২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলসমূহ এ বিষয়ে আরও বেশি আশাবাদী এবং সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এ অবস্থায় আসন্ন নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণের কোনো সুযোগ না থাকায় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং এনসিপি-এই তিনটি দলের মধ্যে ত্রিমুখী লড়াইয়ের যে একটি সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে সে ক্ষেত্রে নবগঠিত এনসিপি দলটি কত দূর কী করতে পারবে সে বিষয়ে আলোচনাসহ নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে কিছু বলা-ই আজকের লেখাটির মূল উদ্দেশ্য।
আসন্ন সংসদ নির্বাচনে ছাত্রসমাজের এনসিপি কত দূর কী করতে পারবে, সে কথাটি আগাম বলা মুশকিল বটে! কারণ দেশের তরুণ সমাজকে নিয়ে নবগঠিত দলটি একটি চমক সৃষ্টি করতে পারবে এমন একটি ধারণা কারও কারও মনে বদ্ধমূল হয়ে উঠলেও আমি বলব, নির্বাচনি অঙ্ক অনেক জটিল, অনেক কঠিন! তা ছাড়া নির্বাচনি মাঠও অনেক পিচ্ছিল, অনেক ঝানু খেলোয়াড়ও সে মাঠে খেলতে গিয়ে আছাড় খেয়ে ঘরে ফেরে! সুতরাং নতুন একটি দল গঠন করেই যে তারা সফলতা পাবে, কাজটি তেমন সহজও হবে না। তবে তারা যে আংশিক সফল হবে, সে বিষয়ে আমি আশাবাদী। কারণ দেশের মানুষ একটি পরিবর্তন চায়। আর সে ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলো তাদের চরিত্রে প্রামাণ্য পরিবর্তন না আনতে পারলে জনগণ তাদের বয়কট করতে পারে এবং সে ক্ষেত্রে নতুন দল এনসিপিসহ অন্য দুই-একটি ছোট দলও সুবিধা পেতে পারে।
আবার নবগঠিত এনসিপি যদি ভারতের অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়নের বা সদৌ আসাম ছাত্র সংস্থার মতো একটা কিছু করে ফেলতে পারে তাহলে তা হবে একটা অনন্য দৃষ্টান্ত! উল্লেখ্য ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত আসামের ছাত্রসমাজ Assam Agitation নামে একটি আন্দোলন গড়ে তোলার মাঝে তাদের দাবি উপেক্ষা করে ১৯৮৩ সালে সেখানে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় হিতেশ্বর শইকিয়া মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন। এ সময় আসামের ইতিহাসে জঘন্যতম নেলির হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ায় সে হত্যাকাণ্ডে ১ হাজার ৮০০ সাধারণ ছাত্র-জনতা নিহত হন, যার মধ্যে ৮৫৫ জন ছাত্র ছিলেন! সে অবস্থায় ১৯৮৪ সালে ছাত্র-জনতার বিপ্লবে হিতেশ্বর শইকিয়া সরকারের পতন হলে ছাত্রসমাজের নেতৃত্বে ‘অসম গণপরিষদ’ নামক নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠিত হয় এবং ১৯৮৫ সালের নির্বাচনে সেই দলটি সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে সরকার গঠন করলে সে সময়ের ছাত্রনেতা প্রফুল্ল কুমার মহন্ত আসামের মুখ্যমন্ত্রীর পদে আসীন হন এবং ১৯৮৫-১৯৮৯ এবং ১৯৯৬-২০০১ দুইবার তারা সরকার গঠন করেন। যদিও বর্তমান লোকসভায় তাদের আসন শূন্যের কোঠায় এবং রাজ্যসভার ২৪৫টি আসনের মাত্র একটি আসনে তারা নির্বাচিত হতে পেরেছেন! অর্থাৎ একসময়ের ছাত্রসমাজ দ্বারা গঠিত দলটি এখন মুখ থুবড়ে পড়েছে। কিন্তু তারপরও বলা চলে, ১৯৮৫ সালে তারা আসামে যে চমক সৃষ্টি করেছিল, ভারতের রাজনীতিতে সে ঘটনাও একটি ইতিহাস! যদিও আসাম রাজ্যের সে ঘটনার সঙ্গে আমাদের দেশের বর্তমান ছাত্রসমাজ দ্বারা গঠিত এনসিপি দলটিকে একই ছকে মেলানো যাবে না, তবু ঘটনাটি এখানে উল্লেখ করার কারণ হলো, অনেক সময়ই কিন্তু আবেগের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে ভোটাররা গণেশ ওলটানোর মতো অঘটন ঘটিয়ে ফেলেন! বিশেষ করে দেশের প্রতিষ্ঠিত তথা দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী ব্যর্থতার পরিচয় দিলে, দেশের মানুষকেও বিকল্প খুঁজতে হয়!
এ অবস্থায় দেশের ছোট-বড় অন্যান্য রাজনৈতিক দল সম্পর্কেও এখানে কিছু বলা দরকার! কারণ বিগত ১৫-১৬ বছরের আওয়ামী লীগের দুঃশাসনে দেশে যে রাজনৈতিক ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, রাজনীতির প্রতি মানুষের বিতৃষ্ণা সৃষ্টি হয়েছে, আন্দোলন-সংগ্রামে অনেক পরিবার সবকিছু হারিয়েছে সেজন্য দিন-রাত শুধু আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনাকে দোষারোপ করাই যথেষ্ট এবং একমাত্র কাজ বলে বিবেচিত হওয়া উচিত নয়! কারণ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের অতীত ব্যর্থতা, তাদের অযোগ্যতা ইত্যাদি বিষয়ও শেখ হাসিনা এবং তার সরকারকে যে একটি দানবীয় সরকারে পরিণত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল, সে কথাটিও ফেলে দেওয়ার মতো নয়! আর সেসব কারণে সব রাজনৈতিক দলেরই এখন আত্মশুদ্ধির দিকে দৃষ্টিপাত করা উচিত। পতিত সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দেশ ছেড়ে পালানোর পর গত এক বছরে তারা নিজেদের আচার-আচরণে কতটুকু পরিবর্তন এনেছেন, আত্মসমালোচনা করেছেন, আত্মোন্নয়ন, আত্মত্যাগ করেছেন, রাজনৈতিক দলসমূহের নেতা-কর্মীদের সে বিষয়েও মনোযোগী হওয়া উচিত। অন্যথায় দিন-রাত অতীত স্বৈরাচারী সরকারকে গালমন্দ করে গলা ব্যথা করে ফেললেও কিন্তু দেশের মানুষের আস্থা অর্জন করা যাবে না; অন্য রাজনৈতিক দলকেও এখন ভেবে দেখতে হবে, তারা জণগণের বন্ধু হয়ে উঠতে পেরেছেন কিনা? আর এজন্য মাঝেমধ্যে তারা নিজেদের চেহারাও আয়নায় দেখে নিতে পারেন! অন্যথায় তাদের অবস্থাও যে লাউ, সেই কদুর মতোই হলে, দেশের আমজনতা তাদেরও কিন্তু আস্থায় নেবে না! এ ক্ষেত্রে এ প্রশ্নটি করাই যায়-শেখ হাসিনা এবং তার সঙ্গী অপরাধী সাঙ্গপাঙ্গরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর গত এক বছরে দেশে যেসব অনাচার, অশান্তি, চাঁদাবাজি, হামলা-মামলা, সন্ত্রাস, খুন, ধর্ষণ ইত্যাদি অপকর্ম ঘটে গেল, সেসবের দায় কারা বহন করবে আর কেন কারাই বা এসব করার সাহস পেল? এসব ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত, তারাও যদি রাজনৈতিক অঙ্গনের লোকজন হয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে দেশের মানুষই-বা যাবে কোথায়? তাই বলছিলাম, আসন্ন নির্বাচনে জনগণের কাছে যাওয়ার আগে নিজেদের চেহারাটাও একবার আয়নায় ভালোভাবে দেখে নিলে আপনারাই উপকৃত হতেন। সেই সঙ্গে নবগঠিত এনসিপি দলের তরুণ নেতারাও দেখে নিতে পারেন, তাদের কোনো নেতা-কর্মী বা সমন্বয়ক চাঁদাবাজি, মিথ্যা মামলা দায়ের, মব ভায়োলেন্স ইত্যাদি অপকর্মের সঙ্গে জড়িত কি না?
পরিশেষে নির্বাচন কমিশনের উদ্দেশে আসন্ন নির্বাচন নিয়ে যা বলতে চাই তা হলো, এ দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মতো কাজটিও কিন্তু সহজ নয়। আর বর্তমান অবস্থায় কাজটি আরও কঠিন। কারণ দেশে এখনো আইনের শাসনের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। বিশেষ করে পুলিশ বাহিনী এখনো সর্বাংশে সক্রিয় নয়; তাদের চোখের সামনেই অনেক অপকর্ম, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটে চলেছে, অথচ তারা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে চলেছে! এ অবস্থায় ভোট কেন্দ্রে তাদের ভূমিকা কী হবে সহজেই তা অনুমেয়। আর ভোট কেন্দ্রে তাদের ভূমিকা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ আমার মনে হয় সে কথা কাউকে বুঝিয়ে বলতে হবে না। ৪৫ এবং ৪৮ বছর আগে আমাকে দুই দফা প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল বলে আমি সম্যকভাবে বুঝতে পারি নির্বাচনের দিন ভোট কেন্দ্রে কীসব ঘটে! একবার ভোট কেন্দ্রে বিশৃঙ্খল অবস্থায় বেরিয়ে দেখি, দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তা বারান্দায় চেয়ারে বসে আরামে সিগারেট ফুঁকে চলেছেন, তার বুকপকেটে ৫৫৫ সিগারেটের প্যাকেট দেখে ধমকিয়ে ভোট কেন্দ্রের শৃঙ্খলা ফেরাতে বলায়, সে ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ করায় ভোট কেন্দ্রে শৃঙ্খলা ফিরে আসে। তা ছাড়া সেবার আমার আরও যে বড় অভিজ্ঞতাটি হয়েছিল তা হলো, বর্তমান উত্তরার বাইলজুরি এলাকার গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ভোটের বাক্স এবং ফলাফল সদরঘাট ডিসি অফিসে জমা করতে গেলে ভোটের রেজাল্ট শিট দেখে দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেট আমাকে ফ্রেশ শিট দিয়ে তার কথামতো ভোটের রেজাল্ট পাল্টে সেখানে স্বাক্ষর করে দিতে বলায়, দুই দিনের ক্লান্তি এবং প্রায় অভুক্ত শরীরে একপ্রকার গর্জে উঠে আমি বলেছিলাম, “No, I will not do that, If you don't receive the original sheet, I will leave the place and I don't know what will happen then!” আমার সে কথাটি বেশ জোরেশোরে উচ্চারিত হওয়ায় আশপাশ থেকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কেউ এগিয়ে এসে বিষয়টি জেনে দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেটকে অরিজিনাল রেজাল্টশিট গ্রহণ করতে বলায় আমি সেদিন হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিলাম। আমাকে যারা জানেন বা চেনেন, তারা হয়তো আমার কথা বিনাবাক্যে বিশ্বাস করবেন। আমার অভিজ্ঞতার কথাগুলো এখানে উল্লেখ করার কারণ হলো, আসন্ন নির্বাচনে যারা প্রিসাইডিং অফিসার, পোলিং অফিসার হবেন, ‘তারা যদি একটু সাহস পান!’ সেই সঙ্গে আমার সন্তানসম পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশেও বলতে চাই, অনেক তো হলো, এবার একটু ঘুরে দাঁড়ান, আপনাদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে নির্বাচনি ময়দান থেকে ফায়দা লুটে যারা দেশের সম্পদ লুটপাটে মেতে ওঠে এখনই তাদের রুখে দাঁড়ানোর সময়! ভবিষ্যতে আর কোনো ভোট ডাকাত, ভোট চোর, ভোট শিকারি যাতে দেশের সাধারণ মানুষের ভোট হরণ করতে না পারে, সে দায়িত্ব আপনাদেরই বহন করতে হবে। একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের কাছেও অনুরোধ, শুধু পদপদবি লাভের জন্য কেউ নির্বাচন কমিশনের মতো সাংবিধানিক পদ গ্রহণ করতে যাবেন না। সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা বা ক্ষমতা না থাকলে বা প্রবল সৎসাহস, ইচ্ছাশক্তি তথা মানসিক শক্তির অধিকারী না হলে কারও জন্যই নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব গ্রহণ করা উচিত নয়। এ ক্ষেত্রে ভারতের সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার টি এন সেশনের পদাঙ্ক অনুসরণ করা যেতে পারে। স্থানাভাবে তার দুই-একটি সাহসী ঘটনা এখানে তুলে ধরা সম্ভব হলো না। তবে গুগল সার্চ দিলে যে কেউ তার সম্বন্ধে জানতে পারবেন। এমনকি ‘মিঠে কড়া সংলাপ’ শিরোনামে আমার পুরোনো একটি লেখাও গুগলে পাওয়া যাবে, যা পাঠ করলে বোঝা যাবে, টি এন সেশন কতটা শক্ত হাতে হাল ধরে ভারতের নির্বাচন কমিশনকে একটি শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছেন। যার ফলে ভারতে কারও পক্ষেই নির্বাচনে কারচুপি করা সম্ভব হয় না! সবশেষে বলতে চাই, দিন শেষে একটি প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে-‘অতঃপর নির্বাচন কমিশন কি সঠিক এবং সুষ্ঠু একটি নির্বাচন দেশ ও জাতিকে উপহার দিতে পারবে?’
লেখক : কলামিস্ট, বীর মুক্তিযোদ্ধা