বৃহস্পতিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

জাসিন্ডা আরডার্ন, আপনি ফিরে আসুন

মো. রশিদুজজামান রুনু

নিউজিল্যান্ডের জাসিন্ডা আরডার্ন কিছু দিন আগেও দেশটির প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। প্রচ- সাহসী ও আত্মবিশ্বাসী এক নেতা তিনি। তবে এখন তিনি তাঁর অবস্থান বদলে ফেলেছেন। তিনি এখন অতি-সাধারণ দেহাতি মানুষের কাছাকাছি এক সাধারণ নারী নাগরিক! অভাবনীয় ঘটনা-ই বটে! ২০১৭ সালে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন জাসিন্ডা। পরের বছর মানে ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় সন্তানের মা হন। এর আগে এরকম প্রধানমন্ত্রী পদে থাকা অবস্থায় মা হয়েছিলেন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো। জাসিন্ডা আর বেনজির দুই নারীনেতাই চমক দেখালেন। তবে সারা দুনিয়ার মানুষ তাতে খানিকটা অবাকই হয়েছিল। তারও চেয়ে অবাক করার ঘটনা হচ্ছে- অত্যন্ত পরিশ্রমী ও মেধাবী প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্নের রাজনীতি ও রাষ্ট্রনায়কের দায়িত্বশীল ও বর্ণাঢ্য জীবন ছেড়ে দিয়ে আমজনতার কাতারে চলে আসা।

২০১৯ সালে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দুটি মসজিদে ধর্মীয় উগ্রবাদী সন্ত্রাসী-জঙ্গির সশস্ত্র-হামলায় ৫১ জন নিহত হন, সারা দুনিয়ায় তোলপাড়। একই বছর নিউজিল্যান্ডে জীবন্ত আগ্নেয়গিরিতে অগ্ন্যুৎপাত দুর্যোগে নিহত হন ২২ জন। এসব ঘটনায় এবং কভিড-১৯-সহ বিভিন্ন দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডার সাহসী ও কৌশলী ভূমিকা ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়। কিন্তু তিনি পার্লামেন্টে ঘোষণা করেন অচিরেই প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব ছেড়ে দেবেন। জাসিন্ডা এখন জলবায়ু সমস্যার ব্যাপারে কিছু ‘সহজ-সরল নিরীহ-জাতের’ জনকল্যাণমূলক কর্মকান্ড নিয়ে দিন কাটাতে চান, রাজনীতি থেকে দূরে সরে যেতে চান।

তাঁর মধ্যে যে সাহসিকতা বিশ্ববাসী দেখেছে এত দিন ধরে, তা থেকে তিনি সরে গেছেন, তার মানে দাঁড়াচ্ছে- তিনি ভারতের মিসেস ইন্দিরা গান্ধী, ব্রিটেনের মার্গারেট থ্যাচার, জার্মানির অ্যাঙ্গেলা মেরকেল বা অন্যসব বিশ্বমানের নারীনেতার মতো প্রবল সাহসী হয়ে নিজ জাতির তথা বিশ্বনেতার ভূমিকা পালনের তেজোদ্দীপ্ত করে নিজেকে গড়ে তুলতে পারেননি। হাজার হাজার বছর ধরে বহু নারীনেতার খ্যাতি ও সুনাম বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু জাসিন্ডা আরডার্ন তাদের অনুসরণ করে এগোতে পারলেন না। রাজনীতির মাহেন্দ্রক্ষণে নিজেকে ব্যর্থ ঘোষণা দিয়ে পিছিয়ে গেলেন। জীবনের লড়াইয়ে নেমেই যদি কোনো মেধাবী, শক্তিমান নারী এভাবে পালিয়ে বাঁচতে চান, তাহলে আর একজন সাহসী নারীকেও কি পাওয়া যাবে যিনি সাহস করে রাজনীতিতে রাষ্ট্র-প্রশাসনে অংশ নিতে এগিয়ে আসবেন? তাহলে নারী কি কেবলই পিছিয়ে পড়া প্রাণীতে পরিণত হবে! সেই যে জেঁকে-বসা পুরুষতন্ত্র আরও সগর্বে মাথা তুলে নারী সমাজের মাথার ওপর ছড়ি ঘোরাতে থাকবে! আমরা নিকট-অতীতে যুক্তরাষ্ট্রে এক অসংস্কৃত ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো জুয়াড়ি-ব্যবসায়ীর এক অতি উঁচুমাপের নারীনেতা হিলারি ক্লিনটনকে ইবলিশপনার রাজনীতির মাধ্যমে হারিয়ে দেওয়ার ঘটনা জানি। এখানে কিন্তু জাসিন্ডাকে হারাতে নব্য-ট্রাম্পের দরকার হয়নি, তিনি নিজেই নিজের পরাজয় ডেকে এনেছেন।

