বুধবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

ওরা জীবন উৎসর্গকারী

জহিরুল হক শামীম

দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিধান, আইনশৃঙ্খলা ও জনগণের জানমাল রক্ষার মতো ঝুঁকিপূর্ণ কর্তব্য পালনকালে প্রতি বছর অনেক পুলিশ সদস্য আহত ও নিহত হন। যাদের সম্পর্কে আমরা অনেকেই তেমন খোঁজখবর রাখি না। পুলিশ বাহিনীতে কাজ করার ক্ষেত্রে রয়েছে অনেক চ্যালেঞ্জ বিশেষ করে জঙ্গি ও মাদক দমনে। দেশের প্রতিটি সংকটে নিরাপত্তা নিশ্চিতে নির্ভীক পুলিশ সদস্যরা সর্বদা কাজ করে যাচ্ছে। রাতের পর রাত জেগে, চোখের ঘুম হারাম করে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঝড়-বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পুড়ে, পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে দেশের জানমালের নিরাপত্তা দিতে জনগণের পাশে থেকে কাজ করে যায় পুলিশ। পুলিশ সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো সত্তা নয়। পুলিশে কর্তব্যরত সদস্যরা এ দেশের জনগণের কারও না কারও ভাইবোন, ছেলেমেয়ে বা আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পাড়া-পড়শি- সর্বোপরি এ দেশেরই সন্তান।

জনগণ বিপদে পড়লে অথবা অপরাধের শিকার হলে, একমাত্র পুলিশই পাশে দাঁড়ায় সব ভয়ভীতি উপেক্ষা করে। আর কঠিন এ দায়িত্ব পালনকালে বহু সদস্যকেই অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হয়।

গত ছয় বছরে কর্তব্য পালনরত অবস্থায় ২০১৭ সালে ১৩০ জন, ২০১৮ সালে ১৩০ জন, ২০১৯ সালে ১৭৯ জন, ২০২০ সালে ২০৮ জন, ২০২১ সালে ১৩৮ জন, ২০২২ সালে ১২১ জন এবং করোনাকালীন জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধানকল্পে বিভিন্ন পদমর্যাদার ১০৭ জন পুলিশ সদস্য শাহাদাতবরণ করেন। তা ছাড়া ২০২২ সালে চাকরিরত অবস্থায় ২৯১ পুলিশ সদস্য মৃত্যুবরণ করেন। জঙ্গি দমনে পুলিশ বাহিনীর অনেক বীর সদস্য তাঁদের প্রাণ উৎসর্গ করেছেন অকুতোভয়ে। তাঁদের মধ্যে ২০১৬ সালে হলি আর্টিজান হামলার ঘটনায় শাহাদাতবরণকারী তৎকালীন সহকারী পুলিশ কমিশনার রবিউল ইসলাম, ডিবি, ডিএমপি এবং পুলিশ পরিদর্শক (নিরস্ত্র) মোহাম্মদ সালাউদ্দিন, অফিসার ইনচার্জ, বনানী থানা উল্লেখযোগ্য। ২০১৭ সালের ২৫ মার্চ সিলেটের শিববাড়ীর পাঠানপাড়া এলাকায় ‘আতিয়া মহলে’ ভয়াবহ জঙ্গি হামলায় সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের পরিদর্শক মনিরুল ইসলাম ও চৌধুরী আবু কয়ছর এবং র‌্যাবের তৎকালীন ইন্টেলিজেন্স প্রধান লে. কর্নেল আজাদ ঘটনাস্থলেই নিহত হন। হামলায় চারজন সাধারণ নাগরিকও নিহত হন। দায়িত্ব পালন কালে শাহাদাতবরণকারী উল্লেখযোগ্য পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে এআইজি (অপারেশন্স), পুলিশ হেড কোয়ার্টার্স সাঈদ তারিকুল হাসান বিপিএম, পুলিশ সুপার নিজাম উদ্দিন, এপিবিএন বগুড়া, পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান, ডিসি, সিএমপি-সহ অনেক থানার অফিসার ইনচার্জ এবং বিভিন্ন পদমর্যাদার পুলিশ সদস্যবৃন্দ কর্তব্যকালীন ও করোনাকালীন মৃত্যুবরণ করেন। জাতীয় যে কোনো সংকটে সামনে থেকে দায়িত্ব পালন করে থাকে বাংলাদেশ পুলিশ। মহামারি করোনাকালীন নিজেদের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অসুস্থ করোনা রোগীদের হাসপাতালে নেওয়া, সেবা-শুশ্রƒষা করা, খাদ্য বিতরণ, ওষুধ পৌঁছে দেওয়ার কাজও করেছেন পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। অনেক ক্ষেত্রে করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তির স্বজনরা দূরে সরে গেলে দাফনের কাজও পুলিশ করেছে।

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের পুলিশ সদস্যরা পাক-হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এর ফলে সূচিত হয়েছিল মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ। ১৪ হাজার বাঙালি পুলিশ সদস্য সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। থানা, ফাঁড়িতে কর্মরত পুলিশ সদস্যরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এর মধ্যে ১১০০ জনের বেশি পুলিশ শাহাদাতবরণ করেন।

বাংলাদেশ পুলিশ শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরেও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে আসছে। এ যাবৎকালে বাংলাদেশ পুলিশের প্রায় ২১ হাজার সদস্য জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন। বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার সুমহান দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এ পর্যন্ত একজন অতিরিক্ত আইজিপিসহ বাংলাদেশ পুলিশের ২২ জন সদস্য বিশ্ব শান্তি রক্ষার্থে জীবন উৎসর্গ করেছেন এবং ১২ জন সদস্য আহত হয়েছেন। তাঁদের এই মহান আত্মত্যাগ আমাদের কাছে বেদনার পাশাপাশি গর্বেরও। প্রতিনিয়ত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পরিবারের মায়া ত্যাগ করে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় জীবন উৎসর্গকারী সব বীর পুলিশ সদস্যের আত্মার শান্তি কামনা করি।

                লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর