এককালের বিশাল বনজ সম্পদে ভরপুর পার্বত্যাঞ্চল এখন বৃক্ষশূন্য ন্যাড়াভূমি। বনশূন্য হওয়ায় হারিয়ে গেছে পার্বত্যাঞ্চলের জীব-বৈচিত্র। পার্বত্যাঞ্চল থেকে পাচার হয়ে গেছে হাজার হাজার কোটি টাকার কাঠ। পার্বত্যাঞ্চলে প্রাকৃতিক বন ছাড়াও কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে বিশাল এলাকাজুড়ে সৃজন করা হয়েছিল সরকারি বনবাগান ও সংরক্ষিত বনাঞ্চল। কিন্তু সেসব সমৃদ্ধ বনজ সম্পদ লুণ্ঠিত হয়ে যাওয়ায় পরিণত হয়েছে বিরানভূমিতে। অনিয়ন্ত্রিত বন ব্যবস্থাপনা এবং অবাধে বৃক্ষ নিধন ও বন উজারের ফলে এখানকার বন ও বনজ সম্পদের অপরিমিত ক্ষতি সাধিত হয়েছে।
এককালের সবুজঘেরা পাহাড়ি বন-বণানী বর্তমানে বৃক্ষশূন্য হয়েছে। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহ্যমন্ডিত বিশাল ও সমৃদ্ধ বনজ সম্পদের ভান্ডার এখন জীর্ণদশার দ্বারপ্রান্তে। পার্বত্যাঞ্চলের সংরক্ষিত বন ধংস হয়ে এখন বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে। এসব কোটি টাকার কাঠ দিনের পর দিন অবাধ নিধনযজ্ঞ ও পাচার কাজ চালিয়েছে বলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। রাঙামাটির বিস্তৃত বনাঞ্চলে একসময় বন্য প্রাণীর দ্বিতীয় বৃহত্তর আধার হিসেবে বিবেচনা করা হত। ছোট বড় বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণীর সমৃদ্ধ ছিল এ পাহাড়ি অঞ্চলে।
তথ্য সূত্রে জানা গেছে, এ পাহাড়ি অঞ্চলে প্রায় ৭৫ প্রজাতির সত্মন্যপায়ী প্রাণী, ১০০ প্রজাতির পাখী, ৭ প্রজাতির উভয়চর প্রাণী ও ২৫ প্রজাতির সরীসৃপের আবস্থান ছিল। কিন্তু কালের পরিবর্তনসহ অপরিকল্পিত জুম চাষ ও নির্বিচরে বৃক্ষ নিধনের ফলে বন্যপ্রাণীদের নিরাপদ আবাসস্থল ক্রমশ: ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে এ পাহাড়ি অঞ্চলে বন্যপ্রাণীর সংখ্য হ্রাস পায়। বিশেষ করে মায়া হরিণ, হাতি, বন্য শুকর, বন ছাগল, বিভিন্ন প্রজাতির পাখী।
রাঙামাটি জেলার পাহাড়গুলো উষ্ণমন্ডলীয় মিশ্র চিরহরিত্ বন হিসাবে পরিচিত লাভ করলেও অবাধে বৃক্ষ নিধন ও বনজ সম্পদ পাচারের কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে এ অঞ্চলের বনে বৃড়্গ প্রজাতির মধ্যে উলেস্নখযোগ্য গর্জন, সিভিক, চন্দুল চম্পা, নারিকেলি, তেলসুর, তালি, পিটরজ, শিমুল, তুন, ভাদি, জারম্নল, কদম, পিটালী, শিমূল, বান্দরহোলা, আমড়া, আমলকি, চিকরাশিসহ আরও বিভিন্ন প্রজাতির নাম নাজানা বৃড়্গ।
তথ্যসূত্রে বলা হয়েছে, ১৮৭১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ১৮৬৫ সালের ঠওও নং আইনের ধারা মোতাবেক গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নতুন সৃষ্ট তত্কালীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার ৬,৮৮২.০ বর্গমাইল ভূমির মধ্যে ৫,৬৭০.০ বর্গমাইল ভূমিই সরকারি বন ঘোষিত হয়। এসব বনাঞ্চলের ইতিমধ্যে কাঁচালং সংরক্ষিত বনের ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৮৪০.৮ একর, রাইংখং সংরক্ষিত বনের ১ লাখ ৮৮ হাজার ৫৩৭.৬০ একর এবং বরকল সংরক্ষিত বনের ৫৮২.৪০ একর ধংস হয়ে গেছে। ১৮৬২ সালে বনজদ্রব্য হতে রাজস্ব আদায়ের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে টোল ষ্টেশন স্থাপিত হয়। ১৮৬৯ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের বন এলাকার দায়িত্বে সর্বপ্রথম একজন সহকারি বন সংরক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। ১৮৭৫ সালে মাইনী নদীর অববাহিকার ৩৩৯ বর্গমাইল এলাকাকে সর্বপ্রথম সংরক্ষিত বন ঘোষণা করা হয়। পরে সীতাপাহাড় ও রাইংখিয়ং এলাকাকে নিয়ে সংরক্ষিত বন গঠনসহ ১৮৮৪ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে সর্বমোট সংরক্ষিত বনের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ হাজার ৩৪৫ বর্গমাইল। ১৯০৯ সালে চট্টগ্রাম বিভাগ হতে পৃথক হয়ে আত্মপ্রকাশ করে পার্বত্য চট্টগ্রাম বন বিভাগ।
বন বিভাগের তথ্য মতে, চট্টগ্রাম বন সার্কেলের ৭টি বন বিভাগ ও রাঙামাটি বন সার্কেলের ৬টি বন বিভাগে ৭ লাখ ২৫ হাজার হেক্টর বনাঞ্চল রয়েছে। এর মধ্যে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের (রিজার্ভ ফরেস্ট) পরিমাণ ৬ লাখ ৮০ হাজার হেক্টর। রাঙামাটি বন সার্কেলে রিজার্ভ ফরেস্ট-এর পরিমাণ ২ লক্ষ ৭৭ হাজার ২৩০ হেক্টর এবং চট্টগ্রাম সার্কেলে রিজার্ভ ফরেস্টের পরিমাণ ৩ লক্ষ ৩০ হাজার ৬৯৩ হেক্টর। এই বিশাল সংরক্ষিত বনভূমি রক্ষার দায়িত্বে আছেন মাত্র ১৪শ’ বন প্রহরী। পর্যাপ্ত জনবল ও অবকাঠামো না থাকায় বন দস্যূদের নিত্য হানায় সবুজ বনসহ বিলুপ্ত হতে হয়ে যাচ্ছে পার্বত্যাঞ্চলের জীব-বৈচিত্র।
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, পার্বত্যাঞ্চলে যত্রতত্র অনিয়ন্ত্রিত জুম চাষ হয়। জমিতে বার বার জুম চাষের ফলে ফলন কমে যায়। তাছাড়া জনসংখ্যাবৃদ্ধির ফলে খাদ্য সংস্থানের তাগিদে নতুন নতুন এলাকায় জুম চাষের বিস্তৃতি হচ্ছে। বনাঞ্চলে গড়ে উঠছে জনবসতি। ফলে বনাঞ্চল সংকুচিত হচ্ছে। এছাড়া অসাধু ব্যবসায়িদের জন্য কাঠ পাচারের ঘটনা ঘটছে প্রয়া সময়। তবে নতুন বনায়ন সৃষ্টি, ইকোপার্ক স্থাপন, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে গেম রির্জাভ স্থাপন ও সুষ্ঠু বন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের ড়্গয়িঞ্চু বনজ সম্পদ পুনরোদ্ধার করা সম্ভব হবে।