সোমবার, ২৯ জানুয়ারি, ২০২৪ ০০:০০ টা

রোদে ভিজে বাড়ি ফেরা

মাকিদ হায়দার

রোদে ভিজে বাড়ি ফেরা

আবদুল মোতালেব ফণী ভাই ছিলেন আমাদের এক চাচার মেজ ছেলে। তিনি আমার চেয়ে বয়সে বছর ছয়-সাতেকের বড় থাকলেও পড়ালেখায় তার মন না থাকায় ক্লাস সিক্সে তিনি ছিলেন বছর দুই। পাবনা গোপালচন্দ্র ইনস্টিটিউশনে (স্থাপিত ১৮৯৪) আমি যখন ওই স্কুলে ভর্তি হই ক্লাস ফোরে ১৯৫৮ সালে দাউদ, জাহিদ, আরিফ এবং মেজ চাচার ছেলে আনিসুর রহমান  রাজা, ছোট চাচার ছেলে হাসনাত মোশারফসহ দোহারপাড়ার অনেক ছেলেই গোপালচন্দ্র ইনস্টিটিউশনে বা জিসিআইতে ভর্তি হয়েছিল। তার বেশ কয়েক বছর আগে আমাদের ফণী ভাই ভর্তি হলেও তার পড়ালেখার কোনো মন না থাকায় একই ক্লাসে বছর দুয়েক করে থাকতে হয়েছিল তাকে।

আমি যখন ক্লাস সিক্সে ফণী ভাই সেবারও ক্লাস সেভেনে উঠতে পারেননি। ফেল করার খবর তার পিতা মাসুদ চাচা পেয়েছিলেন, তিনি রাতে দুঃখে-অভিমানে ফণী ভাইকে খড়মপেটা করায় ফণী ভাই জানিয়ে দিলেন আমি আর পড়াশোনা করব না। তার এ বছরটা ক্লাস সিক্সেই শেষ, পরীক্ষায় যদি পাস করি...। ফণী ভাই এক দিন আমাকে স্কুলের উত্তর দিকে পুলিশ সেরিয়াল গ্রাউন্ডের কাছে নিয়ে বললেন, চল ওই জাম গাছের নিচে বসে তোকে একটা জিনিস খাওয়াব। জীবনে তুই যা খাস নাই কোনো দিন। আজকেই প্রথম খাবি। আমরা সেখানে গিয়ে বসলাম। সেটার নাম জামতলা রোড। রোডটি শুরু হয়েছে সুচিত্রা সেনদের বাড়ির দক্ষিণে মূল রাস্তা থেকে ৩-৪ ফুট উঁচু মাটির বাঁধ। বর্ষাকালে পদ্মা এবং ইছামতী নদীর বন্যায় পুরো পাবনা শহর জলমগ্ন হয়ে যেত, যাতে জলমগ্ন না হয় সেই জন্যই ওই শহররক্ষা বাঁধ দেওয়া হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে। বাঁধটি আবার ছিল অর্ধচন্দ্রের মতো। পাবনা টেকনিক্যাল স্কুলের কিনার দিয়ে ঘুরে কিছুটা দক্ষিণে গিয়ে জজ কোর্টের পেছন দিয়ে সোজা হয়ে পশ্চিমের পুরনো ব্রিজের কাছে শেষ হয়েছে। প্রায় মাইল দুয়েক। পুরনো ব্রিজের মাঝখান দিয়ে বর্ষাকালে ইছামতী নদী দিয়ে বড় বড় নৌকা মালামাল নিয়ে দক্ষিণ থেকে উত্তরে যেত। আমাদের জিসিআই স্কুলটি শহরের দক্ষিণ দিকে, মাটির রাস্তা থেকে ১০০-১৫০ গজ দূরে। সেরিয়াল গ্রাউন্ড আর ওই মাটির রাস্তার উত্তর-দক্ষিণে অনেক জাম গাছ, তাই অনেকেই বলতেন জামতলা রোড। সেই রোডের বৃহৎ একটি জাম গাছের নিচে আমি আর ফণী ভাই গিয়ে বসলাম। কোনো কথা না বলে তিনি নিজের শার্টের পকেট থেকে এক প্যাকেট কেঁচি মার্কা (সিজার সিগারেট) সিগারেট বের করে তার ভিতর থেকে একটি আমার হাতে দিয়ে বললেন, কেঁচি সিগারেট পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত সিগারেট। ১০টার দম ১৪ পয়সা অর্থাৎ সাড়ে তিন আনা। আমি তোর জন্যই কিনলাম, দুই ভাই আনন্দ করে খাব। খাওয়ার পর তোকে চিনাবাদাম আর নোকোনদানা কিনে খাওয়াব। তবে তুই দোহারপাড়া গিয়ে কাউকে বলিসনে আমাদের সিগারেট খাওয়ার কথা।

ফণী ভাই কথা শেষে পকেট থেকে ম্যাচ বের করে একটি সিগারেট আমার দিকে এগিয়ে দিতেই আমি বললাম, কিছুতেই আমি সিগারেট খাব না। তুমি আমাকে যতই চিনাবাদাম আর নোকোনদানার লোভ দেখাও না কেন? ফণী ভাই হেসে দিয়ে বললেন, তোকে সিগারেট খেতেই হবে। আমি যতবার না করি তিনি ততবারই বলেন, না খেলে আমি বড় চাচা মিয়াকে অর্থাৎ আমার বাবাকে গিয়ে বলবেন, রোকন কেঁচি সিগারেট খেয়েছে জামতলায় গিয়ে। আমি নিজের চোখে দেখেছি। অগত্যা ফণী ভাইয়ের দেওয়া সেই কেঁচি মার্কা সিগারেটের দুইটান দিয়ে কাশতে কাশতে জীবন বের হয়ে যাওয়ার জোগাড়। ফণী ভাই বললেন প্রথম দিন তো, পরে ঠিক হয়ে যাবে। তখন আর কাশবিনে। তিনি যথারীতি এক আনার চিনাবাদাম ও এক আনার নোকোনদানা কিনে আমার হাতে দিয়ে বললেন, এবার যদি পরীক্ষায় পাস না করি জীবনে আর লেখাপড়া করব না। আমার আব্বার লেখাপড়া ক্লাস ফোর পর্যন্ত। তোর আব্বার লেখাপড়া ম্যাট্রিক ফেল, তোর আব্বা ঠিকাদারি ব্যবসা করে পাবনা শহরে তিনটি বাড়ি বানিয়েছে। আমার আব্বা বানিয়েছে একটি বাড়ি। উনারা কি এমএ/বিএ পাস করেছে। আরিপপুরের মনছের হাজি কোটি কোটি টাকার মালিক, লেখাপড়া জানে না, কোনোরকমে নিজের নাম লিখতে শিখেছে। ঠিকাদারি করে দোতলা বাড়ি বানিয়েছে ফায়ার ব্রিগেডের সামনে। ট্রাক, জিপ সবই করেছে মনছের ঠিকাদার। আমার আব্বারও ট্রাক আছে, আর তোর আব্বার আছে অনেক জমি। উনারা যদি লেখাপড়া না শিখেই এত সহায়-সম্পদের মালিক হন, তাহলে আমি কেন পারব না। এক দিন ঠিকাদারি করে গাড়ি-বাড়ি সবই হবে আমার, চিন্তা করিসনে। আর তুই বিএ/এমএ পাস করে জজ কোর্টের বড়জোর পেশকার হবি, তার চেয়ে তোর আব্বার কাছ থেকে শিখে নে কীভাবে ঠিকাদারি করতে হয়। ফণী ভাইয়ের কথা শেষ হতেই বললাম, আমার আব্বা তো ইংরেজি টাইপটাইটার মেশিন দিয়ে নিজে টাইপ করে, সেগুলো নাকি টেন্ডার বলে শুনেছি আব্বার কাছ থেকে।

এমন সময় স্কুলের দারোয়ান গোপাল দা এসে বললেন, আগামীকাল থেকে সকালবেলায় স্কুল হবে, কেননা যেভাবে গরম শুরু হয়েছে তাই স্কুলের সভাপতি আমাদের হেডস্যার মথুরালাল স্যারকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন, কাল থেকে মর্নিং স্কুল হবে। মর্নিং স্কুল হওয়ার কথা শুনে আমরা যারা ওই স্কুলের ছাত্র ছিলাম সবাই খুবই খুশি হয়েছিলাম। তবে স্কুলে সকাল ৭টার ভিতরে আসতে হবে, আর ছুটি হবে বেলা ১১টায়। ফণী ভাইকে দলপতি বানিয়ে আমরা আরিপপুর দোহারপাড়ার ছেলেরা দলপতির নেতৃত্বে সকাল ৭টার আগেই জিসিআইতে পৌঁছতাম। চৈত্র-বোশেখের সকালের আবহাওয়া খুবই ভালো লাগত। কিন্তু বেলা বেড়ে গেলে শুরু হতো গরম, আর বেলা ১১টায় যখন ছুটি হতো তখন তো রীতিমতো গরম। সেই গরম মাথায় নিয়ে আবার ফণী ভাইয়ের নেতৃত্বে দোহারপাড়া আরিপপুরে ফেরার পথে আমাদের শরিকানার একটি বিশাল ফজলি আমবাগান ছিল। সেই বাগান পর্যন্ত এসে বই-খাতা মাটিতে ফেলে দিয়ে ফজলি আম গাছে চড়ে আম পেড়ে বাগানের পুবদিকের ইউনুস চাচার বাড়ি থেকে লবণ আর বঁটি নিয়ে এসে মহানন্দে কেটে খেতাম, সেই কাঁচা টক সেই বয়সে সবচেয়ে মধুর মনে হতো। স্কুল থেকে দৌড়ে এসে প্রায় মাইল দুয়েক রাস্তা শহর থেকে সোজা পুবের দিকে আসতে বেশি সময় না লাগলেও শার্ট ভিজে চুপচুপে হয়ে যেত। রোদে ভিজে বাড়ি ফেরা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।

কোনোরকম বাড়ি এসেই ঘামে ভেজা শার্টসহ ঝাঁপিয়ে পড়তাম বাড়ির পুকুরে। প্রতিদিন মর্নিং স্কুলে যাওয়া এবং ফিরে আসার যে আনন্দ আমরা উপভোগ করেছি এখনকার ছেলেমেয়েরা সেটি করে কি না জানি না। সেই স্কুলজীবন সবচেয়ে মজার জীবন। যে জীবন আর কোনো দিন ফেরত পাওয়া যাবে না জেনেও যখনই পেছনের দিকে চোখ ফেরাই তখনই দেখি সেই ফজলি আমবাগান, এমনকি যে স্কুলে পড়েছি সেই স্কুল কালের যাত্রায় এখন প্রায় ধ্বংসের মুখে একটি কাঠামো দাঁড়িয়ে আছে। যদিও জিসিআইয়ের নতুন চার তলা ভবন তৈরি হয়েছে, সেটি নিতান্তই ভালো লাগেনি আমার মতো অনেক পুরনো ছাত্রের কাছে। পুরনো ভবনটির বৈশিষ্ট্য হলো- পশ্চিমে উত্তর- দক্ষিণে তিনটি বড় বড় ক্লাসরুম, আর পুবদিকে হেডমাস্টার এবং অন্য শিক্ষকদের বসার ঘর। শিক্ষকরা অধিকাংশই ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের। আমাদের অঙ্কের শিক্ষক ছিলেন রমেশচন্দ্র সাহা, বাংলা পড়াতেন বিমল স্যার।  আমরা তিন ভাই জিয়া হায়দার, রশীদ হায়দার এবং আমি ওই জিসিআই স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেছিলাম। আমি এবং মেজ ভাই অঙ্কে ভীষণ দুর্বল, ফলশ্রুতিতে রশীদ ভাই ১৯৫৮ সালে একমাত্র অঙ্ক বিষয়ে মাধ্যমিক পাস করতে পারেননি। অন্যান্য বিষয়ে পেয়েছিলেন ফার্স্ট ডিভিশনের মার্ক। আর আমি একবারই মাধ্যমিকে পার পেয়ে ঢাকায় এসে ১৯৬৫ সালে জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম।

আমরা কয়েক বন্ধু গল্পকার বুলবুল চৌধুরী, প্রাবন্ধিক গাজী আজিজুর রহমান প্রায়ই রোদে ভিজে বাড়ি ফিরতাম, যেহেতু তখন ঢাকা শহরে তত যানজট না থাকায় মহানন্দে পায়ে হেঁটে রোদে ভিজে বাড়ি ফিরেছি অনেকবার। আজকালকার ছেলেমেয়েরা হাঁটা প্রায় ভুলে গেছে। তবে স্কুল পালানোর মতো সুখ আজও মনে আছে।  বিশেষত অঙ্কের রমেশ স্যার বেত হাতে নিয়ে ক্লাসে এসে বলতেন, গতকালের অঙ্কের খাতা নিয়ে আয়, অঙ্ক না পারলে উত্তম-মধ্যম খেয়েছি একাধিক দিন। রমেশ স্যারের ভয়ে স্কুল থেকে পালিয়ে যেতাম। সেই ভয় এখনো আছে। অঙ্ক দেখলেই ভয়।

লেখক : কবি

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর