আজ কান্নাভেজা ১৪ ডিসেম্বর। এ কান্না দেশীয় চলচ্চিত্রের একজন মানুষের জন্য। তিনি হলেন প্রয়াত আমজাদ হোসেন। আজ তাঁর প্রয়াণ দিবস। একাধারে অভিনেতা, লেখক, গীতিকার, চলচ্চিত্র প্রযোজক, পরিচালক। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে গ্রামবাংলাকে তিনি সবার কাছে তুলে ধরেছিলেন। চলচ্চিত্রে মাটি ও মানুষের কথা বলতেন তিনি। এ কীর্তিমান চলচ্চিত্রকারকে নিয়ে লিখেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ
চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের মতে, আমজাদ হোসেন গ্রামের মানুষকে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে জানতেন, যার জন্য চলচ্চিত্রে তাঁর চরিত্রগুলো জীবন্ত হয়ে উঠেছে। তাঁর দেখার ভঙ্গিটা ছিল অন্যদের থেকে আলাদা। ছবিগুলোতেও তাঁর স্বাতন্ত্র্যের ছাপ স্পষ্ট। তাঁর অনেক ছবিতে লোকজ সংগীতকে ভেঙে আধুনিকীকরণ করা হয়েছে, যা অনেক বড় কাজ বলে মনে করেন অনেকেই। আমজাদ হোসেন ১৯৬১ সালে ‘তোমার আমার’ ছবিতে অভিনয় দিয়ে চলচ্চিত্রে আগমন করেন। একই বছর মুস্তাফিজ পরিচালিত ‘হারানো দিন’ ছবিতে অভিনয় করেন। ১৯৬৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সালাউদ্দিনের ‘ধারাপাত’ তাঁর রচিত প্রথম চলচ্চিত্র এবং তিনি এ চলচ্চিত্রে একটি প্রধান চরিত্রে অভিনয়ও করেন। পরবর্তীতে জহির রায়হানের সহকারী হিসেবে কয়েকটি চলচ্চিত্রে কাজ করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- লোককাহিনিনির্ভর ‘বেহুলা’ (১৯৬৬)। আমজাদ হোসেন পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘আগুন নিয়ে খেলা’ (১৯৬৭)। তিনি এটি নুরুল হক বাচ্চুর সঙ্গে যৌথভাবে নির্মাণ করেন। একক পরিচালক হিসেবে তাঁর নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘জুলেখা’ (১৯৬৭)। পরের বছর তিনি নুরুল হক বাচ্চু, মুস্তাফা মেহমুদ ও রহিম নওয়াজের সঙ্গে যৌথভাবে ‘দুই ভাই’ চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেন। ছবিটির প্রযোজক ও চিত্রনাট্যকার ছিলেন জহির রায়হান। এ ছাড়া তিনি এককভাবে ‘বাল্যবন্ধু’ (১৯৬৮) চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। ১৯৭০ সালের মুক্তিপ্রাপ্ত জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’র সংলাপ রচনা করেন এবং এতে মধু চরিত্রে অভিনয় করেন। মুক্তিযুদ্ধ-পূর্বকালীন এ সিনেমা স্বাধীনতা আন্দোলনে গণজোয়ার এনেছিল। গ্রামবাংলার ভালোবাসার ছবি হিসেবে পরিচিত ‘সুজন সখী’রও কাহিনিকার, সংলাপ রচয়িতা তিনি। পৌরাণিক কাহিনি নিয়ে নির্মিত জনপ্রিয় ছবি ‘বেহুলা’র সংলাপও তাঁর লেখা। এ ছাড়া ‘ধারাপাত’, ‘আনোয়ারা’, ‘আবার তোরা মানুষ হ’, ‘জয়যাত্রা’, ‘আকাশছোঁয়া ভালোবাসা’র মতো জনপ্রিয় ছবিগুলোর কাহিনিকার তিনি। তিনি নয়ন মণি (১৯৭৬), গোলাপী এখন ট্রেনে (১৯৭৮), সুন্দরী (১৯৭৯), জন্ম থেকে জ্বলছি (১৯৮০), দুই পয়সার আলতা (১৯৮১), কসাই (১৯৮২), ভাত দে (১৯৮৩), সখিনার যুদ্ধ (১৯৮৪), ‘গোলাপী এখন বিলেতে (১৯৮৭), ‘হীরামতি’, ‘প্রাণের মানুষ’, ‘সুন্দরী বধূ’, ‘বাল্যবন্ধু’, ‘পিতাপুত্র’, ‘এই নিয়ে পৃথিবী’, ‘বাংলার মুখ’ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। নয়ন মণি ছবিটি তাঁর নিজের রচিত নিরক্ষর স্বর্গে ও গোলাপী এখন ট্রেনে তাঁর দ্রোপদী এখন ট্রেনে উপন্যাস অবলম্বনে নির্মাণ করেন। ‘নয়নমণি’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার বিভাগে তিনি প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। গোলাপী এখন ট্রেনে ছবিটি দিয়ে তিনি দেশ-বিদেশে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেন। ছবিটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ ১১টি বিভাগে জাতীয় পুরস্কার অর্জন করে। আমজাদ হোসেন এক বছরে রেকর্ডসংখ্যক পাঁচটি পুরস্কার অর্জন করেন। সেগুলো হলো- শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র প্রযোজক, পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, সংলাপ রচয়িতা ও গীতিকার। তিনি সুন্দরী ছবি দিয়েও সফলতা অর্জন করেন। ছবিটি সাতটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে এবং শ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতা ও গীতিকার বিভাগে তিনি দুটি পুরস্কার অর্জন করেন। ‘ভাত দে’ ছবিটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ মোট ৯টি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে। তিনি শ্রেষ্ঠ পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, ও সংলাপ রচয়িতা বিভাগে তিনটি পুরস্কার অর্জন করেন।
এ ছাড়া শিল্পকলায় অবদানের জন্য একুশে পদক (১৯৯৩), অগ্রণী ব্যাংক শিশু সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৩, ১৯৯৪), উপন্যাসে অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (২০০৪), ভূতের রানী হিমানীর জন্য ইউরো শিশু সাহিত্য পুরস্কার (২০০৮), ফজলুল হক স্মারক পুরস্কার (২০০৯), টেলিভিশন রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ পুরস্কার আজীবন সম্মাননা (২০১০) লাভ করেন। টিভি নাটক জব্বর আলীতেও সফল ছিলেন আমজাদ হোসেন। সত্তর দশক থেকে ঈদ বিনোদনের অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল জনপ্রিয় টিভি সিরিজ ‘জব্বর আলী’। এর নাম ভূমিকায় তিনিই অভিনয় করেছেন। নাটকটি তাঁরই রচিত গল্পের এবং পরিচালনার। তিনি একজন অসাধারণ গীতিকারও। ১৯৮১ সালে চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত পালন করেন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৪২ সালের ১৪ আগস্ট জামালপুরে জন্মগ্রহণ করেন এবং ২০১৮ সালের ১৪ ডিসেম্বর চিরতরে পরপারে চলে যান এ ক্ষণজন্মা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।