সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী রাইসা। বাবা-মা আদর করে রাইসা মনি বলে ডাকে। একমাত্র সন্তান। কোন কিছু চাওয়ার আগেই সামনে হাজির হয়ে যায়। ল্যাপটপ, অ্যান্ড্রয়েড মোবাইলসহ যাবতীয় প্রযুক্তি তার হাতের মুঠোয়। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাশে রোল ১/২ এর মধ্যে থাকত। ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠেই কেন যেন পড়াশুনায় মনোযোগ কমতে থাকে রাইসার। রেজাল্ট খারাপের দিকে যেতে থাকে। সারাক্ষণ মোবাইল আর ফেসবুকেই পার হয় রাইসার দিন। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথাবার্তা কমিয়ে দেয়। হঠাৎ একদিন রাইসা আর স্কুল থেকে ফিরল না। মায়ের মোবাইলে একটা এসএমএস আসে রাইসার- ''Ma ami chole gelam. Ami valo thakbo. Amake khojer dorker nei.'' অনেক খোঁজাখুঁজি করেও মিলল না রাইসার হদিস। শেষে একদিন রাইসা ফিরল বাড়ি। চোখের নিচে কালো দাগ। ওজন কমেছে অন্তত ৭/৮ কেজি। মলিন চেহারায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে রুক্ষ চুলগুলো। এসেই রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বিছানায় উপুড় হয়ে কাঁদল সারাদিন।
না, রাইসাকে কেউ কোথাও তুলে নিয়ে যায়নি। সে নিজেই নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল। ফেসবুকের এক বন্ধুর সঙ্গে ঘর বাঁধতে বাবা-মায়ের ঘর ছেড়েছিল। ছেলেটি মাদকাসক্ত। পালিয়ে তারা প্রথমে এক বন্ধুর মেসে ওঠে। সেখানে একরাত থেকে চলে যায় কক্সবাজার। হোটেল বদলে সেখানে কাটে ২০ দিন। এরমধ্যে রাইসার গলার স্বর্ণের চেইনটিও বিক্রি করতে হয় হোটেলের বিল মেটাতে। এরমধ্যে টাকার জন্য একদিন রাইসার গায়ে হাতও তোলে ছেলেটি। একদিন ছেলেটি উধাও হয়ে যায়। তার নম্বরটিও বন্ধ পাওয়া যায়। সারাদিনে ভালবাসার মানুষটি ফিরে না আসায় রাইসার বুঝতে বাকি থাকে না সে প্রতারিত হয়েছে। শেষে শখের মোবাইলটি বিক্রি করে হোটেলের বিল মিটিয়ে বাড়ির পথ ধরে রাইসা। সেই মেসে গিয়ে ওই বন্ধুটিকেও খুঁজে পাওয়া যায় না। সে অন্যত্র চলে গেছে। ছেলেটি যে ঠিকানা দিয়েছিল সেটিও ছিল ভুল। ফের বাবা-মায়ের কাছে ফিরে আসে মেয়েটি। তবে বদলে গেছে তার সবকিছু। মিলিয়ে গেছে হাসি। সেই উচ্ছ্বল রাইসা এখন সারাদিন ঘরবন্ধ করে শুয়ে থাকে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। মাঝে মধ্যে বারান্দায় গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।
এমন ঘটনা অনেক পরিবারেই ঘটে। কিশোরী বয়সে প্রেমে পড়ে অনেক মেয়েই ঘর ছাড়ে প্রেমিকের হাত ধরে। এরপর অল্প দিনেই বিবাহ বিচ্ছেদ হয়, কখনো বিয়ের আগেই ভেঙে যায় স্বপ্ন। তবে এর মধ্যেই ঘটে যায় জীবনকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া অনেক ঘটনা। বয়ঃসন্ধিকালের এ সময়টাকেই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করেন মনোবিদরা। এ সময় সবকিছুকে রঙিন বলে মনে হয়। ভালমন্দ বিবেচনা করার মতো পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকে না। পক্ষান্তরে আবেগের রঙিন ফানুষ মনকে উড়িয়ে নিয়ে যায় দূর থেকে বহুদূর। আর তাই অনেক বড় সিদ্ধান্ত নিতেও তারা দ্বিধা করে না।
কিশোরি বয়সটাকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বয়স হিসেবে ধরা হয়। মনোবিদদের মতে কিশোর বয়সে আবেগি প্রেমে জড়ানোর বিভিন্ন কারণের মধ্যে পরিবারের সদস্যদের ভালোবাসা না পাওয়াটা অন্যতম। এমন কিশোরীরা খুব সহজেই বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যায়। চোখের নেশায় মুহুর্তেই ভুলে যায় সব কিছু। এ সময় মানসিক রোগাক্রান্তও হয়ে পড়তে পারে কেউ কেউ। পারিবারিক শিক্ষা, ভালোবাসা আর পরিমিত নিয়ন্ত্রণই পারে কিশোরীদের অল্প বয়সে প্রেম আর বিয়ের মতো সিরিয়াস বিষয় থেকে দূরে রাখতে। অভিভাবকদের ভাবতে হবে পরিবারের বাইরে চলে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয় কী করে? মা-বাবার সাথে সন্তানদের মানসিক দূরত্ব থাকলেই মা-বাবা বুঝতে পারবেন না তাদের সন্তানরা কী করে, কোথায় যায়, কাদের সাথে মেশে। বিশেষ করে কিশোরি মেয়েদের প্রতি আলাদা নজর দিতে হবে। এই বয়সেই মেয়েরা ভুল করে বসে। তাই কিশোরি সন্তানের সাথে সময় কাটান, তার কথাগুলো শোনার চেষ্টা করুন বোঝার চেষ্টা করুন। তাকেও আপনাদের কথা বলুন, তার প্রতি আপনাদের ভালোবাসার যে কমতি নেই সেটা বলতে হবে তাকে।
অল্প বয়সে এভাবে ঘর ছেড়ে চলে যাওয়ার ঘটনা আগেও ঘটত। কিন্তু এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, মোবাইল ফোন ইত্যাদির অত্যধিক ব্যবহার এসব ভুলে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। অপরিচিত কারো সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলা বা চ্যাট করা কিশোরি মেয়েদের আবেগি করে তুলছে। কাউকে না চিনেই জড়িয়ে পড়ছে প্রেমে। ভুল পথে পা বাড়াচ্ছে। ছাড়ছে ঘর। এ বিষয়ে মা-বাবার খোলামেলা ভাবেই কথা বলা উচিত সন্তানের সাথে। কার সাথে কথা বলা যাবে আর কার সাথে যাবে না, কতক্ষণ সময় দেয়া যাবে ফেসবুকে, মোবাইল কখন বন্ধ করে ঘুমাতে হবে এসব নিয়ম করে দেয়া উচিত। তবে পুরোটাই হতে হবে সুন্দর বন্ধুত্বের ভিতর দিয়ে। কোনোরকম বকাঝকা ছাড়াই সন্তানকে বুঝিয়ে সুন্দরভাবে চলতে উপদেশ দিতে হবে।
বিডি-প্রতিদিন/১৫ মার্চ ২০১৫/ এস আহমেদ