মঙ্গলবার, ১৬ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

বাবার ২৩তম মৃত্যুবার্ষিকীতে সাইদুর বীরপ্রতীক চলে গেল

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

বাবার ২৩তম মৃত্যুবার্ষিকীতে সাইদুর বীরপ্রতীক চলে গেল

কোনো বিষয়ে সতর্ক এবং যত্ন নিলে কী হয় তার উজ্জ্বলতম প্রমাণ মারাত্মক ঘূর্ণিঝড় মোখা। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে চিন্তায় আমরা জেরবার হয়ে গিয়েছি। কিন্তু পরিশেষে মোখা আমাদের তেমন ক্ষয়ক্ষতি করতে পারেনি। কেন যেন আমার বারবার মনে হচ্ছিল ’৭০ এর প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে আমরা প্রায় ১২ লাখ মানব সন্তান এবং কয়েক লাখ পশুপাখি হারিয়ে ছিলাম। ঘূর্ণিঝড়ের ২-৩ দিন পর চীন সফর করে ঢাকা হয়ে ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানে গিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্গত এলাকায় চোখ বুলাননি। আর এবার সরকার, সরকারি যন্ত্র, অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবক প্রতিষ্ঠান সবাই উতলা। আর এ কারণে পরম দয়ালু আল্লাহ আমাদের যথেষ্ট দয়া করেছেন। এ জন্যে সরকার, সরকারি লোকজন এবং সরকারি দলের সবাইকে শুভ কামনা এবং অভিনন্দন জানাই। কিছু কিছু কাজে দলীয় সংকীর্ণ চিন্তার বাইরে আমাদের সার্বিক চিন্তা করা দরকার। আল্লাহ রাব্বুল আমিন আমাদের সব বিপদ থেকে রক্ষা করুন।

বাসাইল পৌরসভার মেয়র নির্বাচন বিষয়ে কথা বলতে দলীয় প্রতিনিধিদের নিয়ে আজ দুপুরে নির্বাচন কমিশনে যাব। নির্বাচন প্রভাব মুক্ত হবে, চুরি-চামারি হবে না, সাধারণ ভোটাররা ইচ্ছেমতো ভোট দিতে পারবে এমন নিশ্চয়তা পেলে এবং সে নিশ্চয়তা বিশ্বাসযোগ্য হলে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ বাসাইল পৌরসভা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। হাবিবুল আউয়াল নির্বাচন কমিশন গঠনের আগে মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের আহ্বানে রাষ্ট্রপতি ভবন বঙ্গভবনে গিয়েছিলাম। বঙ্গভবনের বারান্দায় গাড়ি থেকে নেমেই সেদিন হুইল চেয়ারের খোঁজ করেছিলাম। ২০২২ সালের ৯ জানুয়ারি গাড়ি থেকে নেমে দরবার হল পর্যন্ত যেতে হুইল চেয়ারের সত্যিই প্রয়োজন ছিল। সেদিন বঙ্গভবনে হুইল চেয়ার পাওয়া যায়নি। খুব কষ্ট করে ৭০-৮০ গজ হেঁটে গিয়েছিলাম। মহামান্য রাষ্ট্রপতি বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ জেলার মিঠামইনের মানুষ। বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীর একেবারে ঘনিষ্ঠ কর্মী। মানুষ হিসেবে মোটেই খারাপ না। তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান এক সময় কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সেহেতু তার ভালোকেও আমরা ভালোভাবে দেখতাম না। সবকিছু প্রতিদ্বন্দ্বীর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতাম। ফজলুর রহমান ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম নির্বাচনী এলাকা থেকে কখনো জয়ী হতে পারেননি। তিনি কিশোরগঞ্জ থেকে একবার জয়ী হয়েছিলেন। সংসদে মোটামুটি ভালোই করেছিলেন। কিন্তু তারপর আর তেমন কিছু হয়নি। ওয়ান-ইলেভেনের সময় তিনি আমাদের দল ছেড়ে বিএনপিতে যোগদান করেন। সত্যিকার অর্থে আমি এখনো বুঝতে পারি না তিনি কী করে সভা-সমাবেশে জিয়াউর রহমানকে নেতা মেনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা বা অবদানকে ছোট করে বক্তৃতা বা কথা বলেন। ’৯৯ সালের ২৪ জানুয়ারি অনেক অমিলের প্রতিকারে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ গঠন করেছিলাম। আমাদের মার্কা গামছা দেওয়া হয়নি, ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল। তারপর অনেক সংগ্রাম শেষে নির্বাচন কমিশন প্রতীক হিসেবে গামছা অন্তর্ভুক্ত করে। গামছা নিয়ে নির্বাচন করেছি, সংসদে গেছি, সাধ্যমতো সংসদে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছি। হাবিবুল আউয়াল কমিশন গঠনের আগে ৯ জানুয়ারি ২০২২ যেদিন বঙ্গভবনে গিয়েছিলাম। সেদিন মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ পরম মমতায় দুই হাত চেপে ধরে বলেছিলেন, ‘ভাই আগামী এপ্রিলে কার্যকাল শেষ। দোয়া করবেন যাতে সম্মান নিয়ে যেতে পারি। মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ গত ২৪ এপ্রিল সম্মানের সঙ্গেই বঙ্গভবন ত্যাগ করে নিকুঞ্জে তার ৩ কাঠার নিজের বাড়িতে উঠেছেন। ১০ বছর ছিলেন ৩-৪ হাজার কাঠার বাড়িতে। রাজনৈতিক মানুষ ৩ কাঠার বাড়িতেও তার যে কষ্ট হবে না সেটা বুঝতে পারি। এই সেদিন ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে গিয়েছিলাম। সর্বশেষ গিয়েছিলাম নতুন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের শপথ গ্রহণ এবং জনাব আবদুল হামিদের বিদায় অনুষ্ঠানে। শপথ শেষে অতিথিদের আপ্যায়ন করা হচ্ছিল। আমিও গিয়েছিলাম। সেদিনও সাবেক রাষ্ট্রপতি আগের মতোই হাত চেপে ধরে বলেছিলেন, ‘শুনেছি আপনি সেদিন এসেছিলেন। কথা হয়নি। সম্ভব হলে আমার বাড়ি আসবেন। অনেক কথা পড়ে আছে।’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও কথা হয়েছিল। ছোটবোন রেহানা ছিল উল্টোদিকে। যে কমিশন গঠনে আমরা পরামর্শ দিয়েছিলাম সেই কমিশনের একটি নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করতে যাচ্ছি। আশা করি আলোচনা ফলপ্রসূ হবে। তা যদি না হয় ছোটখাটো দু-একটি নির্বাচনই যদি নির্বাচন কমিশন সুন্দরভাবে পরিচালনা করতে না পারেন তাহলে সামনে জাতীয় নির্বাচন, তার কী উপায় হবে? সে জন্যে দেখে আসি কথা বলে আসি কতটা কী হয়।

১৩ মে ছিল আমাদের বাবা মৌলভী মুহাম্মদ আবদুল আলী সিদ্দিকীর ২৩তম মৃত্যুবার্ষিকী। মনে হয় সেদিন বাবা-মার মাঝে বসে কথা বলছিলাম। হঠাৎই বাবা মোহাম্মদপুরের বাড়িতে এসেছিলেন। আমি তখন সংসদে। ফোন পেয়ে ছুটে এসেছিলাম। কারণ বাবার ডাকে দেরি করার কোনো উপায় ছিল না। একেবারে মিলিটারি শাসনের মতো। তাই দেরি করিনি। বাবার মেজাজ মর্জি আমাদের কাছে ছিল পানির মতো পরিষ্কার। আগে অল্প বয়সে একটু আধটু না বুঝে এদিক ওদিক করলেও বয়স যত বেড়েছে তত বাবাকে চিনেছি আর সোজা হয়ে বাবার কথা শোনার চেষ্টা করেছি। মোহাম্মদপুরের বাড়িতে এসে দেখি বাবা-মা একই সোফায় বসে আছেন। আমি এলে আমাকে মাঝে বসিয়ে ছিলেন। কত কথা। অধ্যাপক মোদাচ্ছের ভাই বাবাকে দেখাশোনা করতেন। সেদিন কেন যেন বলেছিলেন বাবার চোখ যা আছে তা থেকে খারাপ হতে পারে। কিন্তু আর তেমন ভালো হবে না। মোদাচ্ছের ভাই খুবই ভালো মানুষ। আমাকে আপন ভাইয়ের মতো ভালোবাসেন, সম্মানও করেন যথেষ্ট। বাবার চিকিৎসায় তার বিন্দুমাত্র খাত ছিল না। কিন্তু তারপরও যে চোখের আর উন্নতি হবে না কেন বলেছিলেন বুঝতে পারিনি। কথাটা শুনে বাবা বড় ভেঙে পড়েছিলেন। আমাকে ধরে বলেছিলেন, ‘বজ্র, চোখ না থাকলে কোনো কিছু দেখতে না পেলে বেঁচে থেকে লাভ কী?’            ৫-৭ বছর আগে ছানির কারণে তেমন দেখতে পেতেন না। কিন্তু অপারেশন করে চোখ অনেকটা ভালো হয়ে গেলে তিনি খুব সবলবোধ করছিলেন। সেই চোখ সামান্য একটু খারাপ হওয়ায় তিনি একেবারে ভেঙে পড়েন। সন্ধ্যার দিকে বাবা টাঙ্গাইল চলে যান। পরদিন অন্যদিনের মতো কোর্টে যান, ফিরে আসেন। রাত সাড়ে ১০-১১টায় বুকে ব্যথা অনুভব করেন। নিয়ে যাওয়া হয় টাঙ্গাইল সদর হাসপাতালে। আমি বেশ কয়েকবার টাঙ্গাইল যেতে চেয়েছিলাম। বাবাই বলেছিলেন, ‘তোকে আসতে হবে না। একটু ভালো লাগলে বাসায় ফিরে যাব।’ রাত ২টায় বেগম সাহেব ডেকে তোলেন। বাবার শরীর আরও খারাপ হয়েছে, আমাকে টাঙ্গাইল যেতে হবে। আমি তখনই টাঙ্গাইল রওনা হই। মাসহ দীপ-কুঁড়িকে নিয়ে নাসরীন রওনা হয়েছিল একটু পর। ঢাকা থেকে সরাসরি টাঙ্গাইল সদর হাসপাতালে গিয়েছিলাম। আমাকে দেখে কয়েকজন ডাক্তার, নার্স, হাসপাতালের কর্মকর্তা কর্মচারী ছুটে এসেছিল। তাদের বলেছিলাম, বাবা কোথায়? তারা আমতা আমতা করে বলছিল বাড়ি চলে গেছেন। আকুর টাকুর পাড়ার বাসায় বাবাকে বারান্দায় উত্তরমুখী পড়ে থাকতে দেখি। কয়েকজন কোরআন পড়ছিল। আমি গিয়ে বাবার মাথার কাছে বসেছিলাম। একটানা প্রায় ৪ ঘণ্টা। তারপর বসেছিলাম পায়ের কাছে। তারপর গোসল করানো হয়। ছেলেবেলায় আমি যে স্কুলে পড়েছি টাঙ্গাইল পিটিআই ইনস্টিটিউট, সে স্কুল মাঠে বাবার নামাজে জানাজা হয়। এরপর লাশ নিয়ে যাওয়া হয় তার জন্মভূমি ছাতিহাটিতে। সেখানেও জানাজা হয়। সন্ধ্যার একটু আগে বাবাকে কবর দেওয়া হয়। ১৩ মে আমাদের ছেড়ে তিনি চলে গেছেন। সবাই একদিন চলে যাব। দুনিয়ায় আসা যাওয়াই হচ্ছে আসল। এলে যেতে হবে। এ থেকে পালাবার বা সরে যাওয়ার কোনো পথ নেই। বাবার মৃত্যু একটা যুগের অবসান। আমার দাদু আলাউদ্দিন সিদ্দিকী মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে রাজনীতি করতেন। একেবারে অসময় চলে গিয়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে আমাদের সোনার সংসার কেমন যেন অগোছালো হয়ে পড়েছিল। তখন আমরা যেমন না খেয়ে থাকিনি ঠিক তেমনি কোনো প্রাচুর্যও ছিল না। বাবা ছিলেন ছোট। কত আর হবে           ২৫-২৬ বছর। সেই সময় তিনি এক বা দুই সন্তানের পিতা। এরপর ধীরে ধীরে আমাদের অবস্থা ফিরতে থাকে। বাবা কোর্টে গেলে প্রচুর পয়সা পান, না গেলে কিছুই না। ’৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ’ল জারি করেন। ’৬২ সাল থেকে কেন যেন আমাদের ওপর একের পর এক সামরিক খড়গ নেমে আসে। বড় ভাই তখন ছাত্র রাজনীতিতে পুরোপুরি সম্পৃক্ত। সারা দেশে বক্তৃতা করে বেড়ান, আইয়ুব-মোনায়েমের পিন্ডি চটকান। জিএম কাদরী বলে এক এসডিও আমাদের শেষ করে দিতে চেষ্টা করেন। বাবা গ্রেফতার হন, বড় ভাই গ্রেফতার হন। সংসার কেমন যেন অচল হয়ে যায়। প্রচুর জমিজমা থাকার পরও কৃষি কাজে অভিজ্ঞতা না থাকায় খুব কষ্ট করতে হয়। ছেলেবেলায় আমাদের তেমন লোভ ছিল না। তাই কষ্ট হলেও আমরা ধৈর্য ধরতে পেরেছি। যে কারণে টিকে থেকেছি। এরপর এক সময় আইয়ুব খান-মোনায়েম খান বিদায় হন। এরপর আসে মুক্তিযুদ্ধ। পুরো পরিবারের অনিশ্চয়তা। ছোট ছোট ভাইবোনগুলো নিয়ে মা-বাবা কী যে কষ্ট করেছেন তা আমার পক্ষে লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। আগস্টে গুলিবিদ্ধ হলে আমাদের পরিবার দুই টুকরা করা হয়। মা এবং ছোট ছোট ভাইবোনকে ঢাকার নারিন্দায় সারাহ খালার কাছে পাঠানো হয়। সেই সময় কাদেরিয়া বাহিনীর ডাক্তার শাহজাদা চৌধুরীর শ্বশুর বাড়িতে রহিমা-শুশু-শাহানা-আজাদ-মুরাদকে মার সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় পাঠিয়ে ছিলাম। বাবা ছিলেন আসামের মানকার চরে বাবুল-বেলালকে নিয়ে। বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী তখন কখনো কলকাতা কখনো আবার তুরা মানকারচর ছোটাছুটি করছিলেন। আল্লাহর অসীম দয়ায় স্বাধীনতার পর আমরা সবাই একত্র হয়েছিলাম। একটা সুখের স্বাদ পেয়েছিলাম। কিন্তু সেটা স্থায়ী হয়নি। বঙ্গবন্ধুর আকস্মিক মৃত্যু আমাদের আবার রাস্তায় ফেলে দেয়। ১৬ বছর নির্বাসনে কেটে যায়।

সাইদুর রহমান বীরপ্রতীক একজন মহান মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে অনেকেই যোগদান করেছে, আশাতীত অবদান রেখেছে। কিন্তু সাইদুর রহমান বীরপ্রতীক সবার থেকে আলাদা। ’৬৭-’৬৮-তে সাইদুর সাদৎ কলেজে পড়ত। সেই থেকে ওর সঙ্গে পরিচয়। এ ছাড়া কালিহাতী ছাত্রকর্মী হিসেবে সাইদুর, লালমিয়া, হুমায়ুন, কালাম এরা ছিল লতিফ ভাইর সব তরুণ তুর্কি। রাতদিন নাই কোথাও সভা-সমাবেশ হলেই হলো। যদিও ’৬৭-’৬৯ এর ২২ ফেব্রুয়ারি পুরোটা সময় লতিফ ভাই জেলে ছিলেন। টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ-ঢাকা সেন্ট্রাল জেল মিলিয়ে সেবারই সবথেকে বেশি সময় একটানা জেল খেটেছেন। ৩ এপ্রিল জ্বালাও পোড়াও হত্যা করতে পাকিস্তান হানাদাররা টাঙ্গাইলে প্রবেশ করলে এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়। শহরের ৯০ ভাগ মানুষ বাড়িঘর, দোকানপাট, অফিস আদালত ছেড়ে দিগবিদিক জ্ঞানহীন হয়ে গ্রামের দিকে পালিয়ে যায়। আমরাও পুলিশের কিছু অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে গ্রামের দিকে পালাই। আমার সঙ্গে তখন দুই ফারুক- একটা কালো, আরেকটা সাদা। একজনের বাড়ি সিলেট, আরেকজনের বাড়ি ঘাটাইলের রতনপুর। সিলেটের ফারুক হেংলা পাতলা ছোটখাটো, ঘাটাইলের ফারুক একটু বড়সড়। কিন্তু ঘাটাইলের ফারুক শেষ পর্যন্ত আমার সঙ্গে বা মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে টিকে থাকতে পারেনি। অথচ ছোটখাটো হেংলা পাতলা সিলেটের ফারুক পুরো সময় আঠার মতো লেগে ছিল। যখন যে কাজ তাকে দেওয়া হয়েছে নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছে। ৩ এপ্রিলের পর লতিফ ভাইর নেতৃত্বে ইপিআরদের নিয়ে ১৯ এপ্রিল কালিহাতী হামিদপুরে একটা যুদ্ধ হয়েছিল। সেটাকে যুদ্ধ না বলাই ভালো। তবে গোলাগুলি হয়েছিল। হঠাৎ করে গুলি চলায় বেশ কিছু হানাদার নিহত হয়েছিল। সঙ্গে আমাদের লোকজনও ১৪-১৫ জন শহীদ হয়। হামিদপুর থেকে একেবারে নিঃস্ব রিক্ত কপর্দকহীন সম্পূর্ণ একা ২-৪ দিন পর ফিরেছিলাম। তারপর আবার ফারুককে পাই। চর-ভর ঘুরে ফিরে ছাতিহাটি গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলাম। সেখানে কমান্ডার মনিরের সঙ্গে দেখা হয়। ফারুককে নিয়ে মনিরের সঙ্গে অস্ত্র উদ্ধারে গিয়েছিলাম। সেই সময় সাইদুরকে একটা চিঠি দিয়েছিলাম। চিঠি নিয়ে গিয়েছিল মোহাম্মদ দাদার ছেলে রাঙ্গা সিদ্দিকী। চিঠি পেয়ে ৪-৫ জন নিয়ে সাইদুর পাগলের মতো ছুটে এসেছিল। কালিহাতীর পাহাড়কাছরা মরিচাতে তার সঙ্গে দেখা। সেই যে মুক্তিযুদ্ধে শরিক হয়েছিল কত ঝড় তুফান গেছে সাইদুর আমাকে ছাড়েনি, আমিও সাইদুরকে কখনো ভুলতে পারিনি। সব বিপদে আপদে হিমালয়ের মতো স্থির হয়ে পাশে থেকেছে। যুদ্ধের শেষের দিকে সে একজন কোম্পানি কমান্ডারও হয়েছিল। কোম্পানি কমান্ডার হওয়ার পর দেড়-দুই মাস যুদ্ধ চলেছিল। যুদ্ধ আরও অনেকদিন হলে জার্মান জেনারেল রোমেলের মতো দুর্ধর্ষ হতো কি না বলতে পারি না। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে তার দুর্দান্ত সাহসিকতার জন্যে সাইদুর রহমান বীরপ্রতীক খেতাব পেয়েছিল। ’৭৫ এ ঘাতকেরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলে তার প্রতিবাদ প্রতিরোধ যুদ্ধেও সাইদুর শরিক হয়েছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের দীপঙ্কর প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নিলে তার নাম মনে থাকত না বলে রাজা রেখেছিলাম। সাইদুরের নাম রাখা হয়েছিল মহারাজা। সে হিসেবেই ওরা পরিচিত ছিল। কত কী যে কষ্ট করেছে। একদিনের খাবার তিন দিনে খেয়েছে, মাইলকে মাইল হেঁটে চলেছে। কিন্তু কখনো হার মানেনি। সেই সাইদুর গত ১৩ মে শনিবার আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। ওর এক ছেলে লে. কর্নেল মাহাবুবুর রহমান সোহেলের কারণে ঢাকা সিএমএইচে কয়েকদিন চিকিৎসা পেয়েছে। কিন্তু সে বাঁচেনি। গত ১৭ ডিসেম্বর আলাউদ্দিন সিদ্দিকী মহাবিদ্যালয়ের ছিল সুবর্ণজয়ন্তী। সেখানেও গিয়েছিলাম। যাওয়ার পথে কামার্থী থেকে মহারাজা সাইদুরকে আউলিয়াবাদ নিয়ে গিয়েছিলাম। বড় অস্বস্তিবোধ করছিল, অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছিল। বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী এবং আমাকে পিতার মতো সম্মান করত। কিন্তু সেদিন তার সম্মানের লেশমাত্র ছিল না। মনে হচ্ছিল আমাদের কাউকেই সে চিনতে পারেনি। তাই সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি দিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলাম। সেই সাইদুরের সঙ্গে শেষ দেখা আর দেখা হলো না। ওর আগে একবার কামার্থীতে ওকে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ রাস্তার পাশে বসে গল্প করেছিলাম। সেই ছিল সাইদুর রহমান বীরপ্রতীকের সঙ্গে রাস্তার পাশে বসে শেষ কথাবার্তা, শেষ আলোচনা। মুক্তিযোদ্ধা অনেকেই হয়েছে। কিন্তু একেবারে শুরুতে সাইদুর বীরপ্রতীক হিমাদ্রীর মতো আমার পাশে এসে না দাঁড়ালে আমি হয়তো কাদেরিয়া বাহিনী গঠন করতে পারতাম না। সাইদুরের অবদানের কথা বলে শেষ করা যাবে না। অনেক অনেক যোদ্ধা বা কমান্ডারদের অনেক অনেক ভূমিকা আছে। সবুর খান বীরবিক্রম, হাবিবুর রহমান বীরবিক্রম, আবুল কালাম আজাদ বীরবিক্রম, আবদুল গফুর বীরপ্রতীক, আবদুল হাকিম বীরপ্রতীক, আনিস বীরপ্রতীক, আবদুল্লাহ বীরপ্রতীক এ রকম আরও অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা থাকতেও মহারাজা সাইদুর ছিল ওদের সবার মধ্যে এক ব্যতিক্রম। সে সাইদুর বাবার মৃত্যুদিনে দুনিয়া থেকে চলে গেল। আল্লাহ ওকে বেহেশতবাসী করুন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারকে এই শোক সইবার শক্তি দিন- আমিন।

লেখক : রাজনীতিক।

www.ksjleague.com

সর্বশেষ খবর