ইচ্ছাকৃত পাইলটদের বিমান বিধ্বস্ত করার রেকর্ড দিন দিন বাড়ছে। এতে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে আকাশপথ। সর্বশেষ কো-পাইলটের কারণে ১৫০ যাত্রী নিয়ে জার্মান এয়ারলাইনসের বিমানটি বিধ্বস্ত হবার ঘটনাটি সবাইকে নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে। গত বছর এই মার্চ মাসেরই ৮ তারিখ ২৩৯ জন যাত্রী নিয়ে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট এমএইচ-৩৭০ নিঁখোজ হয়। সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেও পৃথিবীর বুকে তার কোন নিশানা পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া গেল না। এরপর গেল এক বছরে আরো কয়েকটি বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। যাত্রীসহ নিখোঁজ হয়েছে। পরে বিধ্বস্ত অবস্থায় খুঁজে পাওয়া গেছে। এই তালিকায় সবশেষ সংযোজন জার্মান এয়ারলাইন্সের জার্মানইউংস ৯৫২৫ বিমানটি। যেটি ২৪ মার্চ ফ্রান্সের আল্পস পর্বতে বিধ্বস্ত হয় ও এর মধ্যে থাকা ১৫০ জন যাত্রীর সবাই মারা যান।
তদন্তকারীরা বিশ্বাস করেন যে জার্মান এয়ারলাইনারের কো-পাইলট ইচ্ছাকৃতভাবে ফ্রান্সের আল্পস পর্বতে বিমানটি বিধ্বস্ত করেছেন। যদিও ওই কো-পাইলটের বাড়িতে গিয়ে কাগজপত্র ঘাটাঘাটি করে তদন্তদল জানতে পেরেছেন তিনি অসুস্থ ছিলেন। এমনকি মানসিকভাবে বিপর্যস্থ ছিলেন। ডাক্তার তাকে কর্মস্থলে যেতে নিষেধও করেছিলেন। কিন্তু তিনি শোনেননি। তদন্ত দল এখন আরও জানার চেষ্টা করছে ওই কো-পাইলট কোন কারণে বিমান বিধ্বস্ত করতে বাধ্য হয়েছিলেন কিনা। তার ওপরে কোন চাপ ছিল কিনা। কোন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল কিনা- এমন নানা কিছু। যদিও পাইলট অথবা কো-পাইলট কর্তৃক ইচ্ছাকৃতভাবে বিমান বিধ্বস্ত করার ঘটনা অস্বাভাবিক ও বিরল। কিন্তু তারপরও ইতিহাসে এমন বেশকিছু ঘটনার নজির রয়েছে যা সত্যিই শঙ্কিত করে। চলুন ইতিহাসের পাতা থেকে একটু ঘুরে আসি:
জাপান এয়ারলাইন্স : ৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৮২
জাপান এয়ারলাইন্সের ডিসি-৮ নামের একটি বিমান হানেদা বিমান বন্দরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। যাওয়ার পথে টোকিওর উপসাগরে বিধ্বস্ত হয় বিমানটি। বিমানে ২৪ জন যাত্রী ছিলেন। তারা সবাই মারা যান। তদন্ত করে দেখা যায় বেঁচে যাওয়া পাইলট মানসিকভাবে অস্থির ছিলেন। সে কারণে ইচ্ছা করেই তিনি এমনটি করেন।
রয়েল এয়ার মারক : ২১ আগস্ট ১৯৯৪
রয়েল এয়ার মারক জেট বিমানটি আগাদির থেকে কাসাব্লাঙ্কা যাচ্ছিল। কিন্তু উড্ডয়নের অল্প কিছুক্ষণ পরেই অ্যাটলাস পর্বতে বিধ্বস্ত হয়। বিমানে থাকা ৪৪ জন যাত্রীর সবাই মারা যান। বিমানের কো-পাইলটের শেষ শব্দটি নিয়ে তদন্তকারী দল তদন্ত করেন। শব্দ বিশ্লেষণ করে তারা নিশ্চিত হন যে পাইলট ইচ্ছা করেই বিমানটি বিধ্বস্ত করেছেন। ওটা ছিল পাইলটের আত্মহত্যা বিষয়ক শব্দ।
সিল্ক এয়ার : ১৯ ডিসেম্বর ১৯৯৭
সিঙ্গাপুরের সিল্ক এয়ার বোয়িং-৭৩৭ সিঙ্গাপুর থেকে ইন্দোনোশিয়ার জাকার্তা যাচ্ছিল। কিন্তু যাত্রাপথে বিমানটি ইন্দোনেশিয়ার একটি নদীতে আছড়ে পড়ে। বিমানে থাকা ১০৪ জন যাত্রী ও বিমানের ক্রুরা সবাই মারা যান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তদন্ত দল জানিয়েছিল যে একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে পাইলট ইচ্ছা করেই বিমানটি বিধ্বস্ত করে থাকতে পারেন।
সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য বিমানটির পাইলটের পদাবনতি হয়। পাশাপাশি তিনি ঋণগ্রস্তও ছিলেন। সবকিছু মিলিয়ে তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে বিমানটি বিধ্বস্ত করতে মনস্থির করেন। আর সেটি করার জন্য তিনি বিমানের ব্লাক বক্সটি বিচ্ছিন্ন করে দেন। অবশ্য সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষের তদন্তে পাওয়া তথ্যগুলো অমীমাংসিত ছিল।
ইজিপ্টএয়ার : ৩১ অক্টোবর ১৯৯৯
ইজিপ্টএয়ার ফ্লাইট ৯৯০ নামের একটি বোয়িং-৭৬৭ বিমান নিউইয়র্ক থেকে মিশরের কায়রোর উদ্দেশে যাত্রা করে। উড্ডয়নের অল্প সময়ের মধ্যেই বিমানটি আটলান্টিক মহাসাগরে বিধ্বস্ত হয়। বিমানে থাকা ২১৭ জন যাত্রীর সবাই মারা যায়। পরবর্তীতে ব্ল্যাক বক্সে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় বিমানের পাইলট ইচ্ছা করেই বিমানটিকে আটলান্টিক মহাসাগরে বিধ্বস্ত করেন। এমনকি বিধ্বস্ত করার আগে তিনি একটি ঘোষণাও দেন। সেটা ছিল ঠিক এরকম, ‘আমি আমার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি। আমি আমার বিশ্বাস স্রষ্টার উপর সোপর্দ করলাম।’
মোজাম্বিক এয়ারলাইন্স : ২৯ নভেম্বর ২০১৩
মোজাম্বিক এয়ারলাইন্স (এলএএম) ফ্লাইট টিএম ৪৭০ মাপুতো থেকে লুয়ান্ডায় যাচ্ছিল। কিন্তু বিমানটি নামিবিয়ার উত্তর-দক্ষিণাঞ্চলে বিধ্বস্ত হয়। ফলে ৩৩জন যাত্রীর মৃত্যু হয়।
পরে তদন্ত করে দেখা যায় পাইলট ইচ্ছা করেই বিমানটি বিধ্বস্ত করেন। তদন্তকারীদের মতে, ফ্লাইটের রেকর্ড থেকে জানা যায় ‘এমব্রায়ার ১৯০’ ফ্লাইটটি বিধ্বস্ত করার পেছনে পাইলটের ইচ্ছা কাজ করেছিল। ক্যাপ্টেন হার্মিনিও ডস সান্তোস ফার্নান্দেস স্বপ্রণোদিত হয়েই বিমানটি বিধ্বস্ত করেন। অন্যান্য পাইলটরা ককপিটে আটকা পড়েছিলেন এবং বার বার ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছিলেন। তারা দরজায় সজোরে আঘাতও করেছিলেন।
অনুমান করা হচ্ছে ২০১৪ সালের ৮ মার্চ ২৩৯ জন যাত্রী নিয়ে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের যে বিমানটি নিঁখোজ হয়েছে সেটার পেছনেও পাইলটের আত্মহত্যার বিষয়টি জড়িত থাকতে পারে। কারণ, পাইলট ইচ্ছা করেই যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে বিমানের রুট পরিবর্তন করেছিলেন।
বিমানের এই ধরণের নিখোঁজ হওয়া ও বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা অনেকটা দুর্যোগের আকার ধারণ করেছে। সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত ঘটনাগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘বিমান বিধ্বস্ত’ হওয়ার ব্যাপারটি। গেল এক বছরে আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা। এমতাবস্থায় প্রশ্ন থেকে যায় কিভাবে এয়ারলাইন্সগুলো তাদের পাইলটদের মূল্যায়ন করবে?
বিডি-প্রতিদিন/২৮ মার্চ ২০১৫/ এস আহমেদ