বৃহস্পতিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

বাস্তব জীবনে বিয়ে মানে চলচ্চিত্রের শুরু

খুজিস্তা নূর ই নাহারিন

বাস্তব জীবনে বিয়ে মানে চলচ্চিত্রের শুরু

চলচ্চিত্রে বিয়ে মানে হ্যাপি অ্যান্ডিং আর বাস্তব জীবনে বিয়ে মানে চলচ্চিত্রের শুরু। অনেকবার ভেবেছি সিনেমার মতো বাস্তব জীবনটাও যদি ওই বিন্দুতেই থেমে থাকত।

১৯৯৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর বিয়ের পরের তিন দিন ঘোরের মধ্যে কাটল। এই বাসায় টেলিভিশনের লাইন টানা নেই। অগত্যা রবিবারে জনপ্রিয় টেলিভিশন সিরিজ নাটক ‘কোথাও কেউ নেই’-এর শেষ পর্ব দেখার জন্য অন্য একটি বাসায় গেলাম দুজন।  নাটক শেষে নাটকের শেষ দৃশ্য নিয়ে আবেগাপ্লুত আমাকে টিংকু বলল, এবার ফোন করে তোমার পরিবারকে বিয়ের কথাটি জানাও।

এর আগেও কয়েকবার বলেছে, কিন্তু আমার ভ্রুক্ষেপ নেই। সাফ জবাব, যা হয় হবে। আমি কিছুতেই জানাতে পারব না। সে আমাকে বিয়ে করেছে। অতএব এর পরের দায়িত্ব তার। সে আমাকে বলল, এই যে আমি তোমার পাশে আছি, তোমাকে ছুঁয়ে আছি এইবার ফোন দাও। ভয়ে আমি কাঁদতে শুরু করলাম, কিছুতেই পারব না আমি। টিংকু আমাকে এক গ্লাস পানি এনে খাওয়াল। বোঝানোর জন্য বলতে শুরু করল, ‘দেখো, তুমি যদি না জানাও, আমাকে তোমার পরিবার জেলে ঢুকাবে, মামলা হবে, মানসম্মান আর কিছুই থাকবে না। কথা বলার সময় আমি তোমার হাত ধরে থাকব। একজনকে অন্তত জানাও, তোমার বিয়ে হয়েছে।’

ঘণ্টা দুয়েক বোঝানোর পর আমি মেজো ভাইকে ফোন দিয়ে বললাম, ‘টিংকু ভাইয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়ে গেছে।’ মেজো ভাই বললেন, ‘টিংকুকে দাও।’ মেজো ভাই আর্মি ডাক্তার, রাজেন্দ্রপুরে পোস্টিং। ভাই টিংকুকে বললেন, ‘আমাদের না জানিয়ে বিয়ে করে অন্যায় করেছ, আমার বোনকে কালই আমার বাসায় রেখে যাবে।’

টিংকু পরদিন চলমান সংসদ অধিবেশনে যেয়ে আজম ভাইকে (মির্জা আজম) আর টেলিফোনে হীরা ভাইকে (পরবর্তীতে জামালপুরের এমপি) বলল, মুন্নিকে আমি বিয়ে করেছি, ওর পরিবার সামলানোর দায়িত্ব আপনাদের। যদি সবার সামনে আবারও বিয়ে করতে হয়, করব। কিন্তু এ বিয়ে ভাঙতে দেব না কিছুতেই। 

এর পরের দিন টিংকু আমাকে সঙ্গে নিয়ে রাজেন্দ্রপুরে ভাইয়ের বাসায় গেল। যাওয়ার সময় রাজলক্ষ্মী থেকে অনেক মিষ্টি কিনল। ভাবি বলল, তোমাকে এত মিষ্টি লাগছে দেখতে! টিংকু তুমি বেশ হ্যান্ডসাম, মাশাআল্লাহ।

বিয়ের দিনক্ষণ, প্ল্যান, প্রোগ্রাম কোনো কিছু যদিও আগে থেকে ঘুণাক্ষরেও জানতাম না তবুও বিয়ে-সংক্রান্ত সমস্ত দোষ আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে অল্প সময়ে টিংকু কথা বলে ইমপ্রেস করে ফেলল আমার ভাই-ভাবিকে। ভাইকে বলল, ‘আমার কোনো দোষ নেই, মুন্নি আপনাদের জানাতে নিষেধ করেছে।’

টিংকু চলে যাওয়ার পর ভাই আমার কাছে কৈফিয়ত চাইলেন, কেন তাদের আমি জানালাম না? আমি বললাম, আমার সবচেয়ে আদরের হচ্ছে অদিতা আর ঈশিতা (আমার দুই ভাইয়ের দুই মেয়ে, ওরা তখন অনেক ছোট)। ওরা যদি টিংকুর মতো কোনো পাত্রকে বিয়ে করতে চাইত আমি কিছুতেই রাজি হতাম না। কোন সাহসে এই বিয়ের প্রস্তাব দিতে বলব, তোমরা এই বিয়েতে কোনোদিন রাজি হতে না জানি আমি।

