আমার গাড়িটা রাত সাড়ে ৮টায় বারিধারার ১২ নম্বর সড়কের সম্ভবত ২৩ নম্বর বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। দারোয়ান এসে মূল দরজা খুলে দিল। আমি গাড়ি থেকে নামলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতি এসে আমার চেতনার দরজায় বিরাট একটা আঘাত করল। এই বাড়িতে আমি কত এসেছি। আমার রাজনৈতিক জীবনের পরিপূর্ণ সময়ের একটা বিরাট অংশজুড়ে আমাকে জড়িয়ে আছে এই বাড়ি। ভিতরে ঢুকতেই হাতের বাঁয়ে চোখে পড়ল একটা লাশের গাড়ি, একটা এয়ারকন্ডিশন্ড অ্যাম্বুলেন্স। স্বচ্ছ কাচের মধ্য দিয়ে আমি ভিতরে তাকালাম। আমি দেখলাম তাঁকে। তিনি শুয়ে আছেন। একটা জাতীয় পতাকায় তাঁর শরীরটা ঢেকে দেওয়া। দুই নাকের ফুটোতে তুলা গোঁজা। নিমীলিত চোখেও তাঁকে মনে হলো তিনি তাকিয়ে আছেন। হাসছেন। আমার সঙ্গে রাজ্জাক ছিল। ওকে বললাম, দেখেছ? ও মাথা নাড়ল কেবল।
সামনে এগোলাম। কয়েকজন সোফায় বসেছিল। আমাকে দেখে উঠে দাঁড়াল এবং সালাম দিল। আমাকে শরীরের অবস্থার কথা জিজ্ঞেস করল। আমি বললাম, মোটামুটি ভালো। মাত্র ১০ দিন আগে আমার একটা ছোটখাটো হার্টঅ্যাটাক হয়েছে। ওরা সেটা জানত বলেই এই প্রশ্ন করেছিল।
এবার আমি জানতে চাইলাম, কেউ নাই? ওদের একজন জবাব দিল মাহী ভাই ছিলেন একটু আগে। ওপরে চলে গেছেন। বোধ হয় ঘুমাচ্ছেন। আমি ভাবলাম চলে যাই। তখন আবার বলল একটু বসেন। আমি দেখি মাহী ভাইকে খবর দিতে পারি কি না। অন্যরা আমাকে নিয়ে ওই দোতলায় একটা ঘরে বসতে দিল। একটা সোফায় বসলাম আর সঙ্গে সঙ্গেই স্মৃতি আমাকে আবার আঘাত করল।একবিংশ শতকের প্রথম দশকে যখন আমরা যুক্তফ্রন্ট করেছি ডা. বি চৌধুরী এবং ড. কামালের নেতৃত্বে তখন এ বাসায় আমরা অনেক এসেছি। দোতলার ঠিক এই ঘরটিতে আমরা মিটিং করতাম। আমি এখন যে সোফায় বসে আছি সেই সোফাটায় বসতেন ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী। নিচে একটু আগে যার লাশ আমি দেখে আসলাম। চোখের সামনে আমার সেসব দিনের স্মৃতিগুলো ভেসে বেড়াতে লাগল।
মাহী এসে ঘরে প্রবেশ করল এবং এসেই আমাকে জড়িয়ে ধরল। ‘মান্না ভাই’ অস্ফুট কণ্ঠে বলল সে। আমিও তাকে জড়িয়ে ধরলাম। আমার চাইতে অনেক লম্বা মাহীও আমাকে জড়িয়ে ধরতে চেষ্টা করল। আমি বুঝতে পারলাম মাহি কাঁদছে। কিছুক্ষণের মধ্যে নিজের অজান্তেই আমার চোখের কোণ ভিজে গেল।
মাহি আমাকে ছেড়ে দিলে আমি আবার সেই সোফায় গিয়ে বসলাম। মাহিকে উদ্দেশ করে বললাম, এই সোফায় স্যার বসতেন না? মাহী জবাব দিল, হ্যাঁ। উনি কিন্তু আপনাকে খুব ভালোবাসতেন। আপনার কথা প্রায়ই বলতেন। সেটা আমি জানি। তাই চুপ করে রইলাম। অনেকক্ষণ মাহিও চুপ করে রইল। তারপর চোখ তুলে চাইলেন। ওর চোখে তখন কোনো পানি নেই। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, শেষ সময়টা তো জানেন আব্বু কোনো চিকিৎসা দিতে রাজি হননি। আমি বললাম, মানে? মাহী বলল, যেমন ধরেন উনি তো সিসিইউ; আইসিইউতে বিশ্বাস করতেন না। এমনকি নিজের শরীরে আইভিতে ওষুধ কিংবা খাদ্য গ্রহণ করার জন্য কেনোলা করতেও রাজি হতেন না। উনি বলতেন দেখ আমার বয়স এখন ৯৪ আমার চলে যাওয়ার সময় আমাকে শান্তিতে যেতে দাও। কেন আমাকে কষ্ট দিতে চাও?
