প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্যতার কারণে যুগ যুগ ধরে সাদা চামড়ার মানুষের আধিপত্যবাদী আচরণ আর দমন-পীড়নের শিকার হচ্ছে আফ্রিকার মানুষ। এই মহাদেশের খনিজ সম্পদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো তেল। আর তেলের কথা উঠলে আফ্রিকার যে দেশটির নাম সবার আগে উচ্চারিত হয়, তার নাম নাইজেরিয়া। নাইজার, বেনু আর ক্রস নদীসংলগ্ন তিন লাখ ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বেশি এলাকা বিস্তৃত পশ্চিম আফ্রিকার দক্ষিণ উপকূলের এ দেশটির ভূগর্ভে রয়েছে তেল, গ্যাস, কয়লা, লোহা, টিন, চুনাপাথর, কলামবাইট, সোনা, ট্যানট্যালাইট। বছরের পর বছর বিভিন্ন পশ্চিমা কম্পানি তেলসহ বিভিন্ন খনিজ পদার্থের জন্য আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে আফ্রিকার বুকে।
ইতিহাস নীরব ভূমিকা পালন করলেও সম্পদের হিসাবের প্রশ্নে চুপ করে থাকেনি নাইজেরিয়ার মানুষ। তারা বিভিন্ন সময় পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে অনেক প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করেছেন। কিন্তু দেশটির পশ্চিমা মদদপুষ্ট সরকার এবং সেনাবাহিনীর হাতে বারবার মার খেতে হয়েছে তাদের। নাইজেরিয়ার এমনি এক অবস্থায় ২০০১ সালে জন্ম হয় একটি সশস্ত্র সংগঠন বোকো হারামের।
'বোকো' শব্দটি হাউসা ভাষার আর 'হারাম' এসেছে আরবি থেকে। বোকো অর্থ পশ্চিমা শিক্ষা। বোকো হারাম মানে 'পশ্চিমা শিক্ষা পাপ'। পশ্চিমা শিক্ষা এবং পশ্চিমা ধাঁচে জীবনযাপনের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান প্রকাশ করেই এই সংগঠনটি আত্মপ্রকাশ করে। তাদের মতে, পশ্চিমা শিক্ষা মুসলমানদের দুর্নীতিগ্রস্ত করে তোলে। মূলত দেশটির সালাফিস্ট দল থেকে একটি উগ্রবাদী জিহাদীগোষ্ঠী তৈরি হয়, যার নামেই বোকো হারাম। যারা পশ্চিমাবিরোধী এবং নাইজেরিয়ায় ইসলামী শরিয়া সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সংগঠনটির পৃষ্ঠপোষক ও নেতা মোহাম্মদ ইউসুফ ২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসিকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, 'এই পৃথিবীতে যেসব স্থানে ইসলামী শিক্ষা দেওয়া হয়, তা পুরোপুরি সঠিক নয়। ডারউইনের মূল্যায়ন ও ধারণা এসব শিক্ষায় ভর করে আছে। ইউসুফের দল প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা ও গণতন্ত্রকে স্বীকার করেন না।' নাইজেরিয়ার শিক্ষাবিদ হুসাইন জাকারিয়া এ প্রসঙ্গে বিবিসিকে জানান, বোকো হারামের দলপতির চালচলনও ইসলামসম্মত নয়, তার আচরণ বিতর্কের ঊর্ধ্বে মোটেও নয়।
বোকো হারাম একটি সংগঠন হিসেবে শুরুর দিকে কিছুটা শান্তিপূর্ণ কার্যক্রম শুরু করলেও ধীরে ধীরে তারা অশান্ত হয়ে ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালে এই সংগঠনটির সদস্যদের ব্যাপারে খুঁটিনাটি তথ্য অনুসন্ধান করতে শুরু করে নাইজেরিয়া সরকার। অনুসন্ধানের পাশাপাশি সরকার অভিযান শুরু করলে বাউসি অঞ্চল থেকে অনেককেই গ্রেফতার করা হয়। এ সময় সরকারের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষে প্রায় ৭০০ মানুষ নিহত হয়। সংঘর্ষের একপর্যায়ে বোকো হারাম নেতা ইউসুফকে গ্রেফতার করা হয় এবং পুলিশ হেফাজতে তার মৃত্যু হয়। ইউসুফের মৃত্যুর পর বোকোর নেতৃত্বে কে আছেন তা এখন পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। তবে পরবর্তী সময়ে আবু বকর শেখ ইউসুফের স্থলাভিষিক্ত হন। রয়টার্স জানায়, ইউসুফের পর আবু বকর শেখ দলের হাল বেশ শক্তভাবে ধরেছেন।
নাইজেরিয়ার উত্তরাঞ্চলে বোকো হারামের প্রধান ঘাঁটি। বোরনো প্রদেশের রাজধানী মাইদুগুরির নিকটবর্তী শহর দাম্বোয়ায় বোকো হারাম প্রতিষ্ঠিত হয়। সেখানে বোকো হারাম শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে বলে জানা যায়। সংগঠনটি আত্মপ্রকাশের পর থেকে অনেক মানুষ হত্যা করেছে। এর মধ্যে ২০১০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর বাউসি জেল ভেঙে বন্দিদের পলায়ন, ৩১ ডিসেম্বর আবুজায় হামলায় গত বছরের ২২ এপ্রিল ইয়োলা জেল ভেঙে ১৪ বোকো সদস্যের পলায়ন, ২৯ মে নাইজেরিয়ার উত্তরাঞ্চলে বোমা হামলা, ১৬ জুন আবুজা পুলিশ সদর দপ্তরে বোমা হামলা, ২৬ জুন মাইদুগুরির একটি বাগানে হামলা চালালে ২৫ ব্যক্তি নিহত ও ১২ জন আহত, ১০ জুলাই সুলেজার খ্রিস্টান ফেলোশিপ চার্চে বোমা হামলা, ১১ জুলাই নিরাপত্তার কারণে মাইছগুরি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা, ১২ আগস্ট প্রসিদ্ধ মুসলিম নেতা লিমান বানা বোকোর হাতে নিহত, ২৬ আগস্ট আবুজায় বোমা হামলা, ৪ নভেম্বর দামাতুরু আক্রমণ, ২৫ ডিসেম্বর নাইজেরিয়ার বিভিন্ন স্থানে হামলা, চলতি বছরের ৫ ও ৬ জানুয়ারি দেশটিতে সিরিজ হামলা, ২০ জানুয়ারি কান্যেয় বোমা হামলা, ২৮ জানুয়ারি ১১ জন সেনাসদস্যকে হত্যা, ৮ ফেব্রুয়ারি কাদুনার সেনা সদর দপ্তরে আত্মঘাতী হামলার দায়িত্ব স্বীকার, ১৬ ফেব্রুয়ারি জেল ভেঙে ১১৯ বন্দির পলায়ন, ৮ মার্চ ব্রিটিশ উদ্ধারকর্মী ও ইতালিয়ান প্রকৌশলীর হামলা, ৩১ মে জয়েন্ট টাস্কফোর্সের হামলায় পাঁচ জার্মানসহ বেশ কয়েকজনকে হত্যা, ৩ জুন বাউসির ১৫ চার্চে হামলা, ১৭ জুন কাদুনার তিনটি চার্চে হামলায় অর্ধশতাধিক লোককে হত্যা, ওই দিন প্লাটিআউ রাজ্যে ১৩০ জনের লাশ উদ্ধার, যাদের বোকো জঙ্গিরা হত্যা করে। সর্বশেষ গত ১৪ এপ্রিল নাইজেরিয়ার উত্তর-পূর্বের এলাকা থেকে ২৭৬ স্কুলছাত্রীকে অপহরণ করে বোকো হারামের জঙ্গিরা। ওই ছাত্রীদের উদ্ধার করার আগেই গত ৬ মে আরো আট ছাত্রীকে অপহরণ করেছে গোষ্ঠীটি। শুধু তা-ই নয়, অপহরণ-পরবর্তী সময়ে নাইজেরিয়ার সরকার অপহৃত ছাত্রীদের উদ্ধারে সহায়ক তথ্য দেওয়ার জন্য আর্থিক পুরস্কার ঘোষণার পর গণহত্যা চালিয়েছে বোকো হারাম। কট্টর ইসলামপন্থী এ জঙ্গি সংগঠনের হামলায় ৩০০ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে কর্তৃপক্ষ।
অপহৃত স্কুলছাত্রীদের বোকো হারাম দাস হিসেবে বিদেশের মাটিতে বিক্রি করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। বোকো হারামের বন্ধুরাষ্ট্র সেনেগাল এই অপহৃত ছাত্রীদের কিনবে বলে জানা গেছে। অবশ্য শুধু সেনেগালই নয়, দাস কেনাবেচার তালিকায় আরো প্রায় ১৫টি রাষ্ট্র রয়েছে, যারা নিজেরা যেমন দাস হিসেবে মানুষ বিক্রি করে, তেমনি নিজেদের প্রয়োজনে অন্য রাষ্ট্র থেকে দাস কেনেও।
বোকো হারামের এ যাবতকালের কর্মকাণ্ডের দিকে তাকালে স্পষ্টতই দেখা যায় যে তারা ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করেছে। একদিকে যেমন তাদের লোকবল বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে তাদের অস্ত্রের মজুদ। পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশসহ পশ্চিমা কয়েকটি রাষ্ট্র থেকে প্রতিনিয়ত তাদের কাছে অর্থ আসছে। এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরবের ওপরও অভিযোগ আছে বোকো হারামকে অর্থ সহায়তা দেওয়ার। অবশ্য এই অভিযোগের পেছনে যথেষ্ট কারণও আছে। বোকো হারামের প্রতিষ্ঠাতা ইউসুফের যাত্রা শুরু হয় সৌদি আরবে শরণার্থী হিসেবে। এ সময় সৌদি আরবের বেশ কিছু দাতাগোষ্ঠীর সঙ্গে তার নিয়মিত আলোচনা হতো, যা পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি প্রকাশ করে। সৌদি আরবের একিউআইএম নামের একটি সংস্থা নিয়মিত বোকো হারামকে অর্থ সহায়তা দিয়ে থাকে, যা সংগঠনটির মুখপাত্র স্বীকার করেন। ২০১১ সালে বোকো হারামের শীর্ষস্থানীয় নেতারা উমরাহ করার উদ্দেশ্যে সৌদি আরব যান এবং সেখানে আল-কায়েদার নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ওই সাক্ষাতে নাইজেরিয়ার একটি চার্চে হামলার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয় বলে জানা যায়। যার রেশ ধরে ২০১২ সালের নভেম্বর মাসের ২৫ তারিখ বোকো হারাম নাইজেরিয়ার একটি চার্চে ভয়ানক হামলা চালায়।
তবে শুধু অর্থ সহায়তা নয়, সংগঠনটি বিভিন্ন দেশ থেকে লোকবল সহায়তাও পেয়ে থাকে। সূত্র মতে, আল মুন্তাদা ট্রাস্ট ফান্ড বোকো হারামের জন্য তহবিল সংগ্রহ করে। এই সংস্থাটির সদর দপ্তর যুক্তরাজ্যে। অথচ যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রই সবচেয়ে বেশি সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে মানবতাকে কাজে লাগিয়ে কথা বলে। একেই বোধ হয় বলা হয় সর্ষের ভেতর ভূত।