ঠিক হলো, রাজেন্দ্রপুরে আবার আমাদের বিয়ে হবে। নতুন করে কাবিন হবে দুই পরিবারের সবার উপস্থিতে। আমাদের পরিবারে উৎসবের আমেজ। ৭ অক্টোবর আমার গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান। যদিও আমার তিন মামার পরিবার-পরিজনসহ আমার দুই খালার ছেলে-মেয়েরাও সবাই ঢাকায় থাকে, কিন্তু ছোট মামার দুই কন্যার সঙ্গে আমার সখ্য বেশি। ওরা রাজেন্দ্রপুর চলে এসেছে আগেভাগেই। ছোট মামার ছোট মেয়ে জয়ী তখন ক্লাস সিক্সে পড়ে। ও বলল, মুন্নি আপু, আজ আমরা ব্যাচেলর নাইট করব। বড় কন্যা কলেজে পড়া লাবণীর অনুসন্ধিৎসু প্রশ্ন, ‘মুন্নি আপু, তুমি কি এখনো ব্যাচেলর আছ?’ আমি কিছু বললাম না। কেবল হাসলাম।

আম্মা তো ননস্টপ গালাগালের বন্যা ছুটিয়েই যাচ্ছেন। রাতে মেজো ভাই ডেকে বললেন, কাল তুমি শ্বশুরবাড়ি যাবে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে স্বচ্ছতা থাকা জরুরি। একবার বিশ্বাস হারালে তা আর কখনো ফেরত আসে না, স্বামীর সঙ্গে কখনো মিথ্যে বলবে না, আর কোনো কথা গোপনও করবে না।’

আম্মা বললেন, ‘স্বামীর কাছে অযথাই টাকা-পয়সা, জিনিসপত্র চাইতে নেই, এতে সম্মানহানি হয়। নিজের সম্মান বাঁচিয়ে চলার দায়িত্ব তোমার নিজের।’

আব্বা বললেন, ‘এত বড় মেয়ে। মাস্টার্স পাস করেছ। অথচ, সাহস করে বলতে পারলে না ওকে, তুমি বিয়ে করতে চাও।’

সবার কথার উত্তরে চুপ থেকে আমি কেবল মাথা নাড়ালাম। আমি জানি এই মুহূর্তে ওরা তিনজনই ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে, সেই সঙ্গে আমিও।

৮ অক্টোবর যখন পুনর্বার আমাদের বিয়ে হলো, মনে হলো এটা কোনো আনন্দ উৎসব নয়, আমার চল্লিশা হচ্ছে। সবার কান্না আর মন খারাপ দেখে আমি অধিক শোকে পাথর হয়ে কাঁদতে ভুলে গেলাম। নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হতে লাগল।

আজ বিয়ের দিন, আমি পরেছি লাল বেনারসি, সঙ্গে গা-ভর্তি গহনা। গলায় সীতাহার, চেইন লাগানো লম্বা কানের দুল, টিকলি আর মানতাশা আরেক হাত ভর্তি সোনার চুড়ি। এসবই আম্মার দেওয়া। মূলত, নানির গহনার নতুন সংস্করণ। অনেক আগে থেকেই আমার বিয়ের জন্য তৈরি করা হয়েছিল এলিফ্যান্ট রোডের জড়োয়া হাউস থেকে। টিংকুও দিয়েছে, আমার ভাইয়েরা আর মামারাও অনেক গহনা দিয়েছে, কাজিনরাও দিয়েছে।  কলাবাগানের ‘মে ফেয়ার’ বিউটিপারলার থেকে সেজে এসেছি। চাইনিজ এক মহিলার পারলার, সমস্ত মুখ ময়দার মতো সাদা করে সাজিয়েছে। তবুও আজ আমার খুশি লাগছে।

টিংকুকে দেখামাত্র সমস্ত শোক ভুলে নিমিষেই আনন্দিত হই আমি। কোনো পুরুষ বুঝি এতটা সুদর্শন হয়! হালকা ঘিয়ে কালার গরদের পাঞ্জাবির ওপর একটি লাল-সাদা তাজা ফুলের মালা। তাতেই আমার সারা জীবনের ক্রাশ অমিতাভ বচ্চন ফেল। কী ভীষণ সুদর্শন আর হ্যান্ডসাম দেখাচ্ছে আজ টিংকুকে!

                লেখক : মানবতাবাদী লেখিকা

সর্বশেষ খবর