মঙ্গলবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

অকারণ বিতর্কে মেতেছেন মোদি

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

অকারণ বিতর্কে মেতেছেন মোদি

বিগত শতকের চারের দশকের গোড়ায় ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিয়ে করেছিলেন ফিরোজ গান্ধী নামক একজন বড় মাপের রাজনীতিবিদকে। এ বিয়ের উদ্যোক্তা ছিলেন জাতির জনক মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। বিয়ের সাক্ষী ছিলেন দুই বাঙালি জ্যোতি বসু ও ভূপেশ গুপ্ত। এটা নাকি ইন্দিরা গান্ধীর মারাত্মক অপরাধ! কারণ বিয়ের আগে তাঁর পদবি ছিল নেহরু।   তাঁর পিতা ছিলেন জওহরলাল নেহরু। তিনি কেন পদবি পাল্টালেন? নেহরু না লিখে কেন গান্ধী লিখছেন? এতে প্রচন্ড গোসা হয়েছেন ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

আবহমান কাল থেকে গোটা বিশ্বে প্রচলিত নিয়ম, বিয়ের পর মেয়েরা স্বামীর পদবি গ্রহণ করেন। এখানে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, জৈন কিছু নেই। গোটা দুনিয়ায় এ নিয়ম যুগ যুগ ধরে চলে এসেছে। সম্প্রতি ভারতের রাজ্যসভায় (উচ্চকক্ষ) রাষ্ট্রপতির ভাষণে ধন্যবাদ প্রস্তাব দিতে গিয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এ প্রসঙ্গটি তুলেছেন। তিনি বলেছেন, রাহুলের পদবি হওয়া উচিত নেহরু। তা না করে তার ঠাকুমা গান্ধীকে বিয়ে করে তার পদবি কেন নিলেন, তার কৈফিয়ত দিতে হবে রাহুল গান্ধী এবং সোনিয়া গান্ধীকে। বিশ্বের চিরাচরিত নিয়ম ভেঙে বিয়ের পর ইন্দিরা কেন পদবি পাল্টালেন, তার কৈফিয়ত চাওয়া হচ্ছে রাহুল গান্ধীর কাছ থেকে।

ওই বক্তব্য শোনার পর গোটা ভারতবর্ষে তার শিক্ষা ও সংস্কৃতি নিয়ে শুধু কংগ্রেস নয়, সমস্ত বিরোধী দল একই সুরে প্রশ্ন তুলেছে।

তিনি সংসদে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা কেউ মেনে নিতে পারছে না। উত্তর প্রদেশের সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ যাদব, মহারাষ্ট্রের প্রবীণ নেতা শারদ পাওয়ার, কাশ্মীরের বর্ষীয়ান নেতা ফারুক আবদুল্লাহ থেকে শুরু করে সবাই একবাক্যে মোদিকে ধিক্কার জানিয়েছেন। রাজ্যসভায় বিরোধী দল নেতা মল্লিকার্জুন খাড়গে, রাজ্যসভার চেয়ারম্যান জগদীশ ধনখড়ের কাছে মোদির এ বক্তব্য রেকর্ড থেকে মুছে দিতে বলেছেন। তিনি বলেছেন, মোদি সারা বিশ্বের বিবাহিত মহিলাদের অপমান করেছেন। কারণ প্রায় সব মহিলাই বিয়ের পর পদবি পরিবর্তন করে থাকেন। কংগ্রেস দলের প্রধান মুখপাত্র জয়রাম রমেশের অভিযোগ, মোদি নিজে বিবাহিত।

তাঁর স্ত্রী কোন উপাধি নিয়েছিলেন? তিনি বলেন, এটা একটা আশ্চর্যের ব্যাপার গুজরাটের দুবার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার সময় তিনি যে মনোনয়নপত্র দাখিল করেন, তাতে উল্লেখ করেছিলেন অবিবাহিত বলে। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময় তিনি মনোনয়নপত্রে লিখেছিলেন, তিনি অবিবাহিত। তখন দেশে ফ্রি প্রেস ছিল। প্রায় সব কটি সংবাদমাধ্যমে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর ছবি দিয়ে সংবাদ প্রকাশ হয়েছিল। তাঁর নাম যশোদাবেন মোদি। সাংবাদিকদের কাছে পরে তিনি স্বীকার করতে বাধ্য হন, বিয়ে করেছিলেন কিন্তু একসঙ্গে থাকেন না। এখনো সেই স্ত্রীর সঙ্গে সরকারিভাবে তার বিচ্ছেদ হয়নি। বছর চারেক আগে তার বর্তমান স্ত্রী যশোদাবেন কালীঘাটে পূজা দিতে এসেছিলেন। তাঁর কলকাতা সফর গোপন রাখার অনেক চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, এত গোপনীয়তা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি কী করে তা জানতে পারলেন! তিনি বিমানবন্দরে গিয়ে তাঁর হাতে উপহার তুলে দিয়ে এসেছিলেন।

সংসদের উচ্চকক্ষে তাঁর এ বক্তব্যের পর গোটা দেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। কোনো কোনো মহল থেকে বলা হয়, রাহুল গান্ধীর পদবি যদি নেহরু হতো তাহলে নরেন্দ্র মোদি তাঁকে আরও বেশি করে গালাগালি দিতে পারতেন। তা হচ্ছে না বলেই তাঁর যত রাগ।

জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ও প্রাক্তন অধ্যাপকরা টিভির পর্দায় মোদির ওই উক্তির কড়া সমালোচনা করছেন। তাঁরা স্পষ্টই বলেছেন, নরেন্দ্র মোদি ইতিহাস জানেন না। তাই এ ধরনের অসংলগ্ন কথাবার্তা বলে চলেছেন। তিনি যে শুধু ইতিহাস জানেন না তাই নয়, মোদি ইতিহাস গুলিয়ে দিতেও ওস্তাদ।  তাঁর কর্মকান্ড দেখলেই এটা স্পষ্ট বোঝা যায়। বিশেষ করে ইতিহাসের গৈরিকীকরণ বেশ কিছুকাল ধরেই চালিয়ে আসছে মোদিবাহিনী। একাধিক ক্ষেত্রে ইন্ডিয়ান হিস্টোরি কংগ্রেসসহ বিশিষ্টজনরা তাঁর তুলাধোনা করেছেন। কিন্তু মোদি, অমিত শাহ, যোগী আদিত্যনাথের মতো নেতারা সে কথায় কখনই কান দেননি। নিজেদের গৈরিকীকরণের অ্যাজেন্ডা তারা নিঃশব্দে চালিয়ে গেছেন এবং এখনো যাচ্ছেন। সারা ভারতে স্কুল পর্যায়ে কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষাবিষয়ক নিয়ন্ত্রক সংস্থা হলো এনসিআরআরটি। কেন্দ্রীয় বোর্ডের পরীক্ষা, লেখাপড়া থেকে শুরু করে সিলেবাস সবই নিয়ন্ত্রণ করে এ সংস্থাটি। সম্প্রতি ভারতের বৃহত্তম রাজ্য যোগী আদিত্যনাথের উত্তর প্রদেশে ইতিহাসের সিলেবাস আমূল বদলে ফেলা হয়েছে। মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাসটাই তারা সিলেবাস থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছে। মুঘল সম্রাটরা সোয়া তিন শ বছর ভারত শাসন করেছেন।

অর্থাৎ ভালোমন্দ মিশিয়ে সোয়া তিন শ বছরের ইতিহাস তাদের। এতদিন পর্যন্ত সে ইতিহাস ভারতের স্কুল পর্যায়ে পাঠ্য ছিল। যোগী আদিত্যনাথ সরকারের এক কলমের খোঁচায় তা বাদ পড়ে গেছে!  নেহরু-গান্ধী যে বিতর্ক মোদি শুরু করেছেন তার একটা প্রামাণ্য ইতিহাস আছে। কিন্তু তার ধারকাছ দিয়ে না গিয়ে নরেন্দ্র মোদিরা সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পদবি নিয়ে যে নোংরা রাজনীতি শুরু করেছেন, তাতেই তাঁর চরিত্র স্পষ্ট হচ্ছে বলে মনে করছেন ইতিহাসবিদ থেকে শুরু করে বিশিষ্টজনেরা।

               ♦ লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক

 

সর্বশেষ খবর