সুরমা নদীকে বলা হয় সিলেট নগরীর ‘লাইফ লাইন’। সিলেট নগরীকে দুই ভাগ করে বয়ে গেছে সুরমা। আর উত্তর-দক্ষিণে বিভক্ত নগরীকে এক করেছে সুরমার ওপর ঝুলে থাকা লোহার কাঠামোর লাল রঙের সেতু। কিন ব্রিজ নামেই যে সেতুটি বহন করছে সিলেটের নানা ইতিহাস-ঐতিহ্য। সিলেটের মানুষের কাছে ব্রিজটি ‘পুরান পুল’ নামেও পরিচিত। নয় দশক ধরে সুরমার দুই পাড়ের মানুষের যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে এই সেতুটি।
বয়সের ভারে ন্যুব্জ হলেও কালের সাক্ষী হয়ে এখনো টিকে আছে ঐতিহ্যের স্মারক এই সেতু। যদিও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ায় অনেক আগে থেকেই সেতুটি দিয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। সেতুটির স্থানে স্থানে উঠে গেছে পাটাতন। রেলিং ও পিলারে ধরেছে জং। সেতুটি রক্ষায় হাতে নেওয়া হয়েছিল দুই কোটি টাকার প্রকল্প। রেলওয়ের সেতু বিভাগ দিয়ে সংস্কারকাজ করায় সড়ক ও জনপথ বিভাগ। ধারণা করা হয়েছিল সংস্কার শেষে সেতুটি ফের প্রাণ ফিরে পাবে। চলতে পারবে হালকা যান। কিন্তু সংস্কারেও সচল হয়নি সেতুটি। ফলে এখন পদচারী সেতু হিসেবেই ব্যবহৃত হচ্ছে কিন ব্রিজ।
ইতিহাস ঘেঁটে দেখা গেছে, সিলেট নগরীর ভিতর দিয়ে প্রবহমান সুরমা নদীর দুই পাড়কে সংযুক্ত করতে ১৯৩৬ সালে নির্মাণ করা হয় লোহার কাঠামোর সেতুটি। ব্রিটিশ আমলে দৃষ্টিনন্দন এই সেতুটি নির্মাণ করেছিল রেল বিভাগ। সেতুটি নির্মাণে সময় লেগেছিল প্রায় দুই বছর। তৎকালীন অবিভক্ত ভারতের আসাম প্রদেশের গভর্নর মাইকেল কিনের নামানুসারে সেতুটির নামকরণ করা হয় ‘কিন ব্রিজ’। এরশাদ আমলের পূর্ব পর্যন্ত এটিই ছিল সুরমা নদীর ওপর নির্মিত একমাত্র সেতু। সুরমার ওপর নির্মিত এই প্রথম সেতুটি দিয়ে ৮৯ বছর ধরে মানুষ চলাচল করে আসছে। ১ হাজার ১৫০ ফুট দীর্ঘ ও ১৮ ফুট প্রশস্ত ওই সেতুটি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিস্ফোরণে সেতুর দক্ষিণ প্রান্ত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্বাধীনতার ছয় বছর পর ১৯৭৭ সালে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ সেতুটি সংস্কার করে। এরপর টানা ৪৬ বছর সেতুটিতে আর সংস্কারের ছোঁয়া লাগেনি। দীর্ঘদিন ধরে সংস্কারবিহীন থাকায় সেতুটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। এর বিভিন্ন স্থানে পাটাতন উঠে যায়। লোহার রেলিং, পিলার ও লিন্টারেও জং ধরে ক্ষয়ে যায়। সব মিলিয়ে সেতুটিকে সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ) ও সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল শাখা ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে। রিকশা ছাড়া সব ধরনের যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়। গত প্রায় ১০ বছর ওই সেতু দিয়ে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। ২০২০ সালে সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে সিলেটের উন্নয়ন নিয়ে আয়োজিত এক সভায় জরাজীর্ণ কিন ব্রিজ সংস্কারের বিষয়টি আলোচিত হয়। সেতুটি সংস্কারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। পরবর্তী সময়ে সওজের পক্ষ থেকে সেতুটি সংস্কারে মন্ত্রণালয়ে অর্থ বরাদ্দ চেয়ে আবেদন করা হয়। পরের বছর ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মন্ত্রণালয় থেকে ২ কোটি ১৫ লাখ টাকা বরাদ্দ পায় সওজ সিলেট অফিস। সেতুটির মূল মালিক সওজ হলেও এর দেখভাল করে সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল শাখা। কিন্তু লোহার কাঠামোর সেতু সংস্কারে সওজ ও সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল শাখার চেয়ে রেলওয়ে বিভাগ দক্ষ হওয়ায় সংস্কারকাজের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাদের। ওই বছরের জুন মাসে বরাদ্দের টাকা রেলওয়ের সেতু বিভাগকে বুঝিয়ে দেয় সওজ। এরপর দুই বছর চলে গেলেও রেলওয়ের সেতু বিভাগ কাজ শুরু করতে পারেনি। তখন রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলেছিল, অর্থ বরাদ্দ পেলেও পরিকল্পনা তৈরি, দাপ্তরিক কাজ ও দরপত্র আহ্বান করতেই তাদের এক বছরের মতো সময় চলে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ২০২৩ সালের শেষার্ধে এসে সংস্কারকাজ শুরু করে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। সংস্কার শেষে কিন ব্রিজ আগের চেয়ে শক্তিশালী হলেও যানবাহনের ভার বহনের ক্ষমতা পায়নি। ফলে কেবল ঐতিহ্যের স্মারক ও পদচারী সেতু হিসেবেই এখন শোভা পাচ্ছে সুরমার ওপর।
লেখক : সাংবাদিক