাবারের জোগান দেওয়াই ছিল আমাদের তখনকার মায়েদের বড় ধর্ম। যৌথ পরিবারের খাওয়ার সদস্য কাজের লোক জায়গির মৌলভিসমেত সংখ্যা ছিল ১০-১২ জনের কম না। এত লোকের মেজবানি রান্না আগের মায়েরা করেছেন, চুলার পাশে ঘেমেছেন আর আঁচল দিয়ে কপাল মুখ মুছেছেন। হাসিমুখে হাড়ভাঙা খাটুনি করেছেন, বড় আশায় বুক বেঁধে পাশের বাড়ির কাকির কাছে ছুটে গেছেন রান্নার সময় কিছু কম পড়লে তা আনতে। তখন ফ্রিজ ছিল না, বাড়িতে মজুদ করে রাখা অসম্ভব ছিল। মজুদ শুধু পাকা মিষ্টি কুমড়া, চাল কুমড়া আর লবণ-ইলিশ। সংসারের অগণিত মানুষ খাওয়ার পর অবশিষ্ট থাকত তলানিতে মসলার ধুলা বালু, হলুদ মরিচ মাখানো পাতলা পানি তাই দিয়ে তৃপ্তির সঙ্গে তারা খেতেন। মা-চাচিদের দেখেছি তরকারির কড়াইয়ের ভিতর ভাত নিয়ে তা কড়াইতে লাগা পোড়া তেল মসলা দিয়ে ঘষে মাখিয়ে খেতে। আজকের মায়েরা এসব ভাবতে পারে কি না আমার জানা নেই। এভাবেই মা-জননীরা বুকের কষ্ট বুকেই চেপে আমাদের বড় করেছেন সবার মুখে হাসি ফুটিয়েছেন। যুগে যুগে ত্যাগের চরম মহিমা দিয়ে মায়েরা সবার মস্তকের ওপর স্থান করে নিয়েছেন, নবাগত মায়েদের সম্মান করেছেন পাকাপোক্ত। বাংলা মায়েদের এ মহীয়সী রূপ আমাদের সমাজকে আলোকিত করেছে। মায়েরা স্নেহ মায়া মমতা আদর যত্ন ভালোবাসা ত্যাগ তিতিক্ষা করে হতেন সুখী। বত্রিশটা নাড়িছেঁড়া কষ্টের ধন সন্তানদের সুখের জন্য জগতের সব সুখ বিসর্জন দিয়ে নিজে হন হাসিমুখে সুখের নিঃশেষ। আজকের উন্নতির যা কিছু চোখে পড়ে সবই আমাদের পুরনো দিনের মায়েদের অসীম তাগের সোনালি ফসল।

সাহরির সময় আমরা ছোটরা চাপুর-চুপুর খাবারের শব্দে ঘুম থেকে ওঠে যেতাম। রাগ হতো কেন আমায় ডাকল না? বাবা-চাচাদের ভয়ে মুখ খুলতে পারতাম না। মা-চাচিদের একা পেলে কৈফিয়ত চাইতাম কেন আমাকে ডাকলে না, আমি না খেয়ে রোজা থাকব। ইমানি কমান্ডার মিলিটারিতে চাকরি করতেন। অবসরজীবন গ্রামের বাড়িতে কাটিয়ে দিলেন দেশবাসীর সঙ্গে, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চলনে-বলনে সর্বদা মিলিটারি বেয়ারিং, একজন দেশপ্রেমিক মানবদরদি মানুষ ছিলেন। সবার শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। তিনি সাহরির সময় ঘুম থেকে ওঠে হাতে হারিকেন নিয়ে গ্রামের মধ্য দিয়ে চলা ডিসট্রিক্ট বোর্ডের বড় রাস্তা ধরে আর্মির ড্রিল প্রশিক্ষকের মতো গলা ছেড়ে হাঁকডাক দিয়ে সমগ্র গ্রাম প্রকম্পিত করে ডাকতেন ও আল্লাহর বান্দারা! ওহে রোজাদারেরা! হে মুমিন মুসলমানেরা ঘুম থেকে উঠুন, সাহরি খাওয়ার সময় হয়েছে, উঠুন সাহরি খান, আল্লাহর হুকুম তালিম করুন। জান্নাতের পথ সুগম করুন। আর মাত্র ১০ মিনিট সময় আছে উঠুন সাহরি খান। এই ছিল সাহরি খেতে আহ্বানের মমতা মাখানো ধ্বনি। তিনি সচ্ছল ছিলেন, তাই ঈদের সময় একটা গরু কিনতে কয়েকজনকে টাকা দিতেন, তারা কষ্টক্লেশ করে ঈদের দিন কেটেকুটে বিক্রি করত যাতে গ্রামের মানুষ গরুর গোশত খেতে পারে। বিক্রি শেষে তার টাকা তাকে ফেরত দিত। আল্লাহপাক এ মানবদরদি মানুষটিকে জান্নাত নসিব করুন।

ইফতার ছিল প্রথমেই পানি দিয়ে গলা ভেজানো। চালের খুদ, চালের গুঁড়া পানি নারিকেল গুড় মাখানো। আমাদের বাড়িতে একটা গোলপাতার কাঁচা মসজিদ ছিল। পাড়ার সবাই সেখানে একসঙ্গে ইফতার করতাম। কিশোররা সব বাড়ি থেকে যে যা দিত সংগ্রহ করে মসজিদে আনত ইফতার সামগ্রী। মসজিদে মাটির গোল বাটি ছিল, বিকালে প্রতিদিন পুকুর পাড়ে নিয়ে নারিকেলের ছোবড়া/খড়কুটা দিয়ে মেজে ধুয়ে পরিষ্কার করতে হতো।  জাউ দিয়ে ইফতার করত। তারাবি পড়ত সবাই ক্লান্ত দেহ নিয়ে। তারাবির পর ১০ মিনিট গল্প বিনোদন জোগাত। কার কেমন লাগল আজকের রোজা। রোজা কার কেমন কষ্ট হলো, সহজ হলো বলাবলি। হায়রে সেই দিন তুই কোথায় গেলি রে।  আজ দেখি গভীর রাতে বাড়ি ছেড়ে সাহরি খেতে তারকা হোটেলে যায় মায়েরা। ডিজিটাল সাহরি খাদকদের দশা হবে রবীন্দ্রনাথের লাঙ্গলের শনির দশার মতো।

                লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক

[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর