সোমবার, ২৯ মে, ২০২৩ ০০:০০ টা

বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী বাহিনীর ভূমিকা

ওয়ালিউর রহমান

বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী বাহিনীর ভূমিকা

আমি তখন রোমে রাষ্ট্রদূত হিসেবে কর্মরত ছিলাম এবং হুমায়ুন রশীদ ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। রোম থেকে আমি জাতিসংঘের দ্বারা স্থাপিত Economic and Social Consequences of the Arms Race and of Military Expenditures (ESCAR) কমিটি মিটিংয়ে এলাম। আমাদের অফিস ছিল নিউইয়র্কের টার্কিশ (Turkish) সেন্টারের অষ্টম তলায়। একদিন জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল পেরেজ দ্য কুয়েলার (Perez de Cuellar) আমাকে ডেকে বললেন,  তোমাদের সরকারকে বল আমাদের শান্তিরক্ষা মিশনে কিছু সৈন্য দিতে। এতে তোমাদেরই দেশের নাম হবে। আমিও ভাবছিলাম কী করে বাংলাদেশের সৈন্যদের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে যোগদান করানো যায়। এতে বাংলাদেশের সৈন্যদের নাম উজ্জ্বল হবে এবং দেশের সুনাম হবে। আমি বাংলাদেশ মিশনে ফিরে এলাম এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী হুমায়ুন রশীদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বললাম। তখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার সঙ্গে আমাকে ফোনে কথা বলতে বললেন, আমি বললাম আপনি বললে ভালো হয়। তিনি বললেন আমি না তুমি কথা বল। তখন তাকে ফোন করে জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলের প্রস্তাবের কথা বললাম। তিনি বললেন, আমরা কী করে সৈন্য দেব, এখানে অনেক আন্দোলন হচ্ছে, এখানে সৈন্যদের প্রয়োজন। আমি বললাম, স্যার, এটা দেশের জন্য ভালো হবে এবং সেনা সদস্যবৃন্দ খুশি হবে। তাদেরও জীবনযাত্রা নির্বাহের জন্য আয়ের পথ সুগম হবে। তখন তিনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, ঠিক আছে, আমরা বেশি সৈন্য দিতে পারব না। তবে কিছু সৈন্য দেব, এটা তুমি সেক্রেটারি জেনারেলকে অবহিত কর। আমি রাষ্ট্রপতির কথা তাকে জানালাম। সেই মোতাবেক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সৈন্য পাঠানোর ব্যাপারে তাদের সঙ্গে একটি চুক্তি হলো। ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অংশগ্রহণ করে UNIIMOG (United Nations Iran-Iraq Military Observer Group) মিশনে এটি তাদের প্রথম পদক্ষেপ। এ ছাড়া কঙ্গো, মালি, সুদান, সাউথ সুদান, সাহারা, লেবানন, পূর্ব তিমুর প্রভৃতি স্থানে শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ একটি উজ্জ্বল নাম। নিজেদের জীবন বিপন্ন করে বিভিন্ন দেশের জাতিগত সংঘাত মোকাবিলা এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত বিভিন্ন দেশের রাস্তাঘাট, অবকাঠামো নির্মাণ ও চিকিৎসাসেবায় আমাদের শান্তিরক্ষীরা অনুকরণীয় দায়িত্ব পালন করায় বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হচ্ছেন। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের পেশাদারিত্ব, সাহসিকতা এবং আন্তরিকতা আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশকে এক অনন্য উচ্চতার পৌঁছে দিয়েছে।

আমি যখন ১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ দূত হয়ে আফ্রিকা ভ্রমণে গিয়েছিলাম তখন আফ্রিকা, কেনিয়া, মোজাম্বিকের রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল। সবাই বাংলাদেশ সরকারের প্রশংসা করল। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর অবদানকে। মোজাম্বিকের প্রেসিডেন্ট বলেই বসলেন, আমাদের এখানে যখন বন্যা হয়েছিল তখন অনেক ক্ষতি হয়েছিল। আপনাদের পাঠানো বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনী আমাদের অনেক সহযোগিতা করেছিল। বিশেষ করে রাস্তাঘাট নির্মাণ, ব্রিজ নির্মাণ, আরও বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছিল। তিনি বললেন, আপনি যখন দেশে যাবেন তখন আপনাদের সরকারকে বলবেন তিনি যেন আমাদের এখানে আবারও কিছু সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে দেয়।

শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের ৩০ বছরপূর্তি উপলক্ষে ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেছিলেন, মানবাধিকার সুরক্ষার পাশাপাশি গোলযোগপূর্ণ অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের সেনাদের ভূমিকা আমাকে মুগ্ধ করেছে। বাংলাদেশের মহিলা পুলিশ দল সোচ্চার রয়েছেন সামাজিক-সম্প্রীতি সুসংহত করতে। আমি কোনো মিশনে গেলেই উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের সেনাদের কথা বলি। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রশংসা অর্জন আমাদের জন্য সত্যিকার অর্থেই গৌরবের। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে যুদ্ধরত সিরিয়ায় একটি মেডিকেল টিম পাঠিয়ে শান্তিরক্ষায় মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে তাঁর সরকারের বন্ধুত্ব স্থাপনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ বাংলাদেশের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমকে স্বীকৃতি দেয়। ইতোমধ্যে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা প্রশংসিত হয়েছেন দেশ-বিদেশে। বিশ্বের ৪০ দেশে ৫৪টি শান্তিরক্ষা মিশনে এ অবধি ১ লাখ ৮৩ হাজার ৩৭৮ জন শান্তিরক্ষী নিয়োজিত রয়েছেন। জাতিসংঘের অধীনে বাংলাদেশ শান্তিরক্ষী বাহিনী ৩৫ বছর পূর্ণ করল (১৯৮৮-২০২৩)।

বিশ্বশান্তি রক্ষায় দীর্ঘ ৩৫ বছরের পথচলায় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী বিভিন্ন দেশের পরিচালিত জাতিসংঘ শান্তি মিশনে গৌরবের সঙ্গে অংশগ্রহণ করে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। ফলে বর্তমানে বাংলাদেশ শীর্ষ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।

স্বাধীনতার ৫১ বছরে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা অর্জন জাতিসংঘ মিশনে শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে শীর্ষ অবস্থানটি ধরে রাখা। শান্তিরক্ষী হিসেবে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় তারা অনন্য ভূমিকা রাখছে। দেশের সুনাম বৃদ্ধিতে তারা কাজ করছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে ১৯৮৮ সাল থেকে অংশগ্রহণ করে অদ্যাবধি বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী সদস্যরা সর্বোচ্চ পেশাদারি মনোভাব, আনুগত্য ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে চলেছেন। ভয়ভীতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবিলা করে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশি সদস্যরা শান্তির বার্তা নিয়ে এগিয়ে চলেছেন। তাদের অনন্য অবদানের জন্য আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে দেশের ভাবমূর্তি বলিষ্ঠ হয়েছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও ব্যাপক অবদান রেখেছেন তারা।

সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে বৈরিতা নয়’- জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনুসৃত এ আদর্শ অনুসরণে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হচ্ছে। আঞ্চলিক ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর অবদান ছিল স্পষ্ট।  আন্তর্জাতিক শান্তি আর সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অঙ্গীকারবদ্ধ। সে দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সবাই বিশ্ব শান্তি বিনির্মাণে বদ্ধপরিকর।

আমাদের শান্তিরক্ষী সদস্যরা আগামী দিনগুলোতেও সততা, নিষ্ঠা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে বিশ্বশান্তি, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠার এই ধারা অব্যাহত রাখতে সক্ষম হবে- এ প্রত্যাশা করি।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, গবেষক

সর্বশেষ খবর