মঙ্গলবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

শতাব্দী ডিঙানো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

তপন কুমার ঘোষ

শতাব্দী ডিঙানো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

নড়াইলের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সিঙ্গাশোলপুর কে পি ইনস্টিটিউশন। স্কুলের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে পুনর্মিলন উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে ২৫ এপ্রিল। স্কুল প্রাঙ্গণে পালিত হচ্ছে ১০০ বছর পূর্তির অনুষ্ঠান। স্কুলের বর্তমান ও প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষক-শিক্ষিকা পুনর্মিলন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করছেন। শোভাযাত্রা, আলোচনা, স্মৃতিচারণা ও সাংস্কৃতিক পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শেষ হবে দিনব্যাপী এ আয়োজন।

স্থানীয় জমিদার কালীপ্রসন্ন রায় স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন ১৯২১ সালে। তারই নামানুসারে স্কুলটির নাম রাখা হয় সিঙ্গাশোলপুর কে পি ইনস্টিটিউশন। পরে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে সিঙ্গাশোলপুর কালীপ্রসন্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়। ১০০ বছর আগে সেমিপাকা ভবনে শুরু হওয়া বিদ্যালয়টি এখন তিন তলা ভবনে। করোনার কারণে শতবর্ষ পূর্তি অনুষ্ঠান দুই বছর পিছিয়ে যায়।

স্কুলের শতবর্ষ পূর্তি অনুষ্ঠানের প্রাক্কালে আমার সেই শিক্ষকদের কথা খুব মনে পড়ে। প্রধান শিক্ষক বিমলা চরণ চক্রবর্তী স্যার নবম ও দশম শ্রেণিতে গণিত ও ইংরেজি পড়াতেন। নলিনী রঞ্জন নাগ স্যার ইতিহাসের শিক্ষক ছিলেন। অতীন্দ্রনাথ মিত্র স্যার পড়াতেন বাংলা। আর আহম্মদ কাজী স্যার পড়াতেন ইংরেজি গ্রামার। কাজী স্যার ছিলেন বদমেজাজি। ক্লাসে টুঁশব্দটি করা যাবে না। মৌলবি হাবিবুর রহমান স্যার ইসলামিয়াত আর আরবি পড়াতেন। শিক্ষকদের মধ্যে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে রাগী। এসব কথা স্মৃতি থেকে লিখছি। তখনকার দিনে অঙ্ক ও ইংরেজি শিক্ষকের খুব কদর ছিল।

প্রধান শিক্ষক বিমলা চরণ চক্রবর্তী স্যার ছিলেন অসাধারণ। তাঁর সম্পর্কে আগেও একবার লিখেছি। নবম ও দশম শ্রেণিতে গণিত ও ইংরেজি পড়াতেন। কোনো কিছু না বুঝে মুখস্থ করার ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি। হেড স্যার ছড়ি নিয়ে ক্লাসে আসতেন। তবে ছড়ির ব্যবহার খুব একটা করতেন না। প্রয়োজনও হতো না। ভয় দেখানো আর কি! সবাই তাঁকে শ্রদ্ধা ও সমীহ করত। স্যারের রসবোধ ছিল প্রখর। ক্লাসে মাঝেমধ্যে আমাদের উদ্দেশে বলতেন, ‘যতই বকো আর ঝকো, কানে দিয়েছি তুলো; যতই মারো আর ধরো, পিঠে বেঁধেছি কুলো।’ দীর্ঘদেহী হেড স্যার ছিলেন খুব কেতাদুরস্ত। স্কুলে সব সময় ধবধবে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরে আসতেন। ছাত্রদের পড়ানোই ছিল তাঁর একমাত্র ব্রত। স্কুল ছুটির পর দশম শ্রেণির মেধাবী ছাত্রদের কোচিং করাতেন বিনা সম্মানিতে। ছাত্রদের মনে জ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে দেওয়ার মধ্যেই যত আনন্দ!

আমার শিক্ষকরা ছিলেন আদর্শবান ও শতভাগ নিষ্ঠাবান। শিক্ষার্থীদের মধ্যে আদর্শের বীজ বপন করতে সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন। ঠিক যেন পিতা-মাতার মতোই। কোনো শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন অসদাচরণের অভিযোগ তখন কল্পনাও করা যেত না! ইদানীং কিছু শিক্ষকের কুকীর্তির কাহিনি সামাজিক মাধ্যম ও সংবাদপত্রের পাতায় পড়ার পর লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়। চিকিৎসাসেবা-শিক্ষকতা-সাংবাদিকতা মহৎ পেশা। এসব পেশার মর্যাদাই আলাদা। ঝুড়িতে কয়েকটি পচা আমের কারণে বাকি সব আমেরই বদনাম হয়! এর মর্মার্থ ব্যাখ্যা করা নিষ্প্রয়োজন।

আমাদের স্কুলের খুব সুনাম ছিল। প্রধানত মাধ্যমিক পরীক্ষায় ভালো রেজাল্টের কারণে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার এম. আজিজুল হক। তিনি এই স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র। সেই ১৯৫৬ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন তিনি। স্কুলের দুজন প্রাক্তন ছাত্র- সোমনাথ দাস ও হেমনাথ দাসের নাম সবার মুখে মুখে ফিরত। এরা সহোদর। ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ডের মেধা তালিকায় বড় ভাই সোমনাথ দাস অষ্টম স্থান অধিকার করেন। ১৯৫৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানে একটাই শিক্ষা বোর্ড ছিল। এর চার বছর পর ১৯৬২ সালের এসএসসি পরীক্ষায় ছোট ভাই হেমনাথ দাস রাজশাহী বোর্ডের মেধা তালিকায় ১৩তম স্থান অধিকার করেন। বড়দের মুখ থেকে দুই সহোদরের সাফল্যগাথা শুনে আমরা বড় হয়েছি। পরে আমাদের স্কুলেরই দুই কৃতী ছাত্র নির্মল কুমার দাস ও রতন কুমার দত্ত যশোর বোর্ডের অধীন এসএসসি পরীক্ষায় যথাক্রমে দ্বিতীয় ও ষষ্ঠ স্থান অধিকার করেন। এটা ১৯৬৬ সালের কথা। পরীক্ষায় ভালো রেজাল্টের পেছনে স্কুলের সেই শিক্ষকদের অবদান অনস্বীকার্য। আমার শিক্ষকদের প্রায় সবাই অনেক আগেই প্রয়াত হয়েছেন। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, একমাত্র নীরোদ স্যার এখনো বেঁচে আছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৮০ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষায় এ স্কুলেরই কৃতী ছাত্র গৌতম কুমার মিত্র যশোর বোর্ডের মেধা তালিকায় ঠাঁই করে নেন। তিনি অধিকার করেন ষষ্ঠ স্থান।

প্রসঙ্গত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২১ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী লীলা নাগের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন পরীক্ষা হলের নামকরণ করা হয়েছে সম্প্রতি। আমাদের স্কুলের প্রথম ছাত্রী ছিলেন বীথিকা ভট্টাচার্য। ষাটের দশকের শেষ দিকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন তিনি। একে তো অজগ্রাম। তার ওপর রক্ষণশীল সমাজ। বীথিকা স্কুলের একমাত্র ছাত্রী।

সবার নজর ছিল তার দিকে। যেন অন্য গ্রহের জীব! পথে-ঘাটে অনেকেই তার দিকে বাঁকা চোখে তাকাত। কম কটাক্ষ সহ্য করতে হয়নি তাকে। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। অন্য মেয়েদের পথ দেখিয়েছিলেন। আলোর পথ। তার দেখানো পথ ধরে প্রতি বছর দু-এক জন করে ছাত্রী স্কুলে ভর্তি হতে শুরু করেন। স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোড়ল আবুল হোসেন জানালেন, বর্তমানে নিয়মিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫৩৫। এর মধ্যে ছাত্র ২৯০ আর ছাত্রী ২৪৫। স্কুলে শিক্ষিকা আছেন সাতজন। কত পরিবর্তন!

♦ লেখক : সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, জনতা ব্যাংক লিমিটেড

সর্বশেষ খবর