বাঙালির কাছে যেন ভাতের কোন বিকল্প নেই। এক বেলা ভাত না খেলে মনে হয় অনাহারে আছি। কিন্তু সেই ভাত বলতে আমরা প্রতিদিন কি খাচ্ছি? প্রতিদিন বাজারে গিয়ে ক্রেতারা ভালো চালের সন্ধান করেন। আর ভালো চাল বলতে সাদা ধবধবে ও চিকন চাল। এটাই সবার কাছে বেশি পছন্দের। দাম বেশি হলেও চাই নিখুঁত চিকন এবং সাদা চাল। আর খাবারের টেবিলে চাই ধবধবে সাদা চিকন ভাত। কিন্তু এই চিকন সাদা ভাতই ডেকে আনছে ক্যানসার, বহুমূত্র ও হৃদরোগের মতো জটিল সব ব্যাধি। এমন তথ্যই দিয়েছেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের শস্যমান ও পুষ্টি বিভাগের গবেষকরা। তাদের গবেষণায় বিষয়টি ধরা পড়েছে।
গবেষকরা জানিয়েছেন, সাদা ও চিকন হওয়ার কারণে ক্রেতারা চাল কিনছেন এবং প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন। দেশে উৎপাদিত ব্রি ২৮ এবং ব্রি ২৯ ধানের মোটা চালকে ক্রেতার কাছে অতি আকর্ষণীয় করার জন্য অটোরাইস মিলে প্রক্রিয়া করা হয়। মোটা চালকে অধিক ছাঁটাই করে বানানো হয় চিকন চাল। একটি মোটা চালের ২৫ থেকে ৩০ ভাগ ওভার পলিশিং করে বানানো হচ্ছে চিকন চাল। গাত্র ছেঁটে ফেলার কারণে চাল খানিকটা সাদা হয়। আর এভাবে মেশিনে বানানো চিকন চালের নাম দেওয়া হচ্ছে মিনিকেট, নাইজারশাইল, জিরাশাইল অথবা কাটারীভোগ। বাজারজাত করা হচ্ছে এসব চাল, যার পুষ্টিমানে ব্যাপক ঘাটতি থাকছে।
গবেষকরা বলেন, এই চালের ভাত দীর্ঘদিন খেলে ক্যানসার, বহুমূত্র ও হৃদ্রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। মোটা চাল মেশিনে কেটে চিকন করার কারণে চালের অনেক গুণাগুণ নষ্ট হয়।
গবেষকরা আরো বলেন, এসব চাল প্রকৃত চালের চেয়ে অপেক্ষাকৃত লম্বা, চিকন ও সাদা। এই চালে প্রাকৃতিক আঁশের পরিমাণ কম থাকে বিধায় স্বাস্থ্যবান্ধব নয়। আমিষের পরিমাণ অপেক্ষাকৃত কম থাকে। ভিটামিন ও মিনারেলসের পরিমাণ কম থাকার কারণে শরীরে এসব খাদ্য উপাদানের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। এই চালে গ্লাইসেমিক ইনডেক্স বেশি হয়। আর গ্লাইসেমিক ইনডেক্সযুক্ত চালের ভাত খাওয়ার কারণে বহুমূত্র, হৃদ্রোগ ও ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
গবেষকরা বলেন, দেশের অটোরাইস মিল মালিকরা একদিকে যেমন মোটা চাল ২৫ থেকে ৩০ ভাগ ছাঁটাই করে চিকন চাল বানিয়ে বাজারজাত করছেন, তেমনি মানবদেহে ক্যানসারের বীজ বপন করছেন। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের হিসাব অনুযায়ী, মোটা চালকে চিকন করার মধ্য দিয়ে অটোরাইস মিল মালিকরা প্রতিবছর ২.৫৩ মিলিয়ন মেট্রিক টন চাল নষ্ট করছেন।
দেশের শস্যমান ও পুষ্টি বিভাগের গবেষকরা ফাইবারবিহীন ও গ্লাইসেমিক ইনডেক্সযুক্ত ক্ষতিকারক চিকন ও সাদা ধবধবে চাল কেনায় বিরত থাকার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। এই চাল চেনার উপায়ও বলে দিয়েছেন তারা।
বাজারে যে চাল নিরাপদ তা দেখতে অপেক্ষাকৃত মোটা ও বাদামি। এই চালে ফাইবারের পরিমাণ বেশি থাকে। আমিষ, ভিটামিন ও মিনারেলসের পরিমাণ অপেক্ষাকৃত বেশি থাকায় এটি স্বাস্থ্যবান্ধব। গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম হওয়ায় মোটা ও বাদামি চাল জীবনের জন্য নিরাপদ। এই চালের মূল্যও তুলনামূলক কম।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের শস্যমান ও পুষ্টি বিভাগের প্রধান ড. মহাম্মদ আলী সিদ্দিকী জানান, বিশ্বের অনেক দেশে চালের পলিশ না উঠিয়ে চাল বাজারজাত করা হচ্ছে। নীতিগতভাবে কোনো চালে ওভার পলিশিং বা চাল ছাঁটাই করা ঠিক না। কারণ, এতে ওই চাল আর স্বাস্থ্যবান্ধব থাকে না।
ড. আলী সিদ্দিকী আরো বলেন, ‘চালে ওভার পলিশিং নিষিদ্ধ হওয়া দরকার। তবে এ ক্ষেত্রে কথা থাকে যে, চাল ১০ ভাগ ওভার পলিশিং করলে মানবদেহের ক্ষতি এড়ানো সম্ভব। আর এটা করা হলে প্রতিবছর যে পরিমাণ চাল নষ্ট হচ্ছে, তা কমে আসবে।’
অপেক্ষাকৃত সাদা ও চিকন চাল কেনা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, কৃত্রিমভাবে তৈরি সাদা ও চিকন চালের ভাত দীর্ঘদিন খেলে মানবদেহে ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।’ জনসচেতনতা বাড়াতে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের শস্যমান ও পুষ্টি বিভাগ প্রচারপত্র বিলি করছে। সম্প্রতি ঢাকায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে তিন দিনব্যাপী কৃষিপণ্য প্রদর্শনীতে প্রচারপত্র বিলি করা হয়েছে।’