বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল। ১৯৭৮ সালের ১সেপ্টেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এই দল প্রতিষ্ঠা করেন। সেদিন বিকালে রাজধানীর রমনা রেস্তোরাঁয় তিনি এক সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র পাঠের মাধ্যমে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের যাত্রা শুরু করেন। জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে তিনি ঘোষণাপত্র পাঠ ছাড়াও প্রায় দুই ঘণ্টা সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর বিচারপতি আবদুস সাত্তার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু সেনাপ্রধান এরশাদ তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে দেশে সামরিক শাসন জারি করেন। বিএনপি এই ক্ষমতা গ্রহণকে প্রত্যাখ্যান করে এবং এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে। প্রায় ৯ বছর আন্দোলন করে বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে ক্ষমতাচ্যুত করে। এরপর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি সরকার গঠন করে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি একটি একদলীয় নির্বাচন করে এবং গণআন্দোলনের মুখে একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা দিয়ে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনে যোগ দিলে বিএনপি পরাজিত হয় এবং দেশের বৃহত্তম বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত বিএনপি আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে। এ আন্দোলন তেমন সফল না হলেও ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে।
এরশাদবিরোধী আন্দোলন : বিএনপি বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারবিরোধী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রাখে। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ৭ দলীয় জোট গঠন করে। আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিএনপি এরশাদ আমলে অনুষ্ঠিত ২টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও সব স্থানীয় সরকার নির্বাচন বয়কট করে। এই আন্দোলনে বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্বৈরাচারী এরশাদের সঙ্গে কোনো আপোস না করায় খালেদা জিয়াকে আপোসহীন নেত্রী বলা হয়। বিএনপিসহ সব বিরোধী দলের গণআন্দোলনে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ পদত্যাগে বাধ্য হন।
স্বৈরাচার হাসিনাবিরোধী আন্দোলন : বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন, সংগ্রাম ও ত্যাগ বিএনপির সবেচেয়ে বেশি। গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে স্বৈরাচার হাসিনা সরকার অন্যায়ভাবে ছয় বছর কারাগারে বন্দি রেখেছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে গত ১৭ বছর দেশে ফিরতে দেননি শেখ হাসিনা। অন্যায় ও অবৈধভাকে দীর্ঘ ১৬ বছর ক্ষমতা দখল করে বসেছিল শেখ হাসিনা। এ সময় হাজার হাজার বিএনপি নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। লাখ লাখ নেতা-কর্মী জেল খেটেছেন। শত শত নেতাকর্মীকে গুম করা হয়েছে। অবশেষে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা।
বিএনপির মূলনীতি : বিএনপির লক্ষ্য ছিল অর্থনৈতিক উন্নয়ন, গণতন্ত্রায়ন, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্য এবং জনগণের মধ্যে স্ব-নির্ভরতার উত্থান ঘটানো। বিএনপির রাজনীতির মূল ভিত্তি হলো- ১. সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর বিশ্বাস, ২. জাতীয়তাবাদ, ৩. গণতন্ত্র, ৪. সমাজতন্ত্র (অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচারের অর্থে)।
লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য : (১) বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ-ভিত্তিক ইস্পাতকঠিন গণঐক্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা, রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা ও গণতন্ত্র সুরক্ষিত ও সুসংহত করা। (২) ঐক্যবদ্ধ এবং পুনরুজ্জীবিত জাতিকে অর্থনৈতিক স্বয়ম্ভরতার মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ, নয়া-উপনিবেশবাদ, আধিপত্যবাদ ও বহিরাক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করা। (৩) উৎপাদনের রাজনীতি, মুক্তবাজার অর্থনীতি এবং জনগণের গণতন্ত্রের মাধ্যমে সামাজিক ন্যায়বিচারভিত্তিক মানবমুখী অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জাতীয় সমৃদ্ধি অর্জন। (৪) জাতীয়তাবাদী ঐক্যের ভিত্তিতে গ্রামেগঞ্জে জনগণকে সচেতন ও সুসংগঠিত করা এবং সার্বিক উন্নয়নমুখী পরিকল্পনা ও প্রকল্প রচনা ও বাস্তবানের ক্ষমতা ও দক্ষতা জনগণের হাতে পৌঁছে দেওয়া। (৫) এমন এক সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করা যেখানে গণতন্ত্রের শিকড় সমাজের মৌলিক স্তরে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হয়। (৬) এমন একটি সুস্পষ্ট ও স্থিতিশীল সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা- যার মাধ্যমে জনগণ নিজেরাই মানবিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতি আনতে পারবেন। (৭) বহুদলীয় রাজনীতির ভিত্তিতে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত একটি সংসদীয় পদ্ধতির সরকারের মাধ্যমে স্থিতিশীল গণতন্ত্র কায়েম করা এবং সুষম জাতীয় উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি আনয়ন। (৮) গণতান্ত্রিক জীবনধারা ও গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থার রক্ষাকবচ হিসেবে গণনির্বাচিত জাতীয় সংসদের ভিত্তি দৃঢ়ভাবে স্থাপন করা এবং জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করা। (৯) রাজনৈতিক গোপন সংগঠনের তৎপরতা এবং কোনো সশস্ত্র ক্যাডার, দল বা এজন্সি গঠনে অস্বীকৃতি জানান ও তার বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করা। (১০) জাতীয় জীবনে মানবমুখী সামাজিক মূল্যবোধের পুনরুজ্জীবন এবং সৃজনশীল উৎপাদনমুখী জীবনবোধ ফিরিয়ে আনা। (১১) বাস্তবধর্মী কার্যকরী উন্নয়ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জাতীয় জীবনে ন্যায়বিচার-ভিত্তিক সুষম অর্থনীতির প্রতিষ্ঠা, যাতে সব নাগরিক অন্ন, বস্ত্র, স্বাস্থ্য, বাসস্থান ও শিক্ষার ন্যূনতম চাহিদা পূরণের সুযোগ পায়। (১২) সার্বিক পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচিকে অগ্রাধিকার দান করা ও সক্রিয় গণচেষ্টার মাধ্যমে গ্রাম বাংলার সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা। (১৩) নারী সমাজ ও যুব সম্প্রদায়সহ সব জনসম্পদের সুষ্ঠু ও বাস্তবভিত্তিক সদ্ব্যবহার করা। (১৪) বাস্তবধর্মী অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ এবং সুসামঞ্জস্যপূর্ণ শ্রম ব্যবস্থাপনা সম্পর্ক স্থাপন এবং সুষ্ঠু শ্রমনীতির মাধ্যমে শিল্পক্ষেত্রে সর্বোচ্চ উৎপাদন নিশ্চিত করা। (১৫) বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, বাংলাদেশের সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও ক্রীড়া সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও প্রসার সাধন।
বর্তমান নেতৃত্ব : বর্তমানে বিএনপির নেতৃত্বে আছেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়া। বেগম জিয়া দেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী। প্রতিবার নির্বাচনে তিনি পাঁচটি আসনে জয়ী হয়েছেন। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন তারেক রহমান। ২০১৬ সালের ৩০ মার্চ থেকে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিএনপি মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
লেখক : সাবেক এমপি ও সাবেক সভাপতি গোপালগঞ্জ জেলা বিএনপি