জাসিন্ডা আরডার্ন, আপনি হেরে গেলে নারী-সমাজ হেরে যাবে, নারীকে আপনি লড়াইয়ের বাইরের জগতে নিয়ে যেতে পারেন না, কখনোই না। সারা দুনিয়ায় নারী অবিরাম যুদ্ধ করে আসছে, সে যুদ্ধ কখনোই থামিয়ে দেওয়া যাবে না। তা থামালে নারীর অবিরাম আগুয়ান হওয়ার সংগ্রাম আর কোনো দিনই এগোবে না। আজকে নয়া-সাম্রাজ্যবাদী চীনের সম্প্রসারণবাদী নীতির বিরুদ্ধে যে তাইওয়ান লড়ে যাচ্ছে সাত দশক ধরে, সাম্প্রতিককালে তার নেতৃত্ব দিচ্ছে কে? একজন নারীনেতা। তিনি তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং ওয়েন। চীন অবিরাম তাইওয়ানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-হুমকি দিয়ে যাচ্ছে, এমন কি তার যুদ্ধ-মহড়া তাইওয়ান ঘিরে ভয়ংকর তান্ডব সৃষ্টি করে চলেছে- একটা স্বাধীন-সার্বভৌম ভূখন্ডে। পুরোপুরি অযৌক্তিক কায়দায় চরম স্বৈরতন্ত্রের দাম্ভিকতা দেখিয়ে চীন সেই তাইওয়ানকে দখলে নিতে প্রতি মুহূর্তে হুমকি-ধমকি দিয়েই যাচ্ছে। কিন্তু তাইওয়ান প্রেসিডেন্ট ওই নারীনেতা সাই ইং ওয়েন কিছুই পাত্তা দিচ্ছেন না। তিনি ভালোভাবেই জানেন- তাইওয়ান ন্যায়সংগত পথে আছে, তাইওয়ানি মানুষের আত্ম-নিয়ন্ত্রণাধিকারের লড়াইয়ে সঠিক জায়গায়ই আছে।

১৯৭১ সালে আমাদের বাংলাদেশ যখন বর্বর পাকবাহিনীর দখলে, গণহত্যা আর ধ্বংসযজ্ঞে ওদের বুটের তলায় নিষ্পিষ্ট হচ্ছিল তখন সর্বাধিক সাহস দেখিয়েছিল ভারতীয় নেতা মিসেস ইন্দিরা গান্ধী। পাকিস্তানের মাথামোটা বর্বর জেনারেলরা যখন ভারতকে, তার সরকারি দলের নেতাদের অযৌক্তিক ভাষায় গাত্রদাহ ঝাড়ার ভাষায় তুলাধোনা করছিল, কটুকাটব্যে, অভব্যতায়, অসভ্যতায়, অত্যন্ত মেধাবী ও দুঃসাহসী এবং ন্যায়নীতিবান ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, সারা দুনিয়ার বিশ্বনেতাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বাংলাদেশের নিপীড়িত মানুষের মুক্তি-সংগ্রামের আসল যৌক্তিকতা তুলে ধরেছেন, সেই সংগ্রামে বাংলাদেশের লড়াকু জাতির পাশে থাকার ভারতীয় ন্যায়নীতির পক্ষে চমৎকার-সব যুক্তি তুলে ধরেছেন। দানব-রাষ্ট্র পাকিস্তানিদের ভয়ংকর দৈত্যকায় নিষ্ঠুরতার মানবতাবিরোধী সব অনাচার তুলে ধরেছেন। বিশ্বের দায়িত্ববান ও মানবতাবাদী এবং সংগ্রামী নেতারা সবাই মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর আন্দোলনের বুদ্ধিমত্তার সংগ্রাম ও তার প্রক্রিয়াটার ন্যায়ানুগ যৌক্তিকতা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। আমরা জাসিন্ডা আরডার্নকে মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর মতো নেতায় পরিণত হতে দেখতে চাই, মিসেস অ্যাঙ্গেলা মেরকেলের মতো নেতায় পরিণত দেখতে চাই। তাঁকে আমরা বিশ্বমানবতার লড়াইয়ের ময়দান থেকে পেছন দিক দিয়ে কখনো পলায়মান দেখতে যেন না-পাই। যদি এরপরও তেমনটা হয়, তাহলে মিসেস জাসিন্ডা আরডার্নের মতো নেতার জন্য একটা ‘অগ্রিম শোকসভা’ আয়োজন করে রাখবে না-এই বিশ্বের লড়াকু নারী সমাজ! যখন তার অগণন লড়াকু নারীনেতা প্রয়োজন ভবিষ্যৎ-বিশ্বের অগুনতি দানব সামলাতে।

লেখক : সম্পাদক, পাক্ষিক প্রিয়ভূমি

সর্বশেষ খবর