পুত্র তার পিতার জীবনের শেষ দিনগুলোর কথার স্মৃতিচারণা করছিল। আমি নীরবে তা শুনছিলাম এবং আমিও স্মৃতির পাতায় ভর করে উড়ে বেড়াচ্ছিলাম। আমার সঙ্গে ডাক্তার বদরুদ্দোজা চৌধুরীর কবে, কোথায়, কখন দেখা হয়েছিল তা মনে নেই। তবে আমার ছাত্রজীবনে আমি তাঁকে টেলিভিশনে ‘আপনার ডাক্তার’ অনুষ্ঠান উপস্থাপন করতে দেখেছি। সেই সময় খুবই জনপ্রিয় ছিল এই অনুষ্ঠান। ডাক্তার বি. চৌধুরী অনবদ্য উপস্থাপনা দরজ দরদি গলা শ্রোতাদের বিষয়ের প্রতি তাঁর গভীর নিষ্ঠা শ্রোতাদের মুগ্ধ করে রাখত।
আমি ঢাকা কলেজের ছাত্র ছিলাম। অনেক বছর আগে (কত সাল তা এখন বলতে পারব না। কিন্তু সেটা সম্ভবত বাংলাদেশ হওয়ার পরে পরে) ঢাকা কলেজের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান হয়েছিল। হোস্টেল আর কলেজ বিল্ডিংয়ের মাঝে বিরাট মাঠ ছিল। প্রধান আয়োজনটা ছিল সেই মাঠে এবং সেই মাঠে অনুষ্ঠিত হয়েছিল একটি বিতর্ক প্রতিযোগিতা। বিতর্কের প্রতিপাদ্য মনে নাই। কিন্তু বিষয়টি ছিল নতুন এবং পুরনোদের নিয়ে। ডা. বি. চৌধুরী ছিলেন প্রবীণদের পক্ষে আর আমি ছিলাম নবীনদের। অদ্ভুত সুন্দর বক্তব্য রেখেছিলেন ডা. বি. চৌধুরী। তিনি বিতর্কে প্রথম হয়েছিলেন আমার যদি ভুল না হয় আমি হয়েছিলাম দ্বিতীয় এবং আবার, আমার যদি ভুল না হয় অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সাঈদ একজন বিচারক ছিলেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন, তিনি আমাকে সবচাইতে বেশি মার্কস দিয়েছিলেন। আমার কিন্তু তখন পরিচিতি বলতে তেমন কিছু ছিল না। আর আমি বক্তা হিসেবেও তেমন ভালো ছিলাম না। আমার স্বীকার করতে লজ্জা নেই আমি সেই কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম কিন্তু ডা. বি. চৌধুরী মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেই বিতর্কের কথা মনে রেখেছিলেন এবং সে দিন ওই বাসায় বসে তারই পুত্র মাহী বি. চৌধুরী আমাকে সেই গল্প শুনিয়েছিল। অদ্ভুত লাগে না? আমার নিজের যে কথা মনে নেই বি. চৌধুরী ৯৪ বছর বয়সে, মৃত্যুর আগেও সেই স্মৃতি কেমন ধরে রেখেছিলেন!
বি. চৌধুরী যখন ডাক্তারি প্র্যাকটিস করছেন আর একজন বিখ্যাত প্র্যাকটিশনার ছিলেন প্রফেসর নুরুল ইসলাম। বয়স্কদের এসব কথা মনে আছে। এদের দুজনের মধ্যে কে বড় ছিলেন সেরকম একটা বিতর্ক তখন হতো। কিন্তু সে বিতর্কের কোনো নিষ্পত্তি হয়নি। আসলে এরকম বিতর্কের নিষ্পত্তি হয়ও না। তবে বি. চৌধুরী রোগীদের কাছে প্রিয় ছিলেন তাঁর মিষ্টি আচরণের জন্য। সুন্দর করে কথা বলতেন তিনি যা রোগীদের মধ্যে একটা আস্থা তৈরি করত।
বি. চৌধুরী পরবর্তীতে রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি বাংলাদেশের অন্যতম বড় একটি রাজনৈতিক দল, বিএনপির সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিও নির্বাচিত /নিযুক্ত হয়েছিলেন। একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে নিশ্চয়ই তিনি তাঁর সাফল্যের প্রায় চূড়ান্ত অভিধায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। এ বিষয় নিয়ে আমি খুব আলোচনা করব না। রাজনৈতিক সফলদের মাপকাঠি আমার কাছে এমন নয়; কিন্তু আমি বি. চৌধুরীকে ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করতাম। একবার আমি কুড়িলে বিকল্পধারার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে গিয়েছিলাম। বি. চৌধুরী প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে একটি গান গেয়েছিলেন এবং বলতে ভালো লাগছে যে, তিনি ভালো গেয়েছিলেন।
দোতলার ওই ঘরে বসে মাহী আমাকে তাঁর পিতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর শেষ জীবনের কয়েকটি ভিডিও দেখিয়েছিলেন। একটি ভিডিও ছিল সম্ভবত মৃত্যুর তিন দিন আগের। সেই যে তিনি বলেছিলেন আমি তোমাদের সবার মাঝে মরতে চাই, তাঁর পুত্র, কন্যা এবং স্বজনরা জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত হাসপাতালে তাঁর সঙ্গেই ছিলেন। ভিডিওটিতে দেখলাম, কেউ একজন রবীন্দ্রসংগীত গাইছেন। ডা. বি চৌধুরী শুনছেন। এক সময় তিনিও গাইতে শুরু করলেন। এবং তাঁর চোখ দিয়ে পানি গড়াতে থাকল।
আমি মুগ্ধ-বিস্ময় তাকিয়ে থাকলাম। মনে হলো সত্যজিৎ কিংবা মৃণাল সেনের কোনো ছবির দৃশ্য দেখছি।
বৈঠকের ওপরে লেখার মতো সময় বা পরিসর আমার হাতে এখন নাই। আমার শিক্ষক শিরোনামে যা লিখতে চেয়েছিলাম তাও আসলে লেখা যাবে না। তবুও প্রাসঙ্গিকতার কারণে একটি কথা বলতে হবে। তাই লেখাটা বাড়ালাম।
আমি এখন আমাদের জোট, গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়কারী। এটা চক্রাকারে ঘোরে, মানে প্রতি দুই মাসে সমন্বয়কারী নতুন করে নির্বাচিত হয়। আমি এখন সমন্বয়কারী বলে জোটের পক্ষ থেকে আমিই কথা শুরু করলাম। ১৭ মিনিট কথা বলেছিলাম আমি। আমার জন্য বরাদ্দের চাইতে অনেক বেশি। আমার ওরকম করা উচিত ছিল না। কিন্তু ভুলটা হয়ে গিয়েছিল। একটা কথা বলার লোভ সামলাতে পারছিলাম না। আমি আমার মতো করে তা এখানে বলছি।
স্যার ব্যক্তি হিসেবে আপনি এখন অনেক বড়। এমনকি আপনি এখন যে পদে বা দায়িত্বে আছেন তার চাইতে বড়। এ জন্যই বাংলাদেশের মানুষ মনে করে এই পদের প্রতি আপনার লোভ নাই। আপনি যা করছেন তা দেশকে ভালোবেসেই করছেন। অন্যান্য স্বৈরাচারীরা যা করেছিল ছলেবলে কৌশলে ক্ষমতা ধরে রাখবার চেষ্টা করেছিল আপনি তা করবেন না। আমার কথা শেষ হলো না। তার আগেই ড. ইউনূস বাধা দিলেন। না, কোনোভাবেই নয়। তোমরা যে সংস্কার চাইছ, এই সংস্কার করে নির্বাচন দিয়েই আমি চলে যাব।
ড. ইউনূসের কথা শেষ হতে না হতেই আমি আবার কথা বলতে শুরু করলাম। সংস্কার নিশ্চয়ই চাপিয়ে দেবেন না। এটা চাপিয়ে দেওয়ার ব্যাপার নয়। এটা হতে হবে সবারই ঐকমত্যের ভিত্তিতে। আলোচনার সময় অনেক বিষয় আসবে। এর মধ্যে থেকে যতদূর ঐকমত্য হবে ততদূর সংস্কার বাস্তবায়িত হবে। আর বাকিটা পরবর্তী সংসদ বা সরকার করবে। ড. ইউনূস জবাব দিলেন চাপানোর ব্যাপার হবে কেন? সংস্কার কি কখনো চাপিয়ে দেওয়া যায়? আর সবকিছুই আমরা করব কেন? এটা তো সমগ্র দেশের কাজ সারা দেশের মানুষ এটা করবে। আমরা করব। আমরা মানে আমরা সবাই, আমি তুমি এবং অন্যরা। আমরা তো একই। আলাদা তো নই।
♦ লেখক : সভাপতি, নাগরিক ঐক্য