রবিবার, ২১ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

খুনি বেইমানদের শেষ পরিণতি কী হয়?

নঈম নিজাম

খুনি বেইমানদের শেষ পরিণতি কী হয়?

রাষ্ট্রক্ষমতায় ষড়যন্ত্র কারা করে? দূর ও আড়ালের মানুষ চক্রান্তের সুযোগ পায় না। আপনজনেরাই নীরবে চক্রান্ত করে। যিনি এখন আপন কাল তিনিই নিজের স্বার্থের জন্য হয়ে ওঠে ভয়াবহ। নিজের রূপ বদলাতে সময় নেয় না কেউ। সারা জীবন কারও জন্য করলেন, ভাবলেন তিনি আপনার সঙ্গে থাকবেন, ভুল করছেন। শতবার উপকার করার পর একবার কিছু না করার খেসারত আপনাকে দিতে হবে।

ইতিহাসে জুলিয়াস সিজারের অবস্থান দেশ জয়ের নায়ক হিসেবে।  সময়টা খ্রিস্টপূর্ব ৪৪ সালের ১৫ মার্চ। শাসক হিসেবে সিজার সেনাবাহিনী ও মানুষকে জয় করেছিলেন। তাঁর সহযোগী রাজনীতিবিদরা দেখলেন সিজারকে আর সরানো যাবে না। মানুষ সিজারের পক্ষে। সেনারাও সমর্থন দিচ্ছে। সিজার দেশ জয় করছেন, আর সেনাদের সুবিধা বাড়াচ্ছেন। সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন নিজের মতো। সিনেটকে জানাচ্ছেন না কিছু। তারা ভাবলেন তাদের অবজ্ঞা করা হচ্ছে। পাত্তা দেওয়া হচ্ছে না রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে। তারা ক্ষুব্ধ হলেন। পরিকল্পনা নিলেন সিজারকে উচ্ছেদের। বুঝলেন যেনতেনভাবে সিজারকে বিদায় করা যাবে না। খুনির সন্ধান করলেন। কোনো খুনি পেলেন না সিজারকে হত্যা করার। প্রজারা বলল, সিজার আমাদের গর্ব। সেনাবাহিনী বলল, সিজার আমাদের জন্য অনেক করেছেন। এমন পরিস্থিতিতে সিনেটের একটি অধিবেশনে যোগ দিতে যান জুলিয়াস সিজার। এ সুযোগ কাজে লাগান সিনেটররা। তারা তাকে ঘিরে ধরেন।

দেশ পরিচালনা নিয়ে তারা সিজারের সমালোচনা ও গালাগাল শুরু করলেন। হঠাৎ সিজার খেয়াল করলেন সিনেটরদের হাতে ধারালো ছুরি; যা তারা আগে থেকে বহন করে নিয়ে এসেছিলেন। গণতন্ত্রের পবিত্র স্থান সিনেটের ভিতরে এমন কান্ডে বিস্মিত হন একনায়ক জুলিয়াস সিজার। পবিত্রতা ক্ষুণœ হবে বলে নিজের নিরাপত্তারক্ষীদের সিনেটের ভিতরে আনেননি। অথচ এখানে সিনেটররাই ছুরি, তলোয়ার নিয়ে এসেছেন। সিজার কারও কটু কথার জবাব দিলেন না। তিনি চারদিকে তাকালেন। দেখলেন ছুরি নিয়ে ২০-২৫ জন সিনেটর ঝাঁপিয়ে পড়ছেন তাঁর ওপর। তারা সিজারকে ক্ষতবিক্ষত করছেন। ২৩ বার ছুরিকাঘাতে সিজারের দেহ ছিন্নভিন্ন হয়। ছিঁড়ে ফেলা হয় সিজারের বিশেষ পোশাক। মৃত্যুর মুখোমুখি জুলিয়াস সিজার চারদিকে আপনজন কাউকে খুঁজলেন। অবাক নয়নে দেখলেন, হামলাকারীদের মধ্যে ব্রুটাসও আছেন। তার হাতেও ছুরি। প্রথম ভাবলেন ভুল দেখছেন। ব্রুটাস কী করে খুনিদের সঙ্গে থাকেন? এই ব্রুটাসের সঙ্গে কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। কত গল্প, আড্ডা রয়েছে লুকিয়ে। ব্রুটাস ছুরি হাতে! ব্রুটাস কি রক্ষা করতে এগিয়ে এসেছেন? খেয়াল করলেন, রক্ষা নয়, খুনিদের সঙ্গেই আছেন ব্রুটাস! দুঃখভারাক্রান্ত বদনে রক্তাক্ত জুলিয়াস সিজার বললেন, ব্রুটাস তুমিও! তুমিও! তুমিও! তারপর মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। রক্তে রঞ্জিত হয়ে ওঠে সিনেট ভবনের মেঝে। সিনেটরের বেশে থাকা খুনিরা বুঝতে পারল সিজার শেষ। তারা চিৎকার করতে থাকে সিজার শেষ। জনতার জয় হয়েছে। তাদের হাতে রক্তাক্ত ছুরি! সেই ছুরি উঁচিয়ে তারা সিনেট থেকে বের হতে থাকেন, আর বলতে থাকেন, স্বৈরশাসককে সরিয়েছি। বিশ্ব দেখ আমরা মুক্তিদাতা। সিনেট ভবনের বাইরে আগে থেকে পরিকল্পনামতো নাগরিকদের জড়ো করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল সিজারকে নিয়ে একটা ঘোষণা আসবে। কী ঘোষণা জনতা জানত না। তারা অপেক্ষায় ছিল। হঠাৎ জনতা খেয়াল করল রক্তাক্ত ছোরা হাতে সিনেটররা বের হচ্ছেন। তারা উল্লাস করে বলছেন, সিজার শেষ। জড়ো হওয়া মানুষ বিস্মিত হয়। ব্যথিত হয়। ক্ষুব্ধ হয়। তারা সেখানেই প্রতিবাদ জানায়। সিজারের মৃত্যুর তীব্র প্রতিবাদে ভয়ংকর গৃহযুদ্ধ শুরু হয় রোমে। খুনিদের বিচার করতে বাধ্য হয় পরবর্তী শাসক।

দ্য লাইভস অব দ্য টুয়েলভ সিজারস নামে একটি বই লিখেছিলেন রোমান লেখক গাইডস সুতোনিয়াস ট্রানকুইললাস। এ বইতে তিনি লিখেছেন, সিজারের খুনিদের পরিণতি হয়েছিল ভয়াবহ। জনতার দাবির মুখে খুনি সিনেটরদের বিচারের মুখোমুখি হতে হয়। সবাইকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা হয়। খুনিদের একজনের পরিণতিও ভালো হয়নি। তারা বিভিন্ন অপঘাতে মারা পড়েন। কেউ মারা যান জাহাজের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে, কেউ যুদ্ধে। মূল খুনি যে ছুরি দিয়ে সিজারকে হত্যা করেছিলেন, নিজে সেটি দিয়েই আত্মহত্যা করেন। খুন ও খুনিকে প্রকৃতি সহ্য করে না। বিশ্বাসঘাতকদের ঠাঁই দেয় সমাজের নিকৃষ্ট স্থানে। তার পরও ইতিহাস ভুল করে। খুনিরা, বিশ্বাসঘাতকরা তাদের অবস্থান থেকে সরতে পারে না। প্রকৃতি হয়তো এমনভাবেই সবকিছু তৈরি করেছে।

বাংলার শেষ নবাব ছিলেন সিরাজউদ্দৌলা। তাঁকে পরাজিত করেই ব্রিটিশরা এ দেশ দখলে নিয়েছিল। সিরাজউদ্দৌলা একবারও ভাবতে পারেননি তাঁর সহযোদ্ধারা বেইমানি করবেন। প্রকাশ্যে অবস্থান নেবেন দখলদারদের পক্ষে। বাংলা-বিহার-ওড়িশার স্বাধীনতা তুলে দেবেন বিদেশি বণিকদের হাতে। একটা ব্যবসায়ী কোম্পানি দখলে নেবে এ দেশ। শেষ আকুতি নিয়ে তিনি সবাইকে অনুরোধ করেছিলেন বাংলার স্বাধীনতা রক্ষা করতে। সিরাজের সেই আহ্বানে কেউ সাড়া দেননি। তাঁর পাশে দাঁড়াননি মন্ত্রী, আমলা, পারিষদ। ইংরেজ বেনিয়া ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জয় হয়। বিদেশি বেনিয়ারা ক্ষমতার দখল নিয়ে প্রথমেই বেইমান মীর জাফর আলীকে ক্ষমতায় বসায়। সেই ক্ষমতার মেয়াদ বেশিদিন ছিল না। অযোগ্য, মিথ্যুক বেইমান মীর জাফর দায়িত্ব নিয়ে সিরাজউদ্দৌলাকে আটক করেন। মীর জাফরপুত্র মিরন পরিকল্পনা আঁটেন সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যার। তার সহযোগী মোহাম্মদী বেগকে এ দায়িত্ব দেন। দলবল নিয়ে মিরন যখন সিরাজউদ্দৌলার সামনে যান তিনি বুঝে ফেলেন কী ঘটতে যাচ্ছে। তিনি অনুরোধ করেন তাঁকে নামাজের অজুর সুযোগ দিতে। মোহাম্মদী বেগ সেই সুযোগ দেননি। তিনি পানি পানের অনুমতি চান। তা-ও পাননি। ছুরি দিয়ে আঘাত করেন মোহাম্মদী বেগ। তার সঙ্গীদের হাতে ছিল তলোয়ার। তারাও হামলা করলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে সিরাজের রক্তে লাল হয়ে উঠল মেঝে। এই যেন উইলিয়াম শেকসপিয়রের আরেক জুলিয়াস সিজারের হত্যার উৎসব।

খুনিদের উল্লাসনৃত্য অন্ধকার কুঠরি ছাড়িয়ে বেরিয়ে আসে রাজপথে। তারা সিরাজের রক্তাক্ত দেহ হাতির পিঠে চড়িয়ে বেরিয়ে আসে রাস্তায়। নিষ্ঠুরতার চূড়ান্ত পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে সিরাজের রক্তাক্ত দেহ মুর্শিদাবাদের অলিগলি ঘোরায়। খুনিদের নিষ্ঠুরতায় সাধারণ মানুষ নীরবে ডুকরে কেঁদে উঠলেও কেউ প্রতিক্রিয়া দেখানোর সাহস পায়নি। কেউ বলতে পারেনি, তোমরা এত ভয়াবহ আচরণ নবাব আলীবর্দি খানের নাতির সঙ্গে করতে পারো না। সিরাজকে হত্যার মধ্য দিয়ে খুনিরা থামল না। তারা সিরাজের পরিবারের নারীদের মাঝনদীতে নিয়ে চুবিয়ে হত্যা করে। বাদ পড়েনি শিশুরাও। এ সময় নারী ও শিশুদের আর্তচিৎকারে কেঁপে ওঠে সূর্যের শেষ বেলার আলোকরশ্মি। ধীরে ধীরে চারপাশ অন্ধকারে তলিয়ে যায়।

প্রকৃতি বলে একটা কথা থাকে। সিরাজউদ্দৌলার খুনিদের পরিণতিও ভালো হয়নি। বেইমান বিশ্বাসঘাতকদের একজনও ভালো থাকেনি। এ নিয়ে সৈয়দ গুলাম হুসাইন খান ও সুদীপ চক্রবর্তী লিখে গেছেন। বেইমান-বিশ্বাসঘাতকরা প্রকৃতির আদালতের বিচারে নিষ্ঠুর পরিণতির মুখোমুখি হয়। রেহাই পায়নি একজনও। শুধু এদেশীয় নয়, ইংরেজ খুনিদেরও পরিণতি হয়েছিল করুণ। বেইমান-বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর মরেছেন কুষ্ঠরোগে। আরেক বেইমান মীর কাশিম অনাহারে মরেছেন দিল্লির রাস্তায়। বজ্রাঘাতে মারা যান মিরন। ঘসেটি বেগমের করুণ মৃত্যু হয় পানিতে ডুবে সিরাজ পরিবারের সঙ্গে। মীর জাফর তাকে রক্ষা করেননি। সিরাজের খুনি মোহাম্মদী বেগ পাগল হয়ে যান। জীবনের শেষ দিনগুলোতে দিশাহারার মতো ঘুরতেন রাস্তায় রাস্তায়। পরে কুয়োয় ঝাঁপ দেন। এভাবেই তার মৃত্যু হয়। তরাইয়ের পাহাড়ে গিয়েছিলেন আরেক বেইমান খাদেম হোসেন। হুট করে খাবার সংকটে পড়েন। প্রকৃতির বিরূপতায় খাবার সংগ্রহের কোনো সুযোগ ছিল না। না খেয়ে মৃত্যু হয় তার।

নবাবের সঙ্গে বেইমানি করেছিলেন মহারাজ নন্দকুমার। নিয়েছিলেন ইংরেজ বেনিয়াদের পক্ষ। সেই বেনিয়াদের আদালতে তার ফাঁসি হয়। মামলাটি ছিল ষড়যন্ত্রমূলক। নিজেকে রক্ষা করতে পারেননি তিনি। গঙ্গায় ডুবে মারা যান ইংরেজ বণিক আর মীর জাফরের দুই সহযোগী জগৎশেঠ, স্বরূপ চাঁদ। বিভিন্ন অভিযোগে আটক হয়েছিলেন উমি চাঁদ। কারাগারের ভিতরেই তিনি করুণভাবে মারা যান। কৃষ্ণচন্দ্র পুত্রকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন মুঙ্গের দুর্গে। সেখানেই বাপ-বেটার মৃত্যু হয় না খেতে পেরে। রামনারায়ণ, রাজবল্লভ, কৃষ্ণ দাসকে গঙ্গার স্রোতে নিক্ষেপ করলে সেখানে তাদের মৃত্যু হয়। ইয়ার লতিফ গোপন হত্যার শিকার হন। দানা শাহ মরেন বিষাক্ত সাপের কামড়ে। টেরাউ আত্মহত্যা করেন। খোঁজা ওয়াইজ আত্মহত্যা করেন বিষ খেয়ে। এ ঘটনায় জড়িত ইংরেজদের পরিণতিও ভালো ছিল না। রবার্ট ক্লাইভ নিজের দেশে ফিরে বিচারের মুখোমুখি হন চুরির দায়ে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল বাংলা থেকে লুটে নেওয়া বিশাল সম্পদ আত্মসাৎ করার। তিনি রাষ্ট্রীয় কোষাগারে সব সম্পদ জমা দেননি। অনেক অর্থ চুরি করেছেন। নিজে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হয়েছেন। চুরির দায়ে ক্লাইভ বিচারের মুখোমুখি হন। ক্লাইভের শেষ দিনগুলো ছিল করুণ। মানুষের ঘৃণার মুখে তিনি আত্মহত্যা করেন। মনোরোগে আক্রান্ত হন আরেক নিষ্ঠুর ইংরেজ ওয়াটস। ইংরেজরা মনোরোগ বললেও সোজা বাংলায় বলতে হয় তিনি পাগল হয়ে যান। আর মহামারিতে মারা যান ওয়াটসন। বাংলা দখলের আরেক খলনায়ক স্কাফটন মারা যান জাহাজে ডুবে।

নবাব সিরাজের অনেক আগে বাংলায় আসেন ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজি। তার বাংলা জয় নিয়ে কেবল মিথ শুনি। একবারও আলোচনা করি না তার শেষ পরিণতি নিয়ে। আফগানে বসবাস করা জাতিতে তুর্কি পেশায় ভাগ্যান্বেষী সৈনিক ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজি বাংলা বিজয় দিয়েই ইতিহাসে খ্যাত। বাংলা, বিহার বিজয় তার মাঝে কনফিডেন্স বাড়িয়ে দেয়। নদিয়া অভিযানের সময় ঝাড়খন্ডের জঙ্গল ও পাহাড়ি পথ দিয়ে তিনি দ্রুতবেগে ঘোড়া চালিয়ে আসেন। ইতিহাসে আছে, খিলজির সহযোদ্ধারা তার সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি। কারণ ছিল খিলজি খুব দ্রুত ঘোড়া চালাচ্ছিলেন। মাত্র ১৭ জন সৈন্য তার সঙ্গে আসতে পেরেছিল। বাংলার শাসক লক্ষ্মণ সেনের দ্বাররক্ষীদের হত্যা করে প্রাসাদে প্রবেশ করেন খিলজি। পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যান লক্ষ্মণ সেন। তিনি নদীপথে আশ্রয় নেন বিক্রমপুরে।

বাংলা জয়ের কনফিডেন্স থেকে লখনৌ জয় করেন। তারপর তিব্বত অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন খিলজি। তুর্কিস্তান ছিল তার আদি বাড়ি। তিব্বত হাতে এলে তুর্কিস্তানের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হবে। সেই যুদ্ধে খিলজি শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন। পথে পথে তার সৈন্যরা নাস্তানাবুদ হয়। ভয়াবহ পরাজয়ের গ্লানি যোগ হয় তার শরীর ও মনে। তিনি ফিরে আসেন বাংলায়। ভাবলেন তার প্রদেশগুলোর শাসন ক্ষমতায় নিজের লোকেরাই আছে। তারা তাকে দেখেশুনে রাখবেন। কোনো সমস্যা হবে না। আপনজনদের হাতেই তার করুণ মৃত্যু হয় ১২০৬ সালে। ইতিহাসবিদ মিনহাজ উদ্দিন সিরাজের তবকাৎ ই নাসিরি গ্রন্থ থেকে জানা যায়, তার মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না। তাকে হত্যা করা হয়। আলি মর্দান খিলজি তাকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করেন। পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাটের গঙ্গারামপুর থানার পীরপালে তার সমাধি এখনো রয়েছে। মৃত্যুর আগে বখতিয়ার খিলজি বিস্মিত হয়েছিলেন। ভাবতেও পারেননি তাকে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হবে নিজের দখলকৃত প্রদেশে। লক্ষ্মণ সেনকে পরাজিত করে দখলকৃত প্রদেশগুলোর ক্ষমতাভার তিনি সেনাপতিদের দিয়েছিলেন। সুবেদার আউলিয়া খাঁ ছিলেন পূর্ববঙ্গে বর্তমান বাংলাদেশের দায়িত্বে। আলি মর্দান খিলজি বরসৌল হুসাম উদ্দিন উওজ খিলজি গঙ্গাতীরের শাসনকর্তা ছিলেন। বখতিয়ার খিলজি ক্লান্তি নিয়ে আলি মর্দানের অতিথি হয়েছিলেন। আলি মর্দান ভাবলেন তাকে টিকিয়ে রাখলে সামনে সমস্যা হতে পারে। তাই আশ্রিতকে খুন করেন। প্রথম দিকে খুনের কথা প্রচারও হতে দেননি। পরে ইতিহাসবিদরা তা বের করেন।

বাংলা কঠিন একটা অঞ্চল। এ অঞ্চলের বাংলাদেশ অংশের বাসিন্দাদের জন্য স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন শেখ মুজিব নামে একজন রাজনীতিবিদ। তিনি প্রথমবারের মতো এ ভূখন্ড স্বাধীন করেন। বাংলার মানুষ তাঁকে বঙ্গবন্ধু খেতাব দিয়েছিল। ইতিহাস তাঁকে গৌরব দিয়েছিল জাতির পিতার আসনে। বাংলার নেতা, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিষ্ঠুরভাবে সপরিবারে খুন করেছিল এ দেশেরই একদল খুনি। এ হত্যাকান্ডে দেশি-বিদেশি চক্রান্ত ছিল। সেই চক্রান্তে তাঁর একদল সহচরও জড়িয়ে ছিল। সেই সহচরদের প্রধান ছিলেন কুখ্যাত মোশতাক। মীর জাফরের মতোই আরেকটি ঘৃণিত নাম। মৃত্যুর আগে বঙ্গবন্ধু খুনিদের চেহারা দেখেছিলেন। তিনি বিস্ময় নিয়ে বলেছিলেন তোমরা কারা! পাকিস্তান আর্মি আমাকে খুনের সাহস পায়নি। তোমরা এসেছো আমাকে খুন করতে? ফজরের আজানের সময় খুনিরা লিপ্ত হয় বীভৎস নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডে। বিস্ময়ের ঘোর কাটার আগেই জাতির পিতা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। ইতিহাসে তৈরি হয় আরও এক কালো অধ্যায়। আর এ অধ্যায়ে জড়িত খুনিরা ছিল বঙ্গবন্ধুর তৈরি করা বাংলাদেশের বাসিন্দা। তাদের কেউ বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে মা ডেকেছিলেন। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে গিয়ে খেতেন ভাত। কেউ নিয়েছিলেন সারা জীবন সুযোগ-সুবিধা। কেউ করেছেন চাটুকারিতা। বঙ্গবন্ধুর বাবার মৃত্যুর পর মোশতাক মাটিতে গড়াগড়ি খেয়ে কেঁদেছেন।

নবাব সিরাজউদ্দৌলার খুনিদের মতোই করুণ পরিণতি হয়েছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনিদের। ঢাকার আগামসি লেনের একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে জীবনের শেষ দিনগুলোতে ভয়ংকর একাকিত্ব নিয়ে করুণভাবে মৃত্যুবরণ করেন খুনি মোশতাক। ঢাকা শহরে তার জানাজা হয়নি। দাউদকান্দিতে জানাজায় বাধা দেয় স্থানীয় মানুষ। খন্দকার মোশতাক নামটি এখন মীর জাফরের মতোই একটা গালি। আদালতের রায়ে বঙ্গবন্ধুর বেশির ভাগ খুনির ফাঁসি হয়েছে।

দুই খুনি ডালিম, রশিদ পালিয়ে আছেন বিদেশের অজানা ঠিকানায়। ডালিমের স্ত্রী নিম্মি পাগল হয়ে মারা যান। মৃত্যুর আগে স্বামী ও তার বন্ধুদের দেখলেই থুতু দিতেন। কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে আছেন আরও দুই খুনি। তারাও সমাজ থেকে নির্বাসিত।  এ জগৎসংসারে খুনিদের কোনো ঠাঁই নেই। মহানায়কদের বিরুদ্ধে সাময়িক মিথ্যাচার করা যায়। কুৎসা রটানো যায়। দীর্ঘমেয়াদে মহানায়কদের ঠাঁই হয় ইতিহাসে। খুনিদের ঠাঁই মেলে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে।

                লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন

সর্বশেষ